কালো বাক্স আর তা থেকে পাওয়া সেই আশ্চর্য বই।
একটি কার্ডবোর্ডের বাক্স। বাক্সে গায়ে বড় করে ইংরেজি বড় হাতের ‘এস’ অক্ষরটি একটি ফুলস্টপ-সহ। বাক্সের গায়ে একটি কাগজের পটি সিলমোহরের কায়দায় লাগানো। সেটির গায়েই লেখকদের নাম। পটি ছিঁড়ে বাক্সের ভিতর থেকে যে বইটিকে বার করে আনা হবে, তার নাম কিন্তু আদৌ ‘এস.’নয়। সেটি বেশ পুরনো একটি হার্ডকভার বই। নাম ‘শিপ অব থেসিয়াস’। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত বইটির লেখক ভি এম স্ট্রাকা। পুরনো পাতাগুলোয় হলদেটে ছোপ। বইটি ‘লাগুনা ভারদে হাইস্কুল লাইব্রেরি’ নামে এক গ্রন্থাগারের বই। বইয়ে লাইব্রেরির স্ট্যাম্প, তার ক্যাটালগিংয়ের লেবেল এবং শেষপাতায় বই ফেরত দেওয়ার তারিখও ঊল্লিখিত।
‘শিপ অব থেসিয়াস’ অন্য কোনও ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত। বইয়ের গোড়ার ভূমিকাটি এফ এক্স ক্যালডেরিয়া নামে কারও লেখা। আখ্যাপত্রের পিছনের পাতায় স্ট্রাকার লেখা ১৮টি বইয়ের নাম উল্লিখিত। ক্যালডেরিয়ার ভূমিকা থেকে জানা যাচ্ছে, স্ট্রাকা সেই সময়ের একঅত্যন্ত খ্যাতনামা লেখক। তাঁর রচনা অতিমাত্রায় অন্তর্ঘাতপূর্ণ, যা যে কোনও সরকারকে ফেলে দিতে পারে। উদ্ধত শিল্পপতিদের মাথা নত করিয়ে দিতে পারে। সমসময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে স্বৈরশাসনের ক্ষেত্রে বিপদ দেকে আনে। ‘শিপ অব থেসিয়াস’-কে স্ট্রাকার ১৯তম এবং শেষ উপন্যাস হিসেবে বর্ণনা করে ভূমিকায় জানানো হয়েছে, ওই উপন্যাস লেখার পরেই স্ট্রাকা রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান।
বইয়ের আখ্যাপত্র: এমন, যেন কোনো লাইব্রেরি থেকে খোয়া যাওয়া। রাবার স্ট্যাম্পটিও নিখুঁত।
ক্যালডেরিয়া জানাচ্ছেন, তাঁর সঙ্গে স্ট্রাকার নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও তিনি তাঁকে কখনও দেখেননি। ‘শিপ অব থেসিয়াস’-এর অন্তিম অধ্যায় ক্যালডেরিয়ার হাতে দেবেন বলে স্ট্রাকা তাঁকে হাভানার একটি হোটেলে দেখা করতে বলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে ক্যালডেরিয়া দেখতে পান, স্ট্রাকার কামরা ছত্রভঙ্গ, পাণ্ডুলিপির পাতাগুলো এলোমেলো অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং পুলিশ একটি মৃতদেহ ট্রাকে তুলছে। জানা যায়নি যে, ওই মৃতদেহটি স্ট্রাকার কি না। এমনও হতে পারে, স্ট্রাকা পুরো ব্যাপারটাই নিজে সাজিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন।
লেখক ডওগ ডোর্স্ট এবং রূপদানকারী জে জে অ্যাব্রামস।
এর পরে উপন্যাস শুরু। গোটা বইয়ের মার্জিনে কেউ কলম বা পেনসিল দিয়ে ক্রমাগত লিখে রেখেছে নোট। অন্য কালিতে সেই নোটগুলির উপরে মন্তব্য। সে সব লেখালেখি থেকে বোঝা যায়, এরিক নামের কোনও আত্মবিড়ম্বিত গ্র্যাজুয়েট ছাত্র স্ট্রাকার জীবন ও সাহিত্য নিয়ে কাজ করছে। দ্বিতীয় হাতের লেখাটি জেন নামের কোনও সিনিয়র ছাত্রীর, যে জীবনের প্রতি যাবতীয় আকর্ষণ হারিয়েছে। বোঝা যায়, বইটি এরিক এবং জেনের মধ্যে ক্রমাগত আদান-প্রদান হয়েছে এবং তারা তাতে নিজেদের মতো করে নোট লিখে গিয়েছে। এই নোট-লিখন ক্রমে পরিণতি পায় স্ট্রাকার প্রকৃত পরিচয় অনুসন্ধান এবং সেই সূত্রে বৃহত্তর কোনও ষড়যন্ত্রের উন্মোচনের চেষ্টায়। সেই কাজে বইটির দুই পাঠক ব্যবহার করতে শুরু করেন খবরের কাগজের কাটিং, পুরনো ফোটোগ্রাফ, পিকচার পোস্টকার্ড, কোনও রেস্তোরাঁর পেপার ন্যাপকিনের উপরে আঁকা মানচিত্র ইত্যাদি।
বইয়ের মার্জিনে দুই পাঠকের নোটস এবং পাতার ভাঁজে পাওয়া পিকচার পোস্টকার্ড।
এই সবকিছুই ‘শিপ অব থেসিয়াস’-এর বিভিন্ন পাতায় গোঁজা রয়েছে।
‘শিপ অব থেসিয়াস’ নামের উপন্যাস, তাতে এরিক ও জেনের লেখা মন্তব্য এবং বিভিন্ন পাতায় গুঁজে রাখা বিভিন্ন বস্তু মিলিয়েই ‘এস.’। কোনওটিকে কোনওটির থেকে বিচ্ছিন্ন করে যাবে না। এই সবকিছু একত্রে চেষ্টা করে স্ট্রাকা নামক এক রহস্যময় ব্যক্তির স্বরূপ উদ্ঘাটনের। এক হিসেবে দেখলে, ‘এস.’ এক রহস্যোপন্যাস। অন্য দিক থেকে দেখলে তা কয়েকজন মানুষের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের এক দার্শনিক অভিযান। পাঠক আগে মুদ্রিত উপন্যাসটি পড়বেন, নাকি উপন্যাসের সঙ্গে সঙ্গে এরিক ও জেনের নোটগুলি পড়তে পড়তে যাবেন, সেই সিদ্ধান্ত তাঁর। তবে তাঁকে পড়তে হবে পুরোটাই। বাদ দেওয়া যাবে না বিভিন্ন পাতায় গুঁজে রাখা বস্তুগুলি।
এভাবেই ‘এস.’ দু’মলাটের চৌহদ্দি ছাপিয়ে পা বাড়ায় অনন্ত পাঠকৃতির দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy