Advertisement
২০ নভেম্বর ২০২৪

দর্পণে যেমন

গল্পটিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তাঁহার পক্ষে মামলা লড়েন উপন্যাসের ছয় বৎসর বয়সি নায়িকার পিতা (শ্বেতাঙ্গ) অ্যাটিকাস, বহু বাধা সত্ত্বেও। তিনি আদালতে স্পষ্ট করিয়া তুলেন যে অভিযুক্ত নির্দোষ, অভিযোগকারিণী মহিলা ও তাহার পিতার চক্রান্তের শিকার, কিন্তু প্রায় সকল সত্য বুঝিয়াও জুরি কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোককে অপরাধী সাব্যস্ত করেন।

‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ নাটকের একটি দৃশ্য।—ছবি এএফপি।

‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ নাটকের একটি দৃশ্য।—ছবি এএফপি।

শেষ আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

নিউ ইয়র্কে ‘টু কিল আ মকিংবার্ড’ উপন্যাস অবলম্বনে একটি নাটক এক সপ্তাহে ১.৭ মিলিয়ন ডলার আয় করিয়া রেকর্ড গড়িল। কিছু নাটক অধিক আয় করিলেও, সেইগুলি মার্কিন উপন্যাস হইতে নাট্যরূপ পায় নাই। হলিউডি চিত্রনাট্যকার আরন সরকিন এই নাট্যরূপ দিয়াছেন, বিখ্যাত অভিনেতা জেফ ড্যানিয়েলস অভিনয় করিতেছেন অ্যাটিকাস ফিঞ্চ-এর চরিত্রে। উপন্যাসটি ১৯৬০ সালে রচিত ও প্রায় তন্মুহূর্তেই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাইয়া অত্যন্ত বিখ্যাত। বহু দিন ধরিয়াই আমেরিকার বহু বিদ্যালয়ে বইটি পাঠ্য হিসাবে রহিয়াছে, ছাত্রছাত্রীরা যাহাতে বর্ণবিদ্বেষের মানসিকতা হইতে নিজেদের দূরে রাখিতে পারে, যাহাতে অন্য প্রকারের মানুষের প্রতি সহমর্মিতা জন্মায়। গল্পটিতে এক কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তাঁহার পক্ষে মামলা লড়েন উপন্যাসের ছয় বৎসর বয়সি নায়িকার পিতা (শ্বেতাঙ্গ) অ্যাটিকাস, বহু বাধা সত্ত্বেও। তিনি আদালতে স্পষ্ট করিয়া তুলেন যে অভিযুক্ত নির্দোষ, অভিযোগকারিণী মহিলা ও তাহার পিতার চক্রান্তের শিকার, কিন্তু প্রায় সকল সত্য বুঝিয়াও জুরি কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোককে অপরাধী সাব্যস্ত করেন। শিশু নায়িকার বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বাস ভাঙিয়া যায়। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে এই উপন্যাসটি মহান, কিন্তু অকস্মাৎ প্রায় ৫০ বৎসরের পুরাতন সাহিত্য লইয়া নাটক হইল, এবং তাহা সূচনামুহূর্ত হইতেই এই রূপ সফল হইল— কারণ কী? হয়তো এই নাটকটি এখন করিবার কারণ হইল ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার বর্তমান পরিবেশ। যে দেশ বহু মানুষের নিকট কিছু দিন পূর্বেও সহিষ্ণুতার পীঠস্থান বলিয়া প্রতিভাত হইত, সেই দেশ যখন রাষ্ট্রনায়কের প্ররোচনায় বিদ্বেষবিষে জর্জর হয়, যখন সেই দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে আসীন মানুষ মুহুর্মুহু এমন মন্তব্য করিতে থাকেন যাহা সাম্যের বিরোধী, মানবতার পক্ষে অপমানজনক, যখন অমুক জাতিকে চোর তমুক জাতিকে ইতর তকমা দেওয়া হয়, আক্ষরিক অর্থে নিজ দেশকে ঘিরিয়া প্রাচীর তুলিয়া দিবার প্রয়াস লইয়া হুলস্থুল বাধিয়া দেশ ‘রুদ্ধ’ হইয়া যায়, সেই দেশে এই প্রাচীন গ্রন্থটিই বাইবেল হইয়া উঠিতে পারে। মানুষ হয়তো এই ঘৃণার আবহাওয়াকে এতটাই ঘৃণা করেন, মানুষের সহিত মানুষের বিভেদ বুনিবার বৃহৎ যন্ত্রটিকে মনেপ্রাণে এমনই প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁহারা বহুপঠিত ও বহুশ্রুত গল্পটির নাট্যরূপ দেখিতে গিয়া সহনশীলতার পাঠ ঝালাইয়া লইতে উৎসাহী।

কিছু দিন পূর্বেই প্রকাশিত হইয়াছে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত প্রাক্তন ক্রিকেটার মাইক ব্রিয়ারলির নূতন গ্রন্থ ‘অন ক্রিকেট’। তাহাতে এক স্থানে তিনি লিখিতেছেন: অবশ্যই অতিস্পর্শকাতরতা, নিজেকে শিকার ভাবিবার মানসকিতা, অতিসরলীকরণ এবং রাজনৈতিক যথাযথতা হইয়া উঠিতে পারে ঝঞ্ঝাটময় এবং তাহার বিরোধিতারও প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্ণবৈষম্যের সমস্যাটি, সকল না হইলেও অধিকাংশ সমাজেই গভীর এবং সূক্ষ্ম এক অসুখ। ইহার ফলে মানুষ যে আঘাত পান, তাহাকে অত্যন্ত উপেক্ষা করিয়া উড়াইয়া দিলে, তাহা লইয়া আমাদের রাগিয়া উঠা যথার্থ। লঘু ও তরল বর্ণবৈষম্যমূলক মন্তব্যকে তাই অবহেলা করা ঠিক হইবে না। বর্ণবৈষম্যের প্রবণতার ফলে যে ক্ষতি, তাহাকে এক প্রধান সমস্যা হিসাবে ভাবিতে হইবে, এবং নিজেদের ও অন্যদের শ্রেষ্ঠতা বা অধিকারের ধারণাকে প্রশ্ন করিতে হইবে। মাইক ব্রিয়ারলি তাঁহার ক্রীড়াকীর্তির অপেক্ষা তাঁহার অধিনায়কত্বের জন্য বিখ্যাত এবং প্রায় সকল ক্রিকেটচর্চাকারীই তাঁহার ক্রিকেটবুদ্ধির অনুরাগী। কিন্তু এই পুস্তকে তিনি বহু রচনায় বাইশ গজের সীমানা অতিক্রম করিয়া জীবনের ময়দানে তাঁহার ধী ও বীক্ষার পরিচয় দিয়াছেন। হয়তো সমগ্র বিশ্বের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার বাতাবরণের পরিপ্রেক্ষিতে এই দৃষ্টির মূল্য অপরিসীম। বহু ক্ষেত্রেই আমরা খেয়াল করি না, হয়তো আড্ডায় বা বাসে-ট্রামে কেহ অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে, আমরা ঝামেলা এড়াইতে বা প্রিয়জনকে আঘাত না করিবার দায়ে সেইগুলির প্রতিবাদ করি না, স্মিতমুখে থাকি। কিন্তু একটি পাখিকে খেলিতে খেলিতে মারিয়া ফেলিবার প্রকৃত অর্থ যে একটি প্রাণ হরণ, এবং সেই মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিলে তাহা যে ক্রমে গুরুতর পাপে উপনীত হইতে পারে, তাহা সরবে জানাইয়া দেওয়া প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের কর্তব্য। কেবল প্রবন্ধের বই পড়িয়া বা নাটক দেখিয়া হাততালি দিয়া সেই কর্তব্য সারিলে চলিবে না।

যৎকিঞ্চিৎ

সচিন চিতাবাঘ খাঁচা থেকে পালাল, কিন্তু বাইরের জীবনসংগ্রামের ঝক্কি তাকে ফের ঢুকিয়ে দিল খাঁচায়। তার পালানোয় বহু মানুষের ইচ্ছাপূরণ হয়েছিল, যাঁরা কেউ চাকরি, কেউ বিয়ের খাঁচায় আটকে হাঁসফাঁস, কিন্তু পলায়ন-লাফ দিতে পারছেন না। সিনেমায় বচ্চনের ন্যায়, এই চারপেয়ে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে স্বাধীনতার উড়াল নিয়েছিল, কিন্তু নিরাপত্তার লোভ তাকে পরাধীনতার আরামে টেনে আনল। নব বছরে শিক্ষালাভ: ঝুঁকি নিয়ো না, উঁকিতেই তুষ্ট থাকো!

অন্য বিষয়গুলি:

To Kill a Mockingbird Drama Novel Racism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy