আব্বার জানাজায় আমার স্বামীও অংশ নেন। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে কবরে মাটি দিতে কেউ বাধা দেয়নি।
গয়নার বিজ্ঞাপনটি নিয়ে এত হইচই কেন? একটি মুসলমান পরিবার হিন্দু পুত্রবধুর সাধের অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে... মেয়েটি প্রশ্ন করছে, এ রকম আচার তো মুসলমান পরিবারে নেই... শাশুড়ি মা বলছেন, এটা তাঁরা করছেন তাঁদের মেয়ের খুশির জন্য, সে শুধু এই পরিবারের পুত্রবধু নয়, মেয়েও বটে। এই রকম একটা স্বাভাবিক ঘটনার মধ্যে কিছু মানুষ ‘লভ জিহাদ’ দেখে ফেলছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্তর বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। সংস্থাকে বয়কট করার হাঁক দিয়েছেন। শো-রুমে ভাঙচুর করেছেন। ফলে সংস্থাটি এই বিজ্ঞাপন তুলে নিতে বাধ্য হল। কিন্তু তাঁরা এখানে কোথায় লভ জিহাদকে দেখলেন সেটাই আশ্চর্যের। কখনও কি দেখা যায়, হিন্দু-মুসলমান বিয়ে অর্থাৎ আন্তর্ধর্মীয় বিয়ে প্রেমের বিয়ে নয়, সেটা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ? তা হলে একজন কি এই ভেবে ভালবেসে বিয়ে করে যে, তার কমিউনিটিতে একজন হিন্দুকে মুসলমান করা গেল বা একজন মুসলমানকে হিন্দু? তা হলে লভ জিহাদের প্রসঙ্গ আসে কোথা থেকে! অন্যের বিশ্বাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন কিংবা ব্যক্তিগত পরিসরে পরস্পরের আনন্দকে ভাগ করে নেওয়া কি জিহাদ?
এই ধরনের আগ্রাসন আসলে মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া পাওয়াগুলোকে বন্ধ করতে চায়। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে যে কোনও রকম সুস্থ চিন্তাকে ব্যাহত করতে চায়। যাঁরা আজ লভ জিহাদের প্রসঙ্গ তুলছেন, তাঁরা কি কখনও এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন? যাননি নিশ্চয়। গেলে এই বিশেষ টার্মটির জন্ম দিতে পারতেন না। কিন্তু যাঁরা গিয়েছেন, আমার মতো অংশীদার হয়েছেন আন্তর্ধর্মীয় বিয়ের, তাঁরা কি একই সুরে সুর মেলাতে পারেন? খানিকটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি তুলে ধরতে চাই।
আমি বিয়ে করেছি কুলীন হিন্দু ব্রাহ্মণকে। শুধু তাই নয়, আমার স্বামী (‘স্বামী’ শব্দটি খুবই অপছন্দের, তবু এখানে ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছি কোনও যুত্সই প্রতিশব্দ পাচ্ছি না বলে) হিন্দু শাক্ত ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ। আমার বিয়ে যাবতীয় হিন্দু আচার মেনে হয়েছিল। যেহেতু এই বিয়েতে আমার বাড়ির অংশগ্রহণ ছিল না, তাই শুধুই হিন্দুমতে বিয়ে হয়েছিল। তা হলে কি এটা কোনও হিন্দু আগ্রাসন?
আরও পড়ুন: থামছে না বিজ্ঞাপন বিতর্ক, এ বার গয়না সংস্থার স্টোরেই হামলা
এ ধরনের বিয়েতে অনেক সময়েই অভিভাবক পরিবার পরিজনদের দিক থেকে বাধা আসে। সেটা আন্তর্ধর্মীয় না হলেও আসে। সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক সুধীর কাকর তাঁর এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, প্রেমজ বিয়ে মানেই সেটা বিদ্রোহ। পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সমাজের অনেক বছর ধরে তৈরি করা সম্বন্ধ বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। আমার পরিবার থেকেও এই কারণেই বাধা এসেছিল। তার বেশির ভাগটাই ছিল লোকে কী বলবে— এই চিন্তা থেকে। নিজেদের হয়তো এ সব নিয়ে মানসিক কোনও বাধা নেই, কিন্ত সমাজের কথা ভেবে অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেন না। মুসলিম ছেলের হিন্দু মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে— বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের বা ধর্মান্তরণের একটা উপায় আছে । তাই এই বিষয়টা ঘটে থাকে বেশি। সবাই যে ধর্মান্তরিত হন, সে কথা বলছি না। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্ত হিন্দু কেবলমাত্র জন্মসূত্রেই হওয়া সম্ভব, তাই হিন্দু ছেলের সঙ্গে মুসলিম মেয়ের বিয়ে ব্যাপারটা এ ক্ষেত্রে একটু বেশি জটিল অর্থাৎ বিয়ের সূত্রে হিন্দু হওয়াটা খুব একটা ‘সহজ’ নয়। আর্যসমাজি শুদ্ধি প্রক্রিয়া কি বাঙালি সমাজে অনুসৃত হয়? আমার জানা নেই।
আমার বিয়ের পর হিন্দু পরিবারে থাকা, সর্বোপরি হিন্দু পাড়ায় থাকা নিয়ে কোনও রকম অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি। আজও পাড়ার লোকজন যথেষ্ট আন্তরিক । কখনও মনে হয় না , মুসলমান পাড়ায় থাকলে একটু ভাল থাকতাম। কখনও মনেই আসে না , এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমার ধর্মীয় কোনও বিভেদ আছে। কিছু মানুষ তো থাকেই যারা অন্যের মুখ ম্লান করে দিয়েই স্বস্তি পায়, তাদের কোনও জাত-ধর্ম হয় না। তাই বলে কি অন্য সমস্যা নেই? অবশ্যই আছে । একটি মেয়েকে অন্য পরিবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যে রক্ত ঝরাতে হয়, যে সংগ্রাম করতে হয় সেই সমস্যগুলো আছে। কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই ।
আমাদের মেয়ে যখন জন্মাল, এই বাড়িতে মুখেভাত বা অন্নপ্রাশন হয়েছিল। আমার পরিবারের তরফেও ততদিনে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। আব্বা আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে মেয়ের ‘আকিকা’ দেন। মুসলমান পরিবারে আকিকা একটি অতি আবশ্যিক নামকরণ অনুষ্ঠান, যেটা প্রত্যেকের দিতে হয়। আমরা ছোটবেলায় শিখেছিলাম ‘আকিকা’ আল্লাহের খাতায় নাম লেখানোর অনুষ্ঠান। সেটা আমার মেয়ের দেওয়া হয়েছে এবং সেটা বারিধারা মুখোপাধ্যায় নামেই। তাতে আমার স্বামীর কোনও অমত ছিল না, বরং কোনও ইসলামিক নাম দিতে হবে কিনা উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন। ‘রুবাই’ নামও রেখেছিলেন, কিন্ত আব্বা তাতে উৎসাহ দেখাননি। বারিধারা নামেই আকিকা হয়।
আমার আব্বার জানাজায় প্রায় সাত-আটশো লোক জমায়েত হয়েছিল। আমার স্বামীও সেখানে অংশ নেন স্বেচ্ছায়, কেউ বাধ্য করেননি। একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে কবরে মাটি দিতেও বাধা দেওয়া হয়নি। তিনি তাঁর মতো নমস্কার করে আব্বাকে শেষ বিদায় জানান। আবার আমার শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পর আমি অশৌচ পালন করেছি। এক কাপড়ে থাকা, হবিষ্যি খাওয়া, নখ না কাটা, তেল না মাখা, চুলে চিরুনি না দেওয়া— যাবতীয় আচার পালন করেছি। ঘাটকাজ থেকে মৎস্যমুখ সব নিয়ম মেনে করেছি। কেউ আমাকে বাধ্য করেনি এগুলো করতে। এগুলোর মধ্যে দিয়ে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার যে সুখ আছে, তা ধর্ম দিয়ে দেখলে বোঝানো সম্ভব নয়। পারস্পরিক সম্পর্ক আর বিশ্বাসের প্রতি সম্মানবোধ এগুলো। একজনের বিশ্বাসের সঙ্গে আর একজনের বিশ্বাস মিশে যায়। তাই একজন প্রকৃত অর্থেই অন্য ধর্মে বিশ্বাসী মানুষের সঙ্গে জীবন কাটাতে অসুবিধে হয় না। মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু পরিবারের খাওয়াদাওয়া চালচলন পোশাক রীতিরেওয়াজে মুসলমান মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের তেমন কিছু পার্থক্য নেই। আর যেটুকু পার্থক্য, সেটা তো দুটো হিন্দু পরিবার বা দুটো মুসলমান পরিবারের মধ্যেও থাকে। তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দৈনন্দিন জীবনযাপনে দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের একসঙ্গে বাস করতে কোনও অসুবিধে নেই, অন্তত ধর্ম কোনও বাধা হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে হয় না। একে অন্যের ধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার খেলা এখানে চলে না। জিহাদ এখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
এ প্রসঙ্গে আরও দু’জনের কথা বলি, আমার মাস্টারমশাই মনিরুজ্জামান চৌধুরী। উনি হিন্দু মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন ঠাকুর পুজো করতেন তাঁর স্ত্রী। আমি মাস্টারমশাইকে হিন্দুই ভাবতাম, উনি মনি চৌধুরী নামেই এলাকায় পরিচিত। পুরো নাম বলতেন না। তা হলে কি এটা হিন্দু আগ্রাসন? আমার চাচাতো ভাই বিয়ে করেছেন হিন্দু মহিলাকে। তাঁকে ইসলাম ধর্ম নিতে হয়েছে । কিন্ত মজার ব্যাপার হল, সেই চাচার বাড়ি গেলে মনে হয় কোনও হিন্দু বাঙালি বাড়িতে ঢুকে পড়েছি। কথাবার্তা সম্বোধনগুলি সবই হিন্দু বাঙালির। আমি একবার রমজান মাস নিয়ে এক লেখায় বলেছিলাম, আমার মা এসে এই হিন্দু বাড়িতে পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েন যেখানে আমার শাশুড়িও ঠাকুর পুজো দেন দু-বেলা। তাতে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝেঁপে এসেছিলেন, উল্টোটা কি হয়? হ্যাঁ হয়। উল্টোটাও হয়। দু’টি পরিবারে যখন বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি হয়, তখন সেখানে হিন্দু-মুসলমান থাকে না, আত্মীয় হয়ে যায়। তাই এইসব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের রাজনীতি অবান্তর মনে হয়।
আরও পড়ুন: বিদ্বেষের বিষে অকালে মৃত উৎসবের বিজ্ঞাপনে ধর্মীয় ঐক্যের ছবি
এ প্রসঙ্গে আরও একজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি সাহিত্যিক শাহজাদ ফিরদৌসের স্ত্রী শ্রাবণী রায়। পেশায় স্কুলশিক্ষক। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, এই বিজ্ঞাপন দেখার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া কী, তাতে উনি বলেন যে, এমনটাই তো হওয়ার কথা। ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ । এই দেশে এমন ভাবেই তো সব ধর্মের মানুষ মিলে মিশে থাকবে। হিন্দু মুসলমান খ্রিষ্টান জৈন সবাই একে অপরের আপনজন হয়ে আমরা বাঁচব। বৈবাহিক সম্পর্ক যখন দু’টি আলাদা ধর্মের মানুষের মধ্যে ঘটে তখন কোনও পরিবারই সেটা মেনে নিতে পারে না। এখানে হিন্দু-মুসলমানের থেকে বড় বিষয় নিজের পছন্দে বিয়ে। সেটা বেশিরভাগ পরিবারই মেনে নিতে চায় না। কিছুটা সময় পেরলে দুই পরিবারের মধ্যে একটা মেলবন্ধন আর আত্মীয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়। যখন দেখে, মানুষটাই গুরুত্বপূর্ণ। সে আমাদেরই মতো আর একজন। প্রাত্যহিক দিনযাপন আর জীবন কাটানোর জন্য ধর্ম কখনও বাধা হতে পারে না। তখন তারাই পাশে এসে দাঁড়ায়। বাকি সব প্রতিবন্ধকতা চাপা পড়ে যায়।
শ্রাবণীও মুসলমান পরিবারে এসে বা মুসলমান আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে কাটাতে কোনও রকম অসুবিধার মুখোমুখি হননি। আবার প্রথম দিকে শ্রাবণীর পরিবারের আপত্তি থাকলেও শাহজাদ সেই পরিবারের প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন। শ্রাবণী আশাবাদী। তিনি আশা রাখেন, মানুষ একদিন এইসব ধর্মান্ধতা, ভেদাভেদ পেরিয়ে একে অপরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বসবাস করবে। এ সবের অনেক ঊর্ধ্বে উঠে ভাবতে শিখবে। তার জন্য আমাদের আওয়াজ তোলা বা বোঝানো দরকার। ধর্মের রাজনীতিকে বর্জন করা প্রয়োজন। প্রশ্ন করেছিলাম, মুসলমান চৌহদ্দিতে কখনও কি কোনও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়? তিনি জানান, এমন কোনও অনুভূতি তাঁর কখনও হয়নি। মুসলমান পরিমণ্ডলে তিনি নিজেকে নিরাপদই অনুভব করে এসেছেন সব সময়। তাঁর গ্রামে প্রথম তিনিই অন্য ধর্মে বিয়ে করেন। কিন্ত পরবর্তী সময়ে তাঁকে অনুসরণ করে অনেকেই করছেন। তাই তিনি আশাবাদী, একদিন এইসব ভেদাভেদ উঠে যাবে, যাবেই।
সে হিসেবে দেখলে বিজ্ঞাপনটি বহুমাত্রিক। অনেক না-বলা কথাকে সে বলছে। গয়নার বিজ্ঞাপন হয়েও যেন শুধু গয়নার নয় তা। আমাদের গায়ে গয়নার মতো আলগা বসে থাকা ধর্ম-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সে আরও কিছু বলতে চাইছে। ভারি যত্নে বানানো বিজ্ঞাপন। দেখলে মন ভাল হয়ে যায়। সংস্থা তুলে নিল বটে। কিন্তু ফেসবুকে, টুইটারে, ইনস্টায় সেই বিজ্ঞাপন এখন ভাইরাল। পুত্রবধূকে ‘বেটি’ সম্বোধন করে তার বাপের বাড়ির রেওয়াজকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার মধ্যেকার গরজটাকে দেখতে পেয়েছেন বেশির ভাগ মানুষ। সংস্থা তুলে নিতে পারে, মানুষ মন থেকে যে তাকে মুছে দিচ্ছে না, তার প্রমাণ এই মুহূর্তে সর্বত্র।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
(লেখক আত্মকথার একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy