যদুনাথ জাত মাস্টারমশাই, পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি একেবারেই সইতে পারতেন না। আবার পড়াশোনা বলতে কলুর বলদের মতো কল্পনাহীন শ্রমকেও মানেননি তিনি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অচলায়তন’ নাটকটি যদুনাথ সরকারকে উৎসর্গ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকটিও তো পড়াশোনার রকমফের নিয়েই। শাস্ত্রবাক্যে জড়বৎ কল্পনাহীন দাগা বুলিয়ে চলা, শিক্ষার সামাজিক অভিমুখকে অস্বীকার করা— এই ভাবেই তো গড়ে ওঠে শিক্ষার অচলায়তন। তখন সামাজিক হিতের জন্যই সেই অচলায়তনটির পাঁচিল ভাঙা চাই। কিন্তু তার পর? তার পর কি যা ইচ্ছে তাই? ফাঁকিবাজি? না। আবার গড়ে তুলতে হয় নতুন পাঁচিল, নতুন ব্যবস্থা। এই নাটকের শেষে গুরু এসে পাঁচিল-ভাঙা-বিপ্লবীদের পাঁচিল তোলার কাজে লাগিয়ে দিলেন। বিপ্লবের কল্পনার সঙ্গে তখন ব্যবস্থাপনা নির্মাণের শ্রম মিলে-মিশে গেল।
পুরাতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘দ্য স্যান্স্ক্রিট বুদ্ধিস্ট লিটারেচর অব নেপাল’ বই থেকে এ নাটকের কাহিনিসূত্র গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রাচীন বৌদ্ধ মঠগুলিতে দু’রকম আলোচনাক্ষেত্র ছিল— একটিতে সকলের প্রবেশাধিকার, অন্যটি বিশিষ্ট মানুষদের চিন্তনক্ষেত্র। একটি মঠের প্রবেশদ্বারে অনুষ্ঠিত হত, অন্যটির আয়োজন মঠের অভ্যন্তরে। প্রবেশদ্বারের সেই বিচার ক্ষেত্রে যে বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হত, তাতে থাকত সকলের কথা বলার অধিকার। সেখানে কেউ কূট, বিশেষ জ্ঞানাত্মক প্রশ্ন উত্থাপন করলে সেই প্রশ্নশীল মানুষটিকে সাদরে নিয়ে যাওয়া হত মঠের অভ্যন্তরে। মঠের ভিতরে সার্বিক-সাধারণ বিষয়-আশয় গুরুত্বপূর্ণ নয়, বিদ্যা-দর্শনের বিশেষ ক্ষেত্রটি সেখানে গুরুত্ব পায়। ক্ষেত্র দু’টি পৃথক কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগহীন ছিল না। বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্রমে ‘অচলায়তন’ হয়ে উঠলে ক্ষেত্র দু’টিকে পাঁচিল তুলে আলাদা করে দেয়— তখন জনসাধারণের সঙ্গে বিশিষ্টদের আর সহজ যোগ থাকে না। এতে দু’পক্ষেরই ক্ষতি। তখন আবার নতুন করে যোগাযোগহীনতার পাঁচিল ভেঙে দুইয়ের মধ্যে যোগসাধনের নব্য ব্যবস্থা নির্মাণ করা চাই।
যদুনাথ— ইতিহাসবিদ ও শিক্ষক যদুনাথ সরকারের জন্মের সার্ধশতবর্ষ শুরু হল এই মাসে। এই সময়ে স্মরণ করা জরুরি, মানুষটি সারা জীবন ধরে সাধারণের সঙ্গে বিশেষের যোগস্থাপনের কেমন অনলস সাধনা করেছেন। কী ভাবে বিদ্যাচর্চাকে একই সঙ্গে বিশেষীকৃত ও সার্বিক এই দুইয়ের সংযোগে পুষ্ট করে তোলা যায়, তা-ই ছিল তাঁর ভাবনার বিষয়। শিক্ষাকে শুধু বিশেষীকৃত করে তুললে এ দেশের মাত্র হাতে-গোনা মানুষ বিদ্যার স্পর্শ পাবেন, সার্বিক করে তুলতে গেলে আয়োজনটি উদার করা প্রয়োজন। আবার, সার্বিকের দোহাই দিয়ে দুধের বদলে পিটুলি-গোলা জল খাওয়ালেও চলবে না। প্রকৃত দুধের গুণগত মান যেন পড়ে না যায়।
গুরুগম্ভীর যদুনাথ বিশেষীকৃত বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে কতটা দৃঢ়চিত্ত ও শ্রমনিষ্ঠ, তার প্রমাণ নানা লেখায় ছড়িয়ে আছে। ইতিহাস লেখার জন্য কী ভাবে নিজেকে তৈরি করছিলেন তিনি? ‘কোনো একজন দিল্লীর বাদশা অথবা মারাঠা রাজার ইতিহাস লিখতে গিয়ে আমাকে প্রথমে দশ বছর ধরে তার উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়েছে; সেগুলি সাজিয়ে, সংশোধন করে, আলোচনা করে, মনের মধ্যে হজম করে, দশ বৎসর পরে ঐ পুস্তকের লেখা আরম্ভ করি, তার আগে নয়। ...এছাড়া ঐ উপকরণসমূহ রীতিমত বুঝবার জন্য আমাকে ফার্সী, মারাঠী ও পর্ত্তুগীজ প্রভৃতি নূতন ভাষা শিখতে হয়।’ ‘আমার জীবনের তন্ত্র’ নামের এই লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। দশ বছর পরে স্বাধীন দেশে কলকাতা বেতারকেন্দ্রে আবার লেখাটি পড়ে শোনান তিনি। সে ১৯৪৮ সাল, ১২ অক্টোবর। হয়তো স্বাধীন দেশের যুবকদের মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ‘যোগসাধনে রত তপস্বীর মতই আমাদের গবেষককে সরল শ্রমসহিষ্ণু জীবন যাপন করতে হবে’। বলেছিলেন ‘জনগণ অশিক্ষিত, অ-সঙ্ঘবদ্ধ’, ফলে দেশে ‘রাজনৈতিক জুয়াচোরের প্রাধান্য’। তারই মাঝে ‘খাঁটি কাজের, জ্ঞানসাধনার, দেশসেবার কঠোর ব্রত’ নিতে হবে। পড়াশোনার মহৎ আদর্শ সবাই তো গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে কি অশিক্ষিত, অ-সঙ্ঘবদ্ধ মানুষকে নিরুপায় ভাবে রাজনৈতিক জুয়াচুরিই মেনে নিতে হবে?
যদুনাথের অপর এক মুখও আছে। তিনি তো কেবল গবেষক নন। মাস্টারমশাই। বিদ্যাবিতরণ তাঁর কাজ। সে বিদ্যাপ্রাঙ্গণে যত বেশি সংখ্যক পড়ুয়াকে আকর্ষণ করা যায় ততই দেশের মঙ্গল। অশিক্ষিত, অ-সঙ্ঘবদ্ধ মানুষকে গড়ে তোলার উপায় নানা ভাবে বিদ্যাবিতরণ। তাতেই দেশের মঙ্গল হবে, রাজনৈতিক জুয়াচুরি বন্ধ হবে। তখন যদুনাথ পটনা কলেজের অধ্যাপক। ছাত্রদের ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্য তিনি পড়াশোনার কাজে মাতৃভাষাকে স্বাগত জানালেন। আয়োজন করলেন ভার্নাকুলার সেমিনারের। কেবল ইংরেজি ইংরেজি করে মাথা খারাপ করলে যে প্রকৃত পড়াশোনা আটকে যেতে পারে তা মানেন। নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায় ‘কনফেশানস অব অ্যা হিস্ট্রি টিচার’ আর ‘দ্য ভার্নাকুলার মিডিয়াম: ভিউজ় অব অ্যান ওল্ড টিচার’ নামের প্রবন্ধ দু’টিতে। বিদ্যা কেবল ‘ভার্নাকুলার’-এর মাধ্যমে কলেজপড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেই হবে না, চাই আরও বেশি আয়োজন। কোনও দেশেই তো সবাই কলেজে পড়তে আসেন না, এ দেশে তখন কলেজপড়ুয়ার সংখ্যা বেশ কম।
‘সাংসারিক লোক ও শ্রমজীবীদিগের অবসরকালীন শিক্ষার জন্য সরল ভাষায় বিশ্ব-বিদ্যা-প্রসারিণী-বক্তৃতা’ করলে কেমন হয়? হোম ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি আর কেমব্রিজ ম্যানুয়ালস অব সায়েন্স অ্যান্ড লিটারেচারের আদর্শে এই বঙ্গদেশে বিশ্ব-বিদ্যা-সংগ্রহ গ্রন্থমালার আয়োজন করা হয়েছিল। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় যদুনাথ সে খবর জানিয়ে নিবন্ধ লিখেছিলেন। ‘বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ’-এর প্রধান সম্পাদক, উপদেষ্টা ও কার্যনির্বাহক রবীন্দ্রনাথ। স্থির হল জ্ঞানচর্চার বিভিন্ন বিষয় সহজে লেখার জন্য দীর্ঘ সমাস, কঠিন সংস্কৃতমূলক শব্দ বাদ দেওয়া হবে। যে সব বিদেশি শব্দ সহজে বাংলায় চলে গিয়েছে সেগুলির বঙ্গানুবাদ করার দরকার নেই। লেখার পর সম্পাদক সংশোধন করতে পারবেন। কপি এডিটিং যাকে বলে। এ যেন জ্ঞানচর্চার যৌথ ক্রিয়া। সকলে মিলেমিশে সাধারণ বাংলা-শিক্ষিত পাঠকের দরবারে জ্ঞান ও তথ্য পৌঁছে দেওয়া চাই।
এ সব পড়তে পড়তে বোঝা যায় যদুনাথের মন আর উদ্যমের দুই দিক। এক দিকে ‘তত্ত্বানুসন্ধান’ অন্য দিকে ‘বিদ্যাবিতরণ’। বিশ্বভারতীতে আচার্য ও অধ্যাপক দুই দলের পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিধুশেখর শাস্ত্রী, ক্ষিতিমোহন সেন এঁরা আচার্য। নেপালচন্দ্র রায়, সন্তোষ মজুমদার এঁরা অধ্যাপক। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘অধ্যাপকদের প্রধান কর্তব্য হবে ছাত্রদের বিশ্বভারতীর জন্য তৈরী করে তোলা; আচার্যদের প্রধান কর্তব্য হবে তত্ত্বানুসন্ধান ও তত্ত্বপ্রচার।’ যদুনাথ কখনও আচার্য, কখনও অধ্যাপক— দুইয়ের মধ্যে যোগটি হারাতে দেন না। যোগটি হারালে দু’পক্ষই দুর্বল হয়ে পড়বেন। তত্ত্বানুসন্ধান ও তত্ত্বপ্রচারে আটকে গেলে অহমিকা আর মুদ্রাদোষ গ্রাস করতে পারে, আর তত্ত্বানুসন্ধানের সঙ্গে সম্পর্কহীন অধ্যাপনা পড়ুয়াদের মনে কেমন করে বৃহৎ-কল্পনা ও জিজ্ঞাসার জন্ম দিতে পারে? এই দু’পক্ষের যোগাযোগহীনতাই তো অচলায়তনের জন্ম দেয়। তাকে ভাঙা চাই। যদুনাথ কাউকে কাউকে গড়েপিটে নেন। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তথ্যনিষ্ঠ গবেষক। কী ভাবে ঘাঁটতে হয় অভিলেখাগার, সাজাতে হয় তথ্য, ব্রজেন্দ্রনাথ তার অনেক কিছুই যদুনাথের কাছ থেকে শিখেছিলেন। সাময়িকপত্রের পাতায় ব্রজেন্দ্রনাথের তথ্যপূর্ণ লেখা সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন পাঠকদের সমৃদ্ধ করত।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যদুনাথের সখ্যে নানা টানাপড়েন। পড়াশোনার পদ্ধতি নিয়ে দু’জনের তর্কবিতর্ক কম হয়নি। যদুনাথ রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরেই ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ-যদুনাথ সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বভারতীর ইংরেজি বিভাগের প্রয়াত মাস্টারমশাই বিকাশ চক্রবর্তীর চমৎকার বই আছে। আর ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী ইতিহাসবিদ্যাচর্চার ভারতীয় অভিমুখ নির্মাণকারী যদুনাথকে নিয়ে বই লিখেছেন। যদুনাথের অধীত বিদ্যা সাহিত্য ও ইতিহাস। ইতিহাস তাঁকে দিয়েছিল তত্ত্বানুসন্ধান-প্রবৃত্তি আর সাহিত্য তাঁকে দিয়েছিল সাধারণের সঙ্গে সংযোগের বাসনা। এই দুইয়ের বুননেই গড়ে উঠেছিল তাঁর মন। সেই মনই তো গড়ে তুলতে পারে সচলায়তন।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy