ছবি: সংগৃহীত
মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিরও পরিণতি হতে পারে প্রহসনে। কাশ্মীরের আপেল বাগানে কাজ করতে গিয়ে সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে প্রাণ দিয়েছেন বাংলার পাঁচ শ্রমিক। তাই সাগরদিঘি ব্লক প্রশাসন স্থির করেছে, এলাকাতেই আপেল চাষ হবে!
মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রাম বাহালনগর। সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে এ গ্রামেরই পাঁচ শ্রমিক নিহত হন। যাঁরা ফিরেছেন, তাঁরা ফোনের অপেক্ষায়। আপেল বাগানের মালিকেরা যে দিন ফের ডেকে নেবেন, সে দিনই রওনা দেবেন। সাদের সরকার বলছেন, “দিনে পাঁচশো টাকা মজুরি। খাওয়া ফ্রি। বাড়ি আসার সময় হাজার দেড়েক টাকা বকশিশ, কয়েক পেটি আপেল। এখানে এত কিছু মিলবে?”
পশ্চিমবঙ্গে রাজমিস্ত্রির মজুরি ৪০০ টাকা, হেল্পারের ২৫০ টাকা। কেরলে রাজমিস্ত্রি পান ৯৫০ আর হেল্পার ৭৫০ টাকা। এই বৈষম্যের পথ ধরেই এ রাজ্যের কর্মক্ষম মানুষ যাচ্ছেন অচেনা রাজ্যে। কেউ সপরিবার, কেউ স্ত্রী-সন্তানকে রেখে। উত্তরবঙ্গের এক জেলা শহরের ছেলে বিপ্লব সে দিন প্রশ্ন করলেন, “মেয়ের এখন সবে আট মাস। দু’বছর যদি না দেখে, চিনতে পারবে?” বিপ্লবের কেরলযাত্রার ক’দিনের মধ্যে ডিএম অফিসের পাশের হোটেলের থালাবাসন-মাজা রাজু দিল্লি চলে গেল। মাসে সতেরো হাজার, খাওয়া ফ্রি। চৌমাথার মোড়ের মডার্ন সেলুনের টোটনও দোকান ভাড়া দিয়ে সপরিবার চলে গিয়েছে।
একশো দিনের কাজের প্রকল্পে দিনে ১৯১ টাকা মেলে, তা-ও বছরে কয়েক দিন। পুণে কিংবা মুম্বইতে তার তিন গুণ টাকা মজুরি পেলে বাইরে চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। ২০১১ সালের জনগণনা বলছে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঁচ লক্ষের কিছু বেশি শ্রমিক ভিন্রাজ্যে যান। কিন্তু বেসরকারি মতে, কেবল মুর্শিদাবাদ জেলাতেই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছাড়িয়েছে পাঁচ লক্ষ। একটি আন্দাজ, এ রাজ্যে মোট পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২০১১ সালেই ছিল চব্বিশ লক্ষ। এখন কত, কে বলতে পারে।
যেখানে বেশি মজুরি, সেখানে বেশি মজুর যাবে, এই সহজ সত্য মেনে নেওয়া ভাল। রাজনৈতিক তরজা তাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। রাজ্য সরকারের দাবি, চাষির রোজগার বেড়েছে, শিল্পেও বিনিয়োগ বেড়েছে, একশো দিনের কাজ দেওয়াতে রাজ্য অগ্রণী, তাই ভিন্রাজ্যে যাওয়ার দরকারই নেই। আর বিরোধীরা কেবল সেই দাবির সত্যতা নিয়ে সরকারকে বিদ্ধ করছেন। পরিযায়ী শ্রমিকের সুরক্ষার জন্য রাজ্য সরকার কী করছে, সেই প্রশ্নটা কেউ করছে না। শ্রমিক সংগঠনগুলিও নীরব। পরিযায়ী শ্রমিকদের সুরক্ষার যে সব শর্ত বলা রয়েছে শ্রম আইনে, সেগুলো কার্যকর করা তো রাজ্যের শ্রম দফতরেরই কর্তব্য। তার কতটা হচ্ছে?
এ রাজ্যে ১৯৭৯ সালের ‘আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন’ চালু আছে আজও। সংস্কার হয়নি। তাই ঠিকাদারি সংস্থা শ্রমিকদের ভিন্রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য শ্রম দফতরের কাছে লাইসেন্স নেয় কেবল সরকারি প্রকল্পে কাজের ক্ষেত্রে। বেসরকারি কাজের জন্য শ্রমিকদের নিয়ে যেতে চাইলে আইনত আজও লাইসেন্স লাগে না। শ্রম দফতরের এক কর্তা জানান, গত বছর সাকুল্যে চারটি ঠিকাদার সংস্থা ঠিকা শ্রমিকদের লাইসেন্স করিয়েছিল। তেমনই এক লাইসেন্সহীন শ্রমিক ছিলেন আফরাজুল হক। ৭ ডিসেম্বর, ২০১৭ রাজস্থানে খুন হয়েছিলেন মালদহের কালিয়াচকের আফরাজুল। তার পরে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গিরীশচন্দ্র গুপ্তের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হয়। কমিশন পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘ট্র্যাকিং পোর্টাল’ বা ‘স্মার্ট কার্ড’ তৈরির পরামর্শ দেয়। দু’বছর পেরিয়েছে, সে সব কিছুই হয়নি।
আজও অন্য রাজ্যে বাংলার শ্রমিকদের রোজগারের নিরাপত্তা নেই। সমান কাজের জন্য সমান মজুরি পান না তাঁরা। ছুটি নিতে বাধ্য হলে মজুরি কাটা যায়। পান না বিমা প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষাও। কেরল, কর্নাটক এবং ওড়িশার মতো রাজ্যগুলি শ্রমনীতি প্রণয়ন করলেও, পশ্চিমবঙ্গ করেনি। তাই এ রাজ্যের শ্রমিকের উপর মালিকের অত্যাচার, ঠিকাদারের প্রতারণা থেকে দুর্ঘটনা-হত্যা, কোনওটার বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা করার উপায় নেই সরকারের। প্রতি বছর কত শ্রমিক ভিন্রাজ্যে যাচ্ছে, সে তথ্যপঞ্জি পর্যন্ত শ্রম দফতরের কাছে নেই।
নির্যাতিত, নিহত, বিতাড়িত শ্রমিকদের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার কী করে তা হলে? অনুদান দেয়, মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। কাশ্মীরে নিহতদের পরিবারের আর্থিক সহায়তা মিলেছে। কাশ্মীর থেকে যে শ্রমিকেরা ফিরেছেন তাঁদের ‘সমর্থন প্রকল্প’ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ এসেছে। শ্রমিকদের প্রশ্ন, এতে ক’দিন চলবে?
কেরলে বন্যার পরে প্রশাসন কোমর বেঁধে নেমেছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহ করতে। তার আগের বছর আফরাজুল হত্যার পরও একই উদ্যোগ হয়েছিল। কোনও বারই কাজ শেষ হয়নি। এখন অপেক্ষা, ফের কবে শ্রমিক বিপদে পড়েন। আরও এক দফা অনুদানের রাজনীতি হবে তখন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy