আচ্ছা দিদি, আশা তো নেওয়া হল। ভরসা নেওয়া হবে কবে? মফস্সলের তরুণীর প্রশ্ন শুনে হাসতে গিয়েও ব্রেক কষতে হয়েছিল। ‘অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেলথ অ্যাকটিভিস্ট’, আদ্যক্ষর জুড়লে মেলে বাংলা শব্দ ‘আশা’। তার পিছু পিছু ‘ভরসা’ চলেই আসে। না, ‘ভরসা’ বলে কোনও ক্যাডার নেই। কিন্তু আশা-ই কি ভরসা নয়? ভারতের গ্রামের ন’লক্ষ মেয়ে কয়েক কোটি লোককে কোভিড পরীক্ষা করালেন, কোয়রান্টিনে দিলেন, রোগের দৈনিক হিসেব দাখিল করলেন, সুরক্ষার বিধি নিয়ে অজস্র প্রশ্নের উত্তর দিলেন। শুধু একটা প্রশ্নে হোঁচট খাচ্ছেন— কোভিডের সময়টা দিনে ক’ঘণ্টা কাজ করতে হল?
শুনে কী কেরল, কী পশ্চিমবঙ্গ, আশাদিদিরা খেই হারাচ্ছেন। “তা দশ ঘণ্টা তো বটেই, বারো ঘণ্টাই ধরুন। চব্বিশ ঘণ্টাও বলতে পারেন, ফোনে তো সারাক্ষণই থাকতে হয়”, বললেন এরনাকুলম জেলার কুন্নাথুনাড়ু তালুকের ভারতী দেবী। “সকাল পাঁচটা থেকে ফোন আসতে শুরু করে ঘরবন্দিদের। ন’টার সময়ে পঞ্চায়েতের সদস্যদের সঙ্গে মিটিং করি, তার পর বেরিয়ে কোয়রান্টিন কেন্দ্রগুলিতে যাই, দেখি কার কী লাগবে। তার পর বেরোই ডিউটিতে।” মানে, বাড়ি বাড়ি ভিজ়িট, ভিন্রাজ্য-ফেরতদের তালিকা তৈরি। শয্যাগতদের ওষুধ, খাবার দেওয়ার দায়িত্বও কেরল দিয়েছে আশাকর্মীদের। পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত জেলায় আশাকর্মীরা ‘থার্মাল গান’ হাতে নাকা চেকিং-এ মোতায়েন ছিলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের তাপ মাপতে।
“রাত ১২টার সময় ফোন এল— আপনি এরিয়াতে যান, অমুক পেশেন্টকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিন। কী করে যাব, ভাবেন না কেউ”, বললেন রায়গঞ্জের এক আশাকর্মী। মালদহে অ্যাম্বুল্যান্স আসার পরেও এক পজ়িটিভ পেশেন্টকে নিতে দেয়নি বাড়ির লোক। গাড়ি ফিরে গিয়েছে, এলাকার আশাদিদিকে শো-কজ় করেছেন স্বাস্থ্য কর্তারা।
বিপদ ঘরে-বাইরে। জটলা করতে বারণ করায় কোঝিকোডিতে আশাকর্মীর স্কুটারের চাকার হাওয়া খুলে দিয়েছে ছেলেরা। আর দক্ষিণ ২৪ পরগনার রায়দিঘিতে ভিড় দেখে সরে যেতে বলায় স্থানীয়রা মারধর করেছে আশাকর্মীকে। তিরুঅনন্তপুরমে বাড়িতে ঢুকে প্রহার করা হয়েছে আশাকে, পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরায় মারধর করে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছে জায়েরা। কেরলে স্বাস্থ্য পরিদর্শকদের সংগঠন জানিয়েছে, প্রতিটি জেলা থেকে আশাকর্মীদের নিগ্রহের খবর এসেছে। একই চিত্র বাংলায়, বলছে পশ্চিমবঙ্গ আশাকর্মী ইউনিয়ন।
দেশের দুই দিকে দু’টি রাজ্য, একটি রাজ্য অতিমারি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বে অভিনন্দিত, অন্যটি ‘উদ্বেগজনক’ রাজ্যদের তালিকায় একাধিক বার স্থান পেয়েছে। কিন্তু দুটো রাজ্যই করোনা-মোকাবিলায় পাঠিয়েছে মাস্কহীন মেয়েদের। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের এক আশাকর্মীর কথায়, “প্রথম এক মাস কিছুই দেওয়া হয়নি। তার পরে একটা ক্লাব একটা করে মাস্ক দিয়েছিল। স্যানিটাইজ়ার একটা ১০০ মিলি শিশি একবার দেওয়া হয়েছিল। আর দুটো টুপি— একটা এপ্রিল, একটা মে মাসে। আর একটা দিয়েছে, সেটা না ওড়না, না বেডশিট বুঝিনি, রাখা রয়েছে।” করোনা যোদ্ধার ‘সম্মান’-এ ওই চাদর দান করেছে রাজ্য সরকার। কিছু আশাকর্মী ওটাকে ‘পিপিই’ বলে গায়ে জড়িয়েছেন। অনেকে ইউজ়-অ্যান্ড-থ্রো মাস্ক কেচে ব্যবহার করছেন। একশো মিলি স্যানিটাইজ়ারে দু’মাস চালাতে হবে, জেনে কেউ দিনের শেষে সাবানে হাত ধুয়েছেন, কেউ নিজের খরচে মাস্ক-গ্লাভস কিনেছেন। কেরলে আশাকর্মীরা জানালেন, তাতে খরচ হয়েছে সপ্তাহে ১০০-২৫০ টাকা। আশ্চর্য এই যে, দু’রাজ্যেই বাম প্রভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যথেষ্ট সংগঠিত, কিন্তু আশাদের জন্য একটি পয়সাও বার করেনি অধিকাংশ পঞ্চায়েত। কতই বা খরচ হত মাস্ক কিনলে? অভাবটা হয়তো টাকার নয়।
রাষ্ট্র সর্বাধিক নিষ্ঠুর কোভিড-পরীক্ষা থেকে বঞ্চনায়। “পঞ্চায়েতে সোয়াব টেস্ট হল, আমিই সবাইকে নিয়ে এলাম। যখন বললাম আমার টেস্ট করুন, তখন বলল, ব্লক মেডিক্যাল অফিসারের পারমিশন করিয়ে নিয়ে আসুন”, বললেন মালদহের এক আশাকর্মী। এত্তুমানুরের আশাকর্মী রুথ সাবুর নালিশ, কন্টেনমেন্ট জ়োনের আশাকর্মীদেরও পরীক্ষা হয়নি। দু’রাজ্যে ঘোষিত নীতি যা-ই হোক, লকডাউনে আশাদের পরীক্ষা নিয়মিত হয়নি।
এত ঝুঁকি নিয়ে কেন এই কাজ করেন মেয়েরা? উত্তরবঙ্গের এক আশাকর্মী বলছেন, “যখনই কারও বাড়ি ঢুকি, তারা চেয়ার দেয়, জল দেয়, বলে, ‘দিদি কিছু খাবেন?’ তারা আমাদের ছাড়া হাসপাতালে যাবে না। পঞ্চায়েত মেম্বাররাও বলছে, ‘দিদি, আপনারাই আসল হিরো।’ কিন্তু দিনমজুর যে টাকা পায়, তা-ও আমরা পাই না। সে কথা বলি, তাই আমাকে প্রায়ই বলা হচ্ছে, তোমার চাকরি আর বেশি দিন নেই। আমিও বলেছি, দরকার নেই এই চাকরির। কার্যক্ষেত্রে তো কোনও সম্মান আমি পাচ্ছি না। আমার হাজ়ব্যান্ডও এ রকম ভাবে কথা বলেন না, যা আমাকে কাজের জায়গায় শুনতে হচ্ছে।”
এপ্রিল থেকে জুলাই, এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে আশাকর্মীদের কাজ বহুগুণ বেড়েছে, কিন্তু রোজগার কমেছে। এ রাজ্যে আশাকর্মীরা ৩৫০০ সরকারি অনুদান পান, বাকিটা ‘পারফর্ম্যান্স ইনসেন্টিভ’— কাজের উপর কমিশন; টিকাপ্রদান, প্রসূতির চেক-আপ, মিটিং করা প্রভৃতির ভিত্তিতে। লকডাউনে সে সব কাজ স্থগিত, তাই টাকাও আসেনি। কেন্দ্রের বাড়তি অনুদান (মাসে হাজার টাকা) পেয়েও রোজগার আগের অঙ্ক ছোঁয়নি। লকডাউনে মাসিক সাড়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা হাতে এসেছে বাংলার আশাদের। যেখানে রাজ্যেরই বিধি, এক জন দক্ষ কর্মীর ন্যূনতম পারিশ্রমিক মাসে অন্তত ৯,১৮৮ টাকা। কেরলে তা ন্যূনতম ১১,৭০৮ টাকা, আশাকর্মীরা হাতে সাত-আট হাজার টাকা পান।
আশাকর্মী, পুরস্বাস্থ্য কর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি বা মিড-ডে মিল কর্মী, সরকার এঁদের জন্য কাজের যে মডেল তৈরি করেছে, তা দাঁড়িয়ে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের মডেলের উপর। যেখানে অপরিমিত কাজ, আর নিয়ত জবাবদিহি করে করে মেয়েরা জেরবার। কিন্তু তাঁদের না আছে মর্যাদা, না আছে স্বাস্থ্য বা রোজগারের সুরক্ষা। বারো ঘণ্টার বাধ্যতামূলক কাজকেও স্বচ্ছন্দে ‘স্বেচ্ছাশ্রম’ বলে রাষ্ট্র। কর্তারা শো-কজ় নোটিস ধরান, মাইনে কাটেন, ছুটির আবেদন খারিজ করেন, কিন্তু ন্যূনতম মজুরি চাইলে বলেন, “না পোষায় ছেড়ে দাও।”
তা-ই দিচ্ছে। লকডাউন-উত্তর ভারতে রোজগেরে মেয়ে মাত্র ৯ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে যখন এই হার নেমেছিল তেইশ শতাংশে, তা নিয়ে হইচই পড়েছিল। কিন্তু ৯ শতাংশ এমনই অবিশ্বাস্য এক সংখ্যা, সমাজ-সংসারে তার প্রভাব হবে এমনই মারাত্মক যে, আজ কেউ মুখ খুলতেও সাহস করছেন না। শ্রমের বাজার থেকে মেয়েদের দ্রুত অন্তর্ধানের একটা কারণ, গ্রামে মেয়ে-মজুরদের কাজ কমছে। সেই সঙ্গে এ-ও দেখা যাচ্ছে যে, মেয়েদের শিক্ষা বাড়লেও শিক্ষিত মেয়েরা আসছেন না কাজে। কেন আসবেন? কর্মক্ষেত্র তাঁকে সম্মান বা সাম্মানিক, কোনটা দিচ্ছে? কোন আশাকর্মীর কিশোরী কন্যা লকডাউনে মায়ের হয়রানি দেখার পরে ‘আশা’ হওয়ার স্বপ্ন দেখবে?
ন’লক্ষ আশাকর্মী ভারতের এক বৃহৎ নারী শ্রমশক্তি। তার কর্মকুশলতা, দায়িত্ববোধ, তৎপরতা আশাকর্মী প্রমাণ করেছে প্রসূতিমৃত্যু, শিশুমৃত্যু রুখে দিয়ে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, নিপা, কোভিড, প্রতিটি বিপর্যয়ে রাষ্ট্রের ভরসা আশা।
রাষ্ট্র তাকে কোন ভরসা দিচ্ছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy