রামায়ণ গানের আসরে বন্দনা দাস অধিকারী। নিজস্ব চিত্র
আশার কাননে কুসুম তুলিয়া/গেঁথেছিনু মালা পরাব বলিয়া/ তুমি তো এলে না/ বলিয়া সে মালা/ দিনে-দিনে যায় ঝরিয়া’। পালার নাম ‘সীতার বনবাস’। গাইছিলেন বন্দনা দাস অধিকারী। গানটি যেন বন্দনার জীবনেরই কাহিনি।
অবশ্য জীবনের শুরুতে তেমন কোনও আশা বন্দনার মনে ছিল না। কারণ সতেরো বছর পর্যন্ত অক্ষর জ্ঞানই ছিল না মেয়ের। অভাবের সংসার। ছিল না দু’বেলা ভাতের সংস্থান। বাবা খেজুরের রস ফেরি করে চাল কিনে আনলে বাড়িতে ভাত রান্না হত। সঙ্গে গ্রামের খালবিল থেকে তুলে আনা কলমি কিংবা শুষনি শাক। পেটের ভাত জোগাড় করা গেল তো পোশাক জোটানো হ়ল মুশকিল। সংসারে কিছুটা ঠেকান দিতে মাঠ-ঘাট থেকে গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে দেওয়ার কাজেই সময় কাটত। ঘুঁটেকুড়ুনি পরিচয়ে তাঁর বড় হয়ে ওঠা পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের খেলনা গ্রামে। এই মেয়ের কী ভাবে আশা-কুসুমের মালা গাঁথবে! তবুও মনের কোণে একটু আশা, রামায়ণ গান শেখার।
শেখা সম্ভব হবে ভাবেননি বন্দনা। রামায়ণ গানের পালা-গায়িকা হয়ে ওঠা নেহাতই ঘটনাচক্র। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ছিল দুর্গা। তখন দুর্গার বয়স প্রায় সতেরো। বিয়ের চিন্তা বাবা-মায়ের। দুর্গাকে কেউ বিয়ে করবেন, তা ভাবতে পারেননি গ্রামের লোক। মা-বাবাও। সেই সময়েরই ঘটনা। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে গ্রামে তিনদিন ধরে রামায়ণ গানের আসর বসে। গাইতে এলেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভগবানপুর থানার বিখ্যাত রামায়ণ গানের শিল্পী পরমেশ্বর দাস অধিকারী। সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী। সুপুরুষ। শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য রয়েছে। তবে বাড়িতে রুগ্ন স্ত্রী। দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে লালন-পালন করার লোকের অভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পরমেশ্বরবাবু। তাই দ্বিতীয় বিয়ের ভাবনা। খেলনা গ্রামের দুর্গা নামের মেয়েটি তাঁর কাছে গান শিখতে চায়, জানতে পেরেই বিয়ের প্রস্তাব দুর্গার বাবার কাছে। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান। মেয়ে কি হবে দোজবরে! জনপ্রিয় রামায়ণ গায়কের দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাবে বিচলিত দুর্গার বাবা। পাত্রের বয়সও বেশ বেশি। তবে নাছোড় পরেমেশ্বরবাবু। দুর্গারও মনে জেগেছে রাময়ণ গান শেখার সাধ। পরমেশ্বরের সঙ্গে বৈষ্ণব মতে কণ্ঠীবদল করে দুর্গা হলেন বন্দনা। স্বামীর কাছেই রামায়ণ গান শেখা। সেই ফাঁকেই শিখে নেওয়া খানিকটা লেখাপড়া।
আজও সেই দিনটির কথা ভুলতে পারেন না বন্দনা। বিয়ের দু’বছর পর এলেন বাপের বাড়ি। সেই পৌষ সংক্রান্তির মেলা। প্রতি বছরের মতো সেবারেও ওই মেলাতে রামায়ণ গান পরিবেশন করার কথা পরমেশ্বরবাবুর। কিন্তু পরমেশ্বরবাবু সকলকে চমকে দিয়ে ঘোষণা করলেন, “এবার আমি নয়। গাইবে বন্দনা।” সকাল থেকে মাইকে প্রচার হল বন্দনার নাম। গ্রামের সর্বত্র শুরু হল ফিসফাস, ‘একটা ঘুঁটেকুড়ুনি, নিরক্ষর, সে গাইবে রামায়ণ গান!’ কিন্তু পালাগানের দিনে তাঁর গানেই বিভোর হলেন গ্রামের মানুষ। এতটাই বিভোর হলেন যে, গ্রামবাসীদের অনুরোধে মেলার বাকি তিনদিনই বন্দনাকেই শোনাতে হল রামায়ণ গান। ভেসে গেলেন গ্রামের মানুষের অভিনন্দনের জোয়ারে। বন্দনার বিশ্বাস, “আসলে এ সবই ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের দয়া। তিনি জগৎ পতি, জগৎ পিতা, জগৎ বন্ধু। তিনি যদি না জোগান দেন তবে আমার কী ক্ষমতা রয়েছে যে আমি তাঁর নাম-গান গাইতে পারব?”
তার পর শুরু হল আসরে আসরে পালাগান গাওয়া। স্বামীর সঙ্গে প্রথম গাইতে যাওয়ার স্মৃতিচারণ করলেন বছর পঞ্চান্নের বন্দনা। গিয়েছিলেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। প্রথম আসর হওয়ায় বন্দনার মনে তখন উৎকণ্ঠার পাহাড়। মনে হচ্ছিল, বোধহয় পারবেন না। ভয় আর সংশয়ে রীতিমতো দিশেহারা। স্বামী অভয় দিলেন। সেই অভয়বাণীতেও ঈশ্বরচেতনা। তাঁর স্বামী বললেন, ‘রামচন্দ্র আর সীতা মায়ের নামে জয়ধ্বনি দিতে। তাহলেই হবে’। দুরুদুরু বুকে মঞ্চে উঠলেন বন্দনা। একদিকে স্বামী। অন্যদিকে তুলসিমঞ্চ। তাঁর মাথায় হাত রাখলেন পরমেশ্বর। মুহূর্তে ফিরে এল আত্মবিশ্বাস। রূপকথার মতো উত্তরণ ঘটে গেল তাঁর জীবনে। হয়ে উঠলেন ঘুঁটেকুড়ুনি থেকে রামায়ণ গানের বাংলাবন্দিত শিল্পী।
স্বামীকে সঙ্গে নিয়েই জেলায় জেলায় আসরের পর আসর ছুটে বেড়িয়েছেন বন্দনা। গেয়েছেন দূরদর্শনে, বেতারে। সুললিত কণ্ঠের জাদুতে মাতিয়েছেন সারা বাংলার মানুষকে। তবে জীবনটা যেন সেই ‘সীতার বনবাস’এর গানের মতো, আশা-কুসুমের মালা দিনে দিনে খসে পড়ে। একসময়ে পারিবারিক বিবাদের জেরে ঘর ছাড়তে হয় তাঁদের। ভগবানপুর থেকে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসেন সবংয়ের বেনেদিঘিতে। এর পরেও চলছিল তাঁর রামায়ণ গান। কিন্তু ৭২ বছর বয়সে স্বামী পরমেশ্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আবার ছন্দপতন।
এখন আর তেমন ডাক পান না। যে দু’-একটা ডাক পান, তাতে অন্ন সংস্থান হয় না। কিন্তু মন ভরিয়ে দেন শ্রোতাদের। সম্প্রতি সবংয়ের চাঁদকুড়িতে তরুণ সাহিত্যিক গৌতমদেব পাত্রের স্মরণসভায় ডাক পেয়েছিলেন। যথানিয়মে গায়কিতে মাতিয়েছেন। ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসনের কাছে শিল্পী কার্ড পেতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কার্ড মেলেনি। জোটেনি বিধবা ভাতাও। সম্বল বলতে ১০ কাঠা জমি। আর বেনেদিঘি হাইস্কুলের পিছনে একটি ছোট্ট কুঁড়েঘর। সেখানেই তিনি থাকেন ছেলে ও বৌমাকে নিয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলে জরির কাজ করেন। আর বাউল দলে বাজান তবলা। সামান্য জমিতে চাষবাসও করেন ছেলে। বউমার সঙ্গে বাড়িতে মাদুর বোনেন বন্দনা। তবে শারীরিক অক্ষমতা বাড়তে থাকায় মাদুর বুনতেও বেশ কষ্ট হয় এখন। প্রথম জীবনের সেই অভাব আবারও ফিরে এসেছে বন্দনার কাছে। তবু কোনও অভিযোগ নেই। অভিমানও। ঈশ্বর বিশ্বাসী বন্দনা বলেন, “ভগবান হয়েও প্রভু শ্রীরামচন্দ্র আর সীতামা কত কষ্ট পেয়েছেন জীবনে। আমি তো সাধারণ একজন মানুষ মাত্র! রামায়ণ গান গাইতে এখন আর তেমন ডাক পাই না। পেলেও যা সাম্মানিক জোটে, দলের অন্যান্য সদস্যদের পারিশ্রমিক দিতেই চলে যায়।” কিন্তু বলতে ভোলেন না, “পরে জন্মেও আমি যদি প্রভুর সেবক হয়ে রামায়ণ গান গাইতে পারি সেটা হবে আমার সৌভাগ্য। কারণ রামায়ণ গানের মধ্যেই যে আমি আমার স্বামীকে খুঁজে পাই!”
বাড়ির উঠোনে স্বামী পরমেশ্বরের সমাধি। জড়িয়ে ধরেন সেটি। ‘সীতার বনবাস’ পালার গানটিকেই আঁকড়ে রাখেন মনেপ্রাণে। সুরেলা কণ্ঠে গান ধরেন, “আমি তোমারে বসাব বলিয়া গো প্রভু/ রেখেছি আসন পাতিয়া/ আমার দিনে দিনে কত দিন কেটে যায়/তব আশা পথ চাহিয়া’।
কৃতজ্ঞতা: শান্তনু অধিকারী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy