Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Alcohol

মদ্যপানের সে কাল-এ কাল

মদ নিয়ে বাড়াবাড়ির উদাহরণ মহাকাব্যেও রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বড়ভাই বলরামের সুরাপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। ব্রহ্মপুরাণ-এ বলরামের  কদম্ব-জাত সুরাপানের উল্লেখ রয়েছে।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় 
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২০ ০৯:০০
Share: Save:

বন্ধ ছিল মাসাধিক কাল। আর খুলতেই শুরু হয়ে গিয়েছে প্যান্ডিমোনিয়াম। লকডাউনে মদের দোকান খোলা নিয়ে সরগরম মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়া। মিডিয়া তার কাজ করেছে। মদের দোকানের সামনে ঘটমান বর্তমানকে তুলে ধরার প্রয়াস করেছে। কিন্তু দশ কাঠি সরেস সোশ্যাল মিডিয়া বিষয়টাকে নিয়ে গিয়েছে একেবারে এভারেস্ট শীর্ষে। মন্তব্য, অতিকথন, জোকস, মিম— কী নেই নেটাগরিকদের ঝুলিতে! মদের দোকান খোলা— এই খবরটাকে এক্সপ্রেস করতে গিয়ে তাঁরা যেন বলতে চাইলেন ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’। মাসাধিক কাল বন্ধের পরে যেন ‘বাঁধ ভেঙে দাও’-মার্কা সুরে নেমে এল মুক্তধারার জল। লকডাউনের তাপে শুকিয়ে যাওয়া জীবনে যেন করুণাধারার স্পর্শ। মদের দোকানের সামনের সুশৃঙ্খল লাইন থেকে বিশৃঙ্খল ক্যাওস— সবই হয়ে উঠল উপহাসের সামগ্রী। সিরিয়াস নেটাগরিকরা রেশনের অপ্রতুলতার সঙ্গে মদের সুলভতার তুলনা টেনে বিবেক জাগিয়ে তুললেন, সরকারের ‘কাণ্ডজ্ঞান’ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা রাখলেন, সেই সঙ্গে ভর্ৎসৃত হলেন মদের দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিরা। ভর্ৎসনা পেরিয়ে তাঁদের নিয়ে চলতে লাগল ক্রমাগত খিল্লি। মদের দোকান, লাইন, মদ— এ সব যেন সভ্যতার বাইরের কিছু বিষয়। এমন অশৈল কাণ্ড যেন কেউ কখনও দেখেননি।

অথচ ভারতীয় জীবনে মদ নিয়ে বাড়াবাড়ি নতুন কিছু নয়। আগে যখন দোল বা কালীপুজোয় মদের দোকান বন্ধ থাকত, তখন সেই সব উৎসবের আগের দিন দোকানের সামনে লাইনের কথা বাঙালির স্মৃতি থেকে লা-পতা হওয়ার কথা তো নয়! অবশ্য সেই সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। সামূহিক ভর্ৎসনার খুল্লমখুল্লা আসর ছিল না। মনে আছে, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে মদের দোকানের সামনে লম্বা লাইন দেখে টিটটলার বাঙালি বঙ্কিম নয়ানেই তাকিয়েছে, বাঁকা মন্তব্যই করেছে। মদ্যপায়ীরা বাংলার সমাজে সমবেদনা কখনওই পায়নি। না এই আমলে তো নয়ই, সেকালেও নয়।

সুরাসক্তি। ছবি: পিটিআই।

এই ‘সেকাল’ ব্যাপারটা ভারি গোলমেলে। কবে থেকে ধরব মদের ‘সেকাল’? সনাতন ধর্মে মদের জায়গাটা প্রাচীন গ্রিসের মতো স্পষ্ট নয়। প্রাচীন গ্রিক ধর্মে মদের দেবতা দিওনুসাস ছিলেন অন্যতম মান্য দেওতা। জনপ্রিয়তায় তিনি দেবরাজ জিউস বা সৌরদেব অ্যাপোলোর চাইতে কিছু কম ছিলেন না। তাঁর উৎসব থেকেই জন্ম নেয় কমেডি ও ট্র্যাজেডি। কার্যত, পশ্চিমের সভ্যতা দাঁড়িয়েই রয়েছে গ্রিক দিওনুসাস (রোমান আমলে ব্যাক্কাস) ও মদের উপরে। সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতিতে তেমন দেবতা নেই। অন্তত আমাদের চেনা-পরিচিত দেবতাদের মধ্যে কেউই মদের অধিষ্ঠাতা নন। কিন্তু তত্ত্ব-তালাশ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, বৈদিক দেবতাদের লিস্টিতে মদের দেবতা এক জন ছিলেন, তাঁর নাম ‘সোম’। হ্যাঁ, সেই বিখ্যাত ‘সোমরস’-এর নামেই তাঁর নাম। একাধারে ব্র্যান্ড ও ব্র্যান্ডমালিক সেই দেবতা কখনওই হিন্দু দেবলোকে জাঁকিয়ে বসতে পারেননি। অন্তত গ্রিক দিওনুসাসের মতো দাপট তিনি দেখাতে পারেননি। বিশেষজ্ঞরা দেখান, পরবর্তী কালে ওই নামটা গিয়ে বসে চন্দ্রদেবের ঘাড়ে। এ থেকে অনুমান করা যায়, সে কালেও আসবের আসর জমত চন্দ্রালোকিত রাতেই। দিনদুপুরে মাতলামির ব্যাপারটা মোটেই প্রশ্রয়প্রাপ্ত ছিল না।

পুরাণের আঙিনায় হাঁটাহাঁটি করতে গেলে মদ নিয়ে প্রথম যে ধামালটা নজরে আসে, সেটা সমুদ্রমন্থন। দেবাসুরের সেই টাগ অব ওয়ারের ফলে সমুদ্র থেকে কী না উঠেছিল! অমৃতের ভাণ্ড উঠে আসার আগে হলাহল, উচ্চৈশ্রবা আরও কী সব হাবিজাবির সঙ্গে ‘বারুণী’ নামের এক সুরাও নাকি উঠে আসে। বিষ্ণুপুরাণে বারুণীকে সুরার দেবতা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এহেন দেবতাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন বলেই দৈত্যরা ‘অ-সুর’। আর এঁকে গ্রহণ করেছিলেন বলেই দেবতারা ‘সুর’। এ কথাও অবশ্য বলা হয় যে, ঋগ্বেদে বর্ণিত ‘অসুর’-রা অন্য লোক। সে যাই হোক, একটা কথা বোঝা যায় যে মদ খেয়ে মাতাল হতে দানবেরা অস্বীকার করেছিলেন। তা হলে তো বলতেই হবে যে, তাঁদের কাণ্ডজ্ঞান ছিল টনটনে। বেফালতু মাতলামি করার কোনও অভিপ্রায় তাঁদের ছিল না।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

সে যাই হোক, মদ নিয়ে বাড়াবাড়ির উদাহরণ মহাকাব্যেও রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের বড়ভাই বলরামের সুরাপ্রীতির কথা সর্বজনবিদিত। ব্রহ্মপুরাণ-এ বলরামের কদম্ব-জাত সুরাপানের উল্লেখ রয়েছে। এবং সেই বর্ণনা রীতিমতো হুল্লোড়ের। বলরাম একা নন, গোপ বন্ধু ও গোপিনী বান্ধবী সহযোগে রীতিমতো জমাটি আসর। সাহিত্যিক পরশুরামের একটি গল্প এই অবকাশে মনে আসতে পারে। ‘তৃতীয়দ্যূতসভা’ নামক সেই গল্পে কুরু-পাণ্ডবদের মধ্যে আরও একটি পাশা খেলার কল্পকাহিনি বর্ণিত হয়েছিল। সেখানে এই দ্যূতসভার সভাপতি ছিলেন বলরাম। তিনি যখন হস্তিনাপুর এসে পৌঁছলেন, পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করে জানালেন, “ধর্মরাজ, শুনলাম আপনারা উররম কৌতুকের আয়োজন করেছেন। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ আমি দেখতে চাই না, কিন্তু আপনাদের খেলা দেখবার আমার প্রবল আগ্রহ। এখানে নামব না, আমরা দুই ভাই পাণ্ডবদের কাছে থাকলে পক্ষপাতের অপযশ হবে। তা ছাড়া এখানে পানীয়ের ভাল ব্যবস্থা নেই। কৃষ্ণ এখানে থাকুক, আমি দুর্যোধনের আতিথ্য নেব।’’ মহাভারত-অনুবাদক, পুরাণ বিষয়ে অসামান্য পণ্ডিত পরশুরাম বলরামের প্রকৃত ‘স্পিরিট’-টিকে ধরতে পেরেছিলেন এই উক্তিতে। মহাভারত ও সংলগ্ন পুরাণগুলি ঘাঁটলে মদ্যপানের যে সব ছবি উঠে আসে, তার কোনওটাই শান্ত-নিয়ন্ত্রিত কিছু নয়। ভাগবৎ-এ পানাসক্ত বলরামের সঙ্গে মত্ত হাতির তুলনা রয়েছে। সে দিক থেকে দেখলে বলরাম যে পান করে রীতিমতো হল্লা মচাতেন, তা অনুমান করা দুরূহ নয়।

তবে মহাভারতে মদোন্মত্ত হয়ে সব থেকে বেশি কেলেঙ্কারি বোধ হয় যদুকুলের গৃহযুদ্ধ। মৌষল পর্বের একেবারে গোড়ায় কাজ করেছিল যাদবদের মদ্যপান। অবশ্য তার পিছনে গান্ধারীর অভিশাপ ক্রিয়াশীল ছিল। সে যাই হোক, মদ্যপান করে হানাহানি এমন লেভেলে পৌঁছয় যে, পুরো গোষ্ঠীটাই ধ্বংস হয়ে গেল। এই কাহিনির পিছনে যতই নিয়তি কাজ করুক না কেন, মদ্যপানের কুফল নিয়ে একটা নীতিশিক্ষা অবশ্যই উঁকি মারে।

মহাকাব্য থাক, একটু বাংলার দিকে তাকানো যাক। ‘গৌড়’ নামটির পিছনে নাকি রয়ে গিয়েছে এই ভূমিতে তৈরি মদ ‘গৌড়ী’। গুড় থেকে তৈরি গৌড়ীর কদর ছিল সারা দেশেই। গুড় তৈরি এবং গোষ্ঠীগত পানের এক অসামান্য বর্ণনা রয়েছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘গৌড়মল্লার’-এ। এই উপন্যাসেই রয়েছে কর্ণসুবর্ণ নগরীর ‘শৌণ্ডিকালয়’ বা পানশালার বর্ণনাও। মদ নিয়ে যে গৌড়জনের একটা ক্রেজ ছিল, সেই সাক্ষ্য পাওয়া যায় নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’-এ। নীহাররঞ্জন জানাচ্ছেন, চর্যাপদের একাধিক গীতিতে শৌণ্ডিকালয় বা শুঁড়িখানার উল্লেখ ছিল। তাঁর অনুমান, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে মদ্যপান খুব একটা গর্হিত বলে বিবেচিত হত না। তবে মদ খেয়ে বাড়াবাড়ি অথবা মদের জন্য হ্যাংলামির উল্লেখ সে কালের কোনও সাহিত্যে নেই। মদ্যপান ও তার অনুষঙ্গ হিসেবে ঝামেলা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবেই ধরা হত বলে মনে হয়।

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

সুলতানি বা মোগলাই শাসনে পাবলিকের মদ্যপানের চরিত্র খুব বেশি বদলেছিল বলে মনে হয় না। গণস্মৃতি হাতড়ালে যে ঘটনাটা সর্বাগ্রে উঠে আসে, তা প্রভু নিত্যানন্দের সঙ্গে জগাই-মাধাইয়ের সংঘাত। মদ না খেলে এই দুই ‘নরাধম’ এহেন গোলমালে যেতেন কিনা সন্দেহ আছে। আর গোলমাল না হলে তাঁদের ‘উদ্ধার’-ও হত না। সুতরাং পরোক্ষে হলেও মদের একটা ভূমিকা এ ক্ষেত্রে থেকেই যাচ্ছে। চৈতন্যের সমসময়ে বা তার পরবর্তীকালে বাংলায় শাক্ত ধর্মের প্রসার মদ্যপানের বিষয়টাকে জলভাত করে দেয় বলেই মনে হয়। এক দিকে যদি পান-বিরোধী বৈষ্ণবরা থেকে থাকেন, তবে অন্য দিকে ছিলেন পান-সমর্থক শাক্তরা। শক্তিরঙ্গ বঙ্গভূমে পানকে তেমন দোষ বলে কি ধরা হত? রামপ্রসাদ তো মদ, শুঁড়ি, ভাটিখানার রূপকে লিখেই গিয়েছেন অমর কাব্য— ‘সুরাপান করিনে মা, সুধা খাই জয় কালী বলে’।

বাঙালির জীবনে মদ যদি এতটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে থাকে, তা হলে তাকে ঘিরে ট্যাবুর রমরমা শুরু হল কবে থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে ইংরেজ শাসন কায়েম হওয়ার কালে। ১৯ শতকে একদিকে যেমন বাঙালি ব্র্যান্ডি বা শেরি খেতে শিখছে, তেমনই একই শাসনের উল্টো পিঠে ভিক্টোরীয় নৈতিকতায় সে তার বিরোধিতাও করছে। মদ্যপান বিরোধী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ‘সধবার একাদশী’-র নিমচাঁদরাও ছিল, একথা ভুলে গেলে চলবে না। হুতোম তাঁর নকশায় লিখছেন—“আবগারীর আইন অনুসারে মদের দোকানের সদর দরজা বন্ধ হয়েচে অথচ খদ্দের ফিচ্চে না”। এ ছবি তো বাংলার পরবর্তী ইতিহাসে নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়ায়। হুতোমই লিখছেন, “কেউ মুখে মাথায় চাদর জড়িয়ে মনে কচ্চেন কেউ তাঁরে চিন্‌তে পারবে না”। করোনা-লকডাউনে মাস্কের অন্তরালে যাওয়ার বহু আগে থেকেই বাঙালির যে সেই অভ্যেস ছিল, তা এখানেই প্রমাণিত। হুতোম মদ খেয়ে বাড়াবাড়ির এবং মদ নিয়ে বাড়াবাড়ির যে ছবি এঁকে গিয়েছেন, তাকে আজও বাঙালি টপকাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বাবুর বাগানবাড়িতে মদ-মোচ্ছবের যে বর্ণনা উনিশ শতকের নকশা সাহিত্যে রয়েছে, তা আজকের সুরাপ্রেমীরা ভাবনাতেও আনতে পারবেন না। হুতোমের ভাষ্যকার অরুণ নাগ মশাই তাঁর ‘সেকালের নেশা’ নামের এক নিবন্ধে একটা ফর্দ পেশ করাছিলেন। তাতে হেন নেশার বস্তু নেই যে ছিল না। মদ-গাঁজা-চন্ডু-চরস তো বটেই। পাঁড় নেশাখড়দের পেড়ে ফেলার জন্য ‘নডেলাম’ নামের এক ওষুধ পর্যন্ত ছিল সেই তালিকায়। হুতোমের সাক্ষ্যে মদ খেয়ে বাড়াবাড়ির বর্ণ্নাও তো কম নেই। দুর্গামূর্তির সিংহ সরিয়ে মাতাল সিঙ্গীবাবুর নিজেই সিংহ হয়ে বসার গল্প কে ভুলতে পেরেছি। অথবা বৈষ্ণব গোঁসাইকে পাকড়ে কৃষ্ণ-বলরামের মদ্যপানের রেফারেন্স দিয়ে নাস্তানাবুদ করার কাহিনি তো হুতোমই লিখে গিয়েছেন। তবে সব থেকে জবরদস্ত বোধ হয় মাতাতলের যুক্তিবোধ সম্পর্কে হতোমের ধরতাই। কালী বড় না কৃষ্ণ বড় এই নিয়ে তর্কের মীমাংসা ছিল এই প্রকার—কালীর ছেলে কার্তিক, তাঁর বাহন ময়ূর আর সেই ময়ূরের পুচ্ছই কৃষ্ণ ধারণ করেন মাথায়। সুতরাং কালীর কাছে কৃষ্ণ লাগেন না। এই সব কাহিনিকে প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় সহজেই। কিন্তু তাতে সুরাপায়ীদের কিছু যায় বা আসে না। মদিরা-বিধুর সেই জগতের যুক্তিকাঠামো একেবারেই আলাদা। মদ্যপানের বিরোধীরা কোনওদিনই তার হদিশ পাবেন না।

দেশে স্বদেশি হাওয়া বইতে থাকলে ‘মদ খাওয়া বড় দায়’ হয়ে দাঁড়ায়। মদের দোকানের সামনে পিকেটিং একটা ‘অগ্রবর্তী কাজ’ বলে গণ্য হতে শুরু করে। স্বাধীনতার পরেও এই হাওয়া বজায় ছিল। তারাপদ রায়ের মদ ও মাতাল সম্পর্কিত বিভিন্ন রম্যরচনা ঘেঁটে জানা যায়, মদ্যপায়ীরা এক সময়ে পাড়ায় পাড়ায় চিহ্নিত থাকতেন। তাঁদের সবাই যে নিন্দিত ছিলেন, এমন নয়। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ মাতালদের এক প্রকার গৌরবান্বিতই করে রেখেছিল দীর্ঘকাল। পাড়ার মাতাল পরিচিত হতেন ‘ব্যর্থ প্রেমিক’ হিসেবে। প্রেম ও মদ তখন বাইনারি অপোজিশনে খেলা করত। বারে বসে নারী-পুরুষে একত্র পানাহার বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে সুলভ ছিল না। মোটামুটি ১৯৮০-র দশক পর্যন্ত এই হাওয়া বজায় ছিল। কিন্তু বিশ্বায়ন-উত্তর পর্বে এই দৃষ্টিভঙ্গি টোটালি ঘাপলা হয়ে যায়। মদ একেবারে খুল্লমখুল্লা ধারায় বাঙালি জীবনে নেমে আসে। গত দশ বছরে যে হারে মদের অন ও অফ শপ এ রাজ্যে ডানা মেলেছে, তা দেখলে হুতোমও ভিরমি খেতেন। এই পরিস্থিতিতে ‘কুলীন’ মাতালরা যেমন তাঁদের মহিমা হারান, তেমনই পেঁচি মাতালরা সমাজে ‘ওপেন’ হয়ে পড়েন। বড় বড় শপিং চেন চালু হলে চাল-ডাল-তেল-নুন মাসকাবারির পাশে হুইস্কি-ভদকা-রাম-ওয়াইনও লভ্য হয়। মদ তার গ্ল্যামার হারায়। সানফ্লাওয়ার তেলের পলি-বোতলের পাশে উঁকি মারতে শুরু করে ওল্ড মঙ্ক রামের বোতল। নামজাদা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোয় মদের আলাদা বিপণিতে লিঙ্গভেদ দূর হয়, মদ যে একান্ত ভাবে পুরুষভোগ্য— এই ধারণা বিলীন হয়। বঙ্গীয় নারীকুল বেনকাব হয়ে মদের দোকানে খদ্দের হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন।

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।

এমন পরিস্থিতিতে লকডাউন যদি মাসাধিক কাল জনসমাজকে মদবঞ্চিত রাখে, তা হলে কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সুরাপানের ইতিহাসকার মার্ক ফরসাইথ তাঁর ‘আ শর্ট হিস্ট্রি অব ড্রাঙ্কেননেস’-এর গোড়াতেই লিখেছেন, পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চারের ক্ষেত্রেই অ্যালকোহলের একটা অনিবার্য ভূমিকা ছিল। কাজেই মানুষ জন্মের আগে থেকেই ‘মাতাল’। ইনস্টিংক্ট-ফিনস্টিংক্ট বাজে কথা, আমাদের জিন মানচিত্রেই নাকি রয়ে গিয়েছে সুরাপান-প্রবণতা। আদিম মানুষ গাছ থেকে তাজা ফল পেড়ে যেমন খেয়েছে, তেমনই সেই ফল গেঁজিয়ে তা থেকে মদ বানিয়েও পান করেছে। বিষয়টা নাকি এমনই ‘জলভাত’! এহেন দর্শনের সামনে দাঁড়ালে মনে হতেই পারে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মদের দোকানের লাইন নিয়ে খিল্লির কোনও মানে হয় না। লকডাউন সেই জিন মানচিত্রের ভিতরকার অলিগলিকে খুঁচিয়ে রেখেছিল। দোকান খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাই এহেন ঝাঁপাঝাঁপি দৃশ্যমান হয়।

আরও একটা কথা। মদ্যপায়ী মাত্রেই ‘মাতাল’, এমনটা তো না-ও হতে পারে। ফেসবুকে জনৈক সুরাপ্রেমী দরদের সঙ্গে লিখেছেন, স্কচই হোক বা দেশি মদ, তিনি গুছিয়ে খেতে ভালবাসেন। লকডাউনের বাজারে মদের দোকান খোলায় যে হুড়োহুড়ি দৃশ্যমান হল, সেটা হ্যাংলামি। এর মধ্যে রুচির অভাব রয়েছে। এ একটা আলাদা দৃষ্টিকোণ। এ ভাবে দেখলে এই ‘ঝাঁপান’ একেবারেই কুরুচিকর। কিন্তু মদের ব্যাপারে ‘রুচি’ জিনিসটাই গোলমেলে। এই সুবাদে প্রাচীন গ্রিসের দিকেই এক বার তাকানো যাক। দিওনুসাসের উৎসবে লাগামহীন উল্লাস ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। ইওরোপীয় সংস্কৃতিতেই দু’টি মাত্র রস— ট্র্যাজেডি ও কমেডি। অ্যাপোলো-পুত্র অর্ফিউস যদি বেদনাবিধুর ট্র্যাজিক রসের উদ্গাতা হয়ে থাকেন, তবে দিওনুসাস কমেডির জনক। আর সেই কমেডি মানে বর্ণময় উচ্ছ্বাস। বাঁধ ভেঙে দেওয়া কৌতুক। সেখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের বেড়া টপকানোটাই দস্তুর। লকডাউন পর্বে কি সেই বেড়াটাই টপকালেন সুরাপ্রেমী বঙ্গজন তথা ভারতবাসী? উৎসব পর্যন্ত সইয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি ব্যাপারটা মৌষল পর্বের দিকে এগোয়? করোনা-বাজারে সেটা মোটেই সুখকর হবে না। অতএব, সাধু সাবধান! সাধু সাবধান!!

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Alcohol India Lockdown History Indian Cluture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy