Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বেদনা ও উল্লাস

মনুষ্যসমাজের গরিষ্ঠ অংশই যে কোনও অজুহাতে আমোদ সংগ্রহের অভিযানে নামিয়াছে, জনপ্রিয় পণ্যের সহিত নিজেকে সম্পৃক্ত করিয়া সেই তরঙ্গে চড়িবার সুযোগ ছাড়িবে কেন?  

‘চের্নোবিল’-এর একটি দৃশ্য।

‘চের্নোবিল’-এর একটি দৃশ্য।

শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৯ ০১:০৮
Share: Save:

চের্নোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল ঘটিয়া যাওয়া মারাত্মক পারমাণবিক দুর্ঘটনা অবলম্বনে পাঁচ পর্বের টিভি শো ‘চের্নোবিল’ প্রচারিত হইল মার্কিন ও ইংরেজি চ্যানেলে। ইহা মানবেতিহাসে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা হিসাবে কুখ্যাত, অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারাইয়াছিলেন তীব্র তেজস্ক্রিয়তার শিকার হইয়া, শক্তিকেন্দ্রটির নিকটবর্তী শহর প্রিপায়াত আজও জনশূন্য, তবে ২০১১ সাল হইতে পর্যটকদের জন্য শহরটি খুলিয়া দেওয়া হইয়াছে, কারণ তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা নিরাপদ বলিয়া বিশেষজ্ঞরা রায় দিয়াছেন। টিভি শো-টি বিখ্যাত হইবার পরেই দলে দলে লোক সেইখানে বেড়াইতে যাইতেছেন ও হাসিখুশি ভঙ্গিমায় নিজস্বী তুলিয়া, ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করিতেছেন। কেহ লাফাইতেছেন, কেহ জীর্ণ দোলনায় দুলিতেছেন, কেহ অতি সংক্ষিপ্ত পোশাক পরিয়া নিজস্বী তুলিয়াছেন। ইহার নিন্দারও ঝড় সমাজমাধ্যমে বহিতেছে, শো-টির রচয়িতা টুইট করিয়াছেন, ‘‘ওইখানে ঘুরিতে যাইলে যে চূড়ান্ত বিয়োগান্ত ঘটনা ওইখানে ঘটিয়াছিল তাহা খেয়াল রাখুন, যাঁহারা প্রাণ হারাইয়াছিলেন ও যাঁহারা আত্মত্যাগ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের প্রতি শ্রদ্ধা লইয়া নিজ কার্যাবলি ঠিক করুন।’’ কিন্তু মনুষ্যসমাজের গরিষ্ঠ অংশই যে কোনও অজুহাতে আমোদ সংগ্রহের অভিযানে নামিয়াছে, জনপ্রিয় পণ্যের সহিত নিজেকে সম্পৃক্ত করিয়া সেই তরঙ্গে চড়িবার সুযোগ ছাড়িবে কেন?

অনুরূপ ঘটনা প্রচুর ঘটিয়াছে, বাঙালিরাও ভয়ঙ্কর ট্রেন দুর্ঘটনাকে ‘থিম’ করিয়া দুর্গাপূজার মণ্ডপ নির্মাণ করে ও দলে দলে দেখিতে যায়। ২০১০ সালে এক ইহুদি বৃদ্ধ তাঁহার নাতিপুতি-সহ পোল্যান্ড ও জার্মানির বিভিন্ন কুখ্যাত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ডিস্কো গানের সহিত প্রবল নাচিয়াছিলেন, সেইগুলির ভিডিয়ো ইউটিউবে পোস্ট হইয়াছিল। বৃদ্ধটিকে তরুণ বয়সে লইয়া যাওয়া হইয়াছিল আউশভিৎজ় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে, তিনি কোনও ক্রমে বাঁচিয়া ফিরিয়াছিলেন। তাই তিনি বলিয়াছিলেন, এত দিন পরে ওই ক্যাম্পের রাস্তায় দাঁড়াইয়া, বন্দিদের গ্যাস চেম্বারে লইয়া যাইবার গাড়িতে গাল ঠেকাইয়া যে নাচ, তাহা প্রকৃতপক্ষে অমানবিক নিপীড়নের মুখের উপর জীবনের জয়কেতন উড়াইবার নাচ। কেহ বলিতে পারে, চের্নোবিলে আজ উল্লসিত বা শরীরোৎসব পালনকারী মানুষেরাও তো এক প্রকাণ্ড বিষাদের স্থলে প্রবল প্রসন্নতারই বিজ্ঞাপন করিতেছেন, তাহা হইলে জীবনের জয়ই সূচিত হইল।

বলিলে, তাহা হইবে অতীব আস্তরণবাদী কথা। এই সেলফি-হিড়িক বা ক্যাম্প-নৃত্য উভয়ই একটি স্থানের গাম্ভীর্য ও দ্যোতনাকে অপমান করে, তাহাকে অতিসরলীকরণ ও লঘুতার শিকার করিয়া ফেলে। চের্নোবিল মানুষের তীব্র অপদার্থতার এবং অন্য প্রাণের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী না হওয়ার এক বিবরণ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প একটি জাতির কিছু মানুষের অন্য জাতির প্রতি দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত হিংসা-প্রক্রিয়ার পরিণতি। উভয়ের মধ্যেই মানুষের প্রতি অপমান নিহিত রহিয়াছে, যাহার জন্য ইতিহাসের নিকট নতজানু হইয়া ক্ষমাভিক্ষার প্রয়োজন। কেহ যদি বাক্‌স্বাধীনতার অঙ্গ হিসাবে এমন কোনও জায়গাকে নিজ ধরনে উল্লাস প্রকাশের কাজে ব্যবহারও করেন, তাহা নিন্দনীয়, কারণ অন্যায়কারী বা অমনোযোগী ও অসহায় শিকারদের ব্যক্তি-পরিসর ছাড়াইয়া দুর্ঘটনা বা হত্যালীলার অস্তিত্ব জাগিয়া থাকে। তাহা হইতে শিক্ষা লইতে হয়। কিন্তু তাহাকে উদার বা চালাক, তাৎপর্যপূর্ণ বা অবান্তর ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড দ্বারা, অতিক্রম বা মার্জনা করা যায় না, বিস্মৃত হওয়াও যায় না। বা, বলা যাইতে পারে, ব্যক্তিগত স্তরে তাহাকে লইয়া যাহাই করা যাউক, তাহাতে ওই জাগ্রত দগদগে ক্ষতটির ন্যূনতম প্রশমন হয় না। জটিল ঘটনাশৃঙ্খল বা চালচিত্রকে একটি ছোট প্রতীকে পুরিয়া ফেলিবার স্পর্ধা সমষ্টির বহুস্তর বেদনাকে অপমান করে। সেই জন্যই, এই ইতিহাসের ভয়াবহ ছোপ বহিয়া চলা স্থানগুলিতে যাইলে, বুড়া আঙুল উঁচাইয়া, দাঁত বাহির করিয়া না যাওয়াই ভাল। বৃহত্তর প্রেক্ষিত ও আবহ ভুলিয়া কেহ যদি এমন করেনও, তবে তাঁহার উচিত হইবে নিজ ছবিগুলি নিজ মশারিতে বসিয়া উপভোগ করা, সর্বসমক্ষে ছড়াইয়া দেওয়া নহে। স্থানগুলির মর্যাদাহানি তো হয়ই, তদুপরি আত্মমর্যাদা কিঞ্চিৎ কমিয়া যায়, কারণ মনে হয় ব্যক্তিটি পূজামণ্ডপ ও শ্মশানভূমির পার্থক্য বুঝেন না। হয়তো সেই কারণে তাঁহার অ্যাকাউন্টে কিছু ‘লাইক’ কমও পড়িতে পারে।

যৎকিঞ্চিৎ

বিশ্বকাপে ম্যান অব দ্য সিরিজ় তো দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি! এই সময়ে ওই দেশে বৃষ্টি হয়, তাই ম্যাচ ভেস্তে গেলে বাড়তি দিন রাখতে হবে, সে চিন্তা হয়নি! গোটা মাঠ ঢাকা দেওয়ার বিশেষ আচ্ছাদন ইডেন গার্ডেনস কিনে আনল ইংল্যান্ড থেকে, তারা নিজেরা জোগাড় করল না! এই ম্যাচগুলো হলে, কে বলতে পারে কার পয়েন্ট কোনখানে গড়াত? এতগুলো সম্ভাব্য উপভোগ্য ম্যাচ না দেখতে পেয়ে লোকেরা টিভি অফ করে দিল, বিজ্ঞাপনদাতারা আঙুল কামড়াল। পরের বিশ্বকাপ ইনডোর-এ হোক!

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

অন্য বিষয়গুলি:

Chernobyl TV Series চের্নোবিল
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy