Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
অধিকার চাই একুশের
Marriage at 18

আঠারোয় বিয়ে হয়ে যাওয়াটা কোনও ভাবেই মঙ্গলজনক নয়

তবে সে জন্য প্রথমেই দরকার মেয়েদের এবং অভিভাবকদের বোঝানো (কাউন্সেলিং)।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২১ ০২:৩০
Share: Save:

একটা বন্ধ ঘড়িও যেমন দিনে অন্তত দু’বার ঠিক সময় দেখায়, আদ্যন্ত ভুলভাল কাজ করে যাওয়া একটা সরকারও তেমনই কখনও একটা ঠিক কাজ করে ফেলতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করার প্রস্তাবটা শুনে এমনই মনে হয়েছিল। অথচ ঘোষণাটির পর থেকেই সমাজকর্মী এমনকি নারীবাদীদের তরফ থেকেও বিরুদ্ধ কথাবার্তাই এত বেশি শুনতে পাচ্ছি যে, বেশ অবাকই লাগছে। সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। কিন্তু কথাগুলো তো সরাসরি আইনটির বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। তাই যদিও বিষয়টা ঠিক তর্কে জিতে যাওয়ার মতো নয়, তবুও আলোচনাটা শুরু করতে হচ্ছে বিরোধীদেরই যুক্তি থেকে।

বিরোধীদের আপত্তি মূলত তিনটি। প্রথমত, মেয়েদের শিক্ষা, নিরাপত্তা ও স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার ব্যবস্থা না করে ‘শুধু’ বিয়ের বয়সটা বাড়িয়ে দিয়ে লাভ নেই। দ্বিতীয়ত, ‘শুধু’ আইন করে কিছু হবে না, বরং এই আইন চালু হলে তার ফাঁক দিয়ে নানা কুকর্ম (অপহরণের মিথ্যা অভিযোগ, মেয়ে পাচার) বাড়বে। তৃতীয়ত, গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র অবিবাহিত মেয়েদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবে? আশঙ্কাগুলো মিথ্যে নয়। কিন্তু, আমি ভাবছিলাম এর মধ্যে ‘শুধু’ কথাটা কোত্থেকে এল! শুধু আইনই হবে আর তার সহযোগী ব্যবস্থাগুলো গড়ে তোলা হবে না— তা কেন ধরে নেওয়া হচ্ছে? আর যত দিন না সেই ‘যথেষ্ট ব্যবস্থা’ হচ্ছে, তত দিন আমরা মেয়েদের জন্য কী সমাধান ভেবে রাখলাম? এক কথায় ‘বিয়ে দিয়ে দেওয়া’! মেয়েদের পড়াশোনা, স্বাবলম্বন, নিরাপত্তা সবের সমতুল্য বা উন্নততর বিকল্প হল বিয়ে। এই ব্যবস্থা যে শুধু গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য বা যারা তেমন পড়াশোনা বা চাকরি করবে না তেমন মেয়েদের জন্য, এমনও নয়। শহরাঞ্চলের সচ্ছল পরিবারেও সুন্দরী আদরের কন্যাটি আঠারো পেরোলেই অভিভাবকের মাথায় বিয়ের চিন্তা ঘোরাফেরা করে। তেমন পাত্র পেয়ে গেলে কলেজপড়ুয়া মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেওয়া এখনও খুবই সহজ। মেয়েদের বিয়ে মানেই নিরাপত্তার যে ‘কাল্পনিক’ ধারণা, তার আজও কোনও বিকল্প নেই।

কিন্তু সদ্য আঠারো পেরোনো যে মেয়েদের কাছে বাড়িটা রাতারাতি ‘বাপের বাড়ি’ হয়ে যায়, তারা কি সত্যিই নিরাপত্তা পায়? গত কয়েক বছরে যত মেয়ে বিয়ের মাস কয়েকেই ‘বডি’ হয়ে গিয়েছে তাদের অনেকেই কুড়ির নীচে। অর্থাৎ বয়সে, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে পিছিয়ে থাকা মেয়েদের পক্ষে শ্বশুরবাড়ি আদৌ নিরাপদ জায়গা নয়। তা হলে নিরাপত্তা মানে কি তাদের শুধু বাইরের দিক থেকে বাঁচানো? কারণ যারা বেঁচে থাকে, তারাও শ্বশুরবাড়িতে কতখানি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং কত রকমের শারীরিক ও মানসিক অবহেলা-নির্যাতনের শিকার হতে পারে তার হিসেব তো আমাদের অজানা নয়। অর্থাৎ মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া বিষয়টা অভিভাবকের তরফে প্রকৃতই একটা (কন্যা)দায় সেরে ফেলার মতো হয়ে দাঁড়ায়, যার দায় শেষে মেয়েটিকেই নিতে হয়। একুশ পেরিয়ে বিয়ে হলেই যে এই মেয়েরা সবাই স্বয়ম্ভরা হয়ে উঠত বা বেঁচেবর্তে থাকত এমন নয়, কিন্তু নিজের জীবনটা কিছুটা গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ তো তাকে দেওয়া যেত!

বিয়ের বয়স বাড়াবার বিরুদ্ধে যাঁরা কথা বলছেন তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু অষ্টম-নবম শ্রেণির কিশোরীও রয়েছে। যার মানে হল এই মেয়েরাও বিয়ের বাইরে কিছু ভাবতেই পারছে না, যেটা সত্যিই চিন্তার বিষয়। এর একটা কারণ হল মেয়েরা এই কথা শুনতে শুনতেই বড় হয় যে, পড়াশোনা ভাল না হলে বিয়ে হয়ে যাবে, ব্যস! তাদের চোখে একটা ভুল ছবি আঁকা থাকে যে, বিয়ে মানে একটা উৎসব, আনন্দ, হাসিখুশি নিরাপত্তাময় নতুন জীবন। আশ্রয় করার মতো অন্য কোনও ছবি তাদের সামনে থাকে না। তাই আঠারো হলেই তো বিয়ে, এই ভেবে কিছু কিশোরী ছলেবলে পনেরো-ষোলো থেকেই পড়াশোনার পাট তুলে রূপচর্চা আর ঘরকন্নায় মন দেয়। তাদের মতামত জানতে চাইলে তারা আঠারোতে বিয়ের পক্ষেই মত দেবে। আর তাদের বাবা-মাও মেয়েকে সামলে রাখা ‘কঠিন’ বলে সহজতর সমাধান হিসেবে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেন। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমাধানটা অনেক সময়ই মঙ্গলজনক হয় না। আবার বাবার অসুস্থতা, চাকরি থাকা না থাকা, ভাল পাত্র পেয়ে যাওয়া বা সমবয়সিদের বিয়ে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা যুক্তিতে মেধাবী মেয়েটিরও বিয়ে দেওয়া হয় এই ভরসায় যে, সে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পড়াশোনা করবে। সে ভরসা বেশির ভাগ সময় টেকে না। কারণ মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে হয়ে যাওয়া এমন এক পরিণতি, যার পর মেয়েটি সংসার ছাড়া আর কী করল না করল সেটা গৌণ হয়ে যায়।

মোট কথা সমস্যার সমাধান হিসেবে মেয়ের বিয়ে সমাজের চালু অসুখ। ঘরের মেয়েরা তারই শিকার। যে মেয়েটি পড়াশোনা বা অন্য কিছু বিশেষ শেখেনি, বয়সে (মানে অভিজ্ঞতায়) কিশোরীমাত্র, তার ফেরার রাস্তাই থাকে না। ফলে, কখনও কখনও শ্বশুরবাড়িতে অত্যাচার-অপমান মুখ বুজে সয়ে যাওয়া বা স্রেফ মরে যাওয়াই পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়।

সমাজের নিয়ম এক দিনে গড়েনি, এক দিনে বদলাবেও না। কিন্তু যে কোনও বদলের শুরু আইন দিয়েই হয়, তার কিছু অপপ্রয়োগও হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে সুফলও মেলে। সুতরাং, মেয়েকে ‘বসিয়ে না রেখে’ বিয়ে দিয়ে দাও— এই মানসিকতার বদল আনতে সর্বাগ্রে তার বিয়েটাকেই পিছোতে হবে। সরকারি ঘোষণায় লিঙ্গসাম্যের কথা বলা হয়েছে। ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১। তাই সহজ হিসেবেই মেয়েদেরও ২১-ই হওয়া উচিত। তবে ‘শুধুই বিয়ের বয়স বাড়ানো’ নয়, এই প্রবণতাকে বদলাতে আরও কিছু চিন্তাভাবনা জরুরি। যেমন, যে মেয়ে পড়াশোনা করল না, তারও কিছু না কিছু শিক্ষার ব্যবস্থা চাই। হাতের কাজ, সেলাই, কম্পিউটার, কনে সাজানো, মোবাইল সারানো, মশলার ব্যবসা— সে যা-ই হোক। কিন্তু বিয়েই যদি হয়ে যায় তবে মেয়েরা সেগুলোর সুবিধে ভোগ করবে কী করে? বরং এখনই বিয়ে দেওয়া যাবে না জানলে বাবা-মা তাদের বসিয়ে না রেখে কাজ শেখাতে আগ্রহী হবেন। সব মেয়েই বিরাট রোজগার শুরু না করলেও শিক্ষাটা তার ভিতরে থেকে যাবে। কিছুটা আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা তৈরি হবে; যা ভবিষ্যতে কাজে দেবে।

সাবালকত্ব, ভোটাধিকার, যৌনতার অধিকার সব কিছুর থেকেই বিয়ে মূলগত ভাবে আলাদা। তা শুধু অধিকার নয়, যৌথ দায়িত্বও; তাই অন্য কিছুর সঙ্গে বিয়েকে গুলিয়ে ফেলা অর্থহীন। ১৮ থেকে ২১, উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতক হওয়া তো শুধুই জীবনের তিনটে বছর নয়, পরিণত হয়ে ওঠার দিকে বেশ কয়েক পা। বিয়ে মানেও কেবলই যৌনতায় সম্মতি নয় (প্রয়োজনে অসম্মতিও বটে!), সংসার-সন্তানের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত হওয়া। পড়াশোনা করুক না করুক— কিছু শেখার জন্য, ভালমন্দ বোধ ও মতামত গড়ে ওঠার জন্য, স্বামী-স্ত্রীর বয়সের পার্থক্য কমানোর জন্য, এমনকি শরীরে পরিণত হয়ে ওঠার জন্যও আঠারো বছর যথেষ্ট নয়। আঠারোয় বিয়ে হয়ে উনিশে সন্তানকোলে ক্লিষ্ট কিশোরী আর তার অপুষ্ট শিশুকে দেখেও কি বুঝব না যে, কেন মেয়েটিকে একটু সময় দেওয়া দরকার ছিল!

তবে সে জন্য প্রথমেই দরকার মেয়েদের এবং অভিভাবকদের বোঝানো (কাউন্সেলিং)। স্কুলে স্কুলে গিয়ে কিশোরীদের মনের কথা শোনা, যে উদ্যোগ মাঝখানে করা হয়েছিল। আর ক্রমাগত বোঝাতেই হবে— নিজেকে সামলে রাখো, বিয়ে-সাজগোজ-সন্তান সবই হবে। তবে আগে নিজেকে কোনও একটা দিক থেকে তৈরি করো। অভিভাবকদেরও বোঝাতে হবে যে, এক রকমের বিপদ থেকে বাঁচাতে মেয়েকে সারা জীবনের বিপদের দিকে ঠেলে দেবেন না। কিন্তু তার আগে আমাদের নিজেদেরই বুঝতে হবে যে, আঠারো বছরে বিয়ে হয়ে যাওয়াটা মেয়েদের পক্ষে কখনওই মঙ্গলজনক নয়।

আমরা, শহুরে ‘ক্রিমি লেয়ার’ (একেবারে উপরতলা)-এর বাসিন্দারা মুখে যা-ই বলি আঠারোয় বিয়ে হওয়া মেয়েদের মুখে নিজের মেয়ের মুখ দেখতে পাই না, তাই বিষয়টাকে ‘ওদের’ মতো করে ভাবি। তাই আঠারোয় বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়েদের প্রত্যক্ষ সমস্যার কথা গৌণ হয়ে যায় পরোক্ষ সমস্যার কাছে। আইনরক্ষা করতে পারব না বলে আইনটাকেই বাধা দিচ্ছি আর সব জেনেশুনেও মেয়েদের নিরাপত্তা, অধিকার ইত্যাদির প্রশ্ন তুলে নিজেদের আসল দায়িত্ব ভুলে থাকছি। না হলে মেয়েদের বিয়ের বয়স একুশ করা হোক এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও করা হোক— স্পষ্ট করে বলার দায়িত্ব তো আমাদেরই ছিল, তাই না?

পুনশ্চ: ঘনিষ্ঠ এক পরিবারে বৌমা হয়ে এসেছিল অষ্টাদশী। দু’বছর হল, শ্বশুরবাড়িতে কন্যাস্নেহেই দিন কাটছে তার। দেখে আনন্দিত হতে হতেও মনে পড়ে কয়েক বছর আগে আর এক পরিবারের আঠারো পেরোনো সেই মেয়েটিকে। যে বিয়ের বছর দেড়েকের মধ্যে অজানা কারণে আত্মহত্যা করেছিল। এর কি কোনও গড় নেওয়া যায়, বলুন!

সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি

অন্য বিষয়গুলি:

Marriage at 18 Unsafe
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE