প্রশ্নবাণ: শরশয্যায় পিতামহকে ঘিরে ধরে বহু কৌতূহলের নিরসন করেছিলেন নাতিরা। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমনস।
অনন্তর পঞ্চপাণ্ডব ভীষ্ম সকাশে উপস্থিত হইলেন, “পিতামহ, অধুনা বর্ষশেষে কিছু জিজ্ঞাস্য রহিয়া গেল।” বৃদ্ধ প্রমাদ গুনলেন। এই ছোকরাদের সব সময় প্রশ্ন থাকে। ৫৩ দিন শরশয্যাতেও তাঁকে রেহাই দেয়নি। রাজধর্ম কী, ব্রাহ্মণের কী করা উচিত, ক্ষত্রিয়েরই বা কী করণীয় ইত্যাদি কয়েকশো প্রশ্ন করে তাঁকে দিয়ে অষ্টাদশপর্ব মহাভারতের পুরো শান্তিপর্ব আর অনুশাসনপর্ব বলিয়ে নিয়েছিল। বিরক্তি মনে চেপেও তিনি নাতিদের উদ্দেশে স্মিত হাসলেন, “অসঙ্কোচে নিবেদন করো। ক্ষাত্রধর্ম না ব্রহ্মতেজ কী নিয়ে প্রশ্ন?”
ধর্মপুত্র আমতা আমতা করছিলেন, “না, কলিকালের এই ২০২০ সালের অন্তিম লগ্নে আমাদের প্রশ্নটি ভিন্নরূপ।”
“বলো, বৎসগণ।”
“কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রারম্ভে আপনার নামাঙ্কিত ভীষ্মপর্বে দিব্যদৃষ্টির বলে সঞ্জয় মানুষের আয়ু নিয়ে নানা কথা জানিয়েছিল। সে বলেছিল, সত্যযুগে আয়ুসংখ্যা ছিল চার হাজার বছর, ত্রেতায় তিন হাজার। কিন্তু কলিযুগে আয়ুসংখ্যার স্থিরতা নেই। যুদ্ধবিগ্রহ, মন্বন্তর তো বটেই, শিশুরা কেউ কেউ সদ্যোজাত অবস্থাতেও মারা যেতে পারে।”
“চার হাজার, তিন হাজার।” বড়দের কান বাঁচিয়ে সহদেব অস্ফুটে মন্তব্য করলেন, “যত্ত সব গুল।”
ভীষ্ম শুনেও শুনলেন না। ছোটদের সব কথা কানে নিতে নেই। তা ছাড়া এই ছোঁড়া নিজেকে সব সময় বিজ্ঞ ভাবত। এখন সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর তার এই ধারণা আরও বেড়েছে। নিজেকে সবজান্তা ভাবার বিরাম নেই। তিনি শান্তকণ্ঠে বললেন, “হ্যাঁ, কলির প্রভাবই ও রকম। কিন্তু সে নিয়ে দুর্ভাবনার কিছু নেই। কলিরও আয়ুক্ষয় হয়। ফের বৎসর ও ঋতুসমূহ চক্রবৎ আবর্তন করে। যুগাবসানে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর আবার ফিরে আসে। মহাকালের নিয়ম।”
“মহাকাল বিষয় নয়, পিতামহ। কিন্তু এই বছরে মর্তে লক্ষ লক্ষ মানুষের হতশ্বাস ক্রন্দনধ্বনি কি আপনার কানে আসেনি?” এ বার মধ্যম পাণ্ডব মুখ খুললেন, “কেউ জ্বরে ভুগে, কেউ বা রোগশয্যায় অম্লজানের অভাবে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে। এক অণুজীবের দাপটে ধরিত্রী জুড়ে ১৭ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু, যেন কালান্তক এক অশ্বমেধের দাপাদাপি। আমাদের সসাগরা জম্বুদ্বীপেও শুনছি, ১ লক্ষ ৪৬ হাজারের বেশি মৃত্যু। নেহাত অণুজীব, চোখে দেখা যায় না। নইলে জরাসন্ধ, দুর্যোধনদের মতো কবে গদাঘাতে শেষ করে দিতাম!”
এই বৃকোদরটা বরাবর বদরাগী, পিতামহ জানেন। তিনি বললেন, “কুরুক্ষেত্রে লক্ষ লক্ষ মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়েছ? ভূভার হরণের নিমিত্ত লোকক্ষয় হয়, কালের গতি কেউ রোধ করতে পারে না। মর্তের কোভিড-১৯’এর জীবাণুটি সামান্য; কালের প্রভাবে কুরুকুল, মায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের যদুকুল সবই ধ্বংস হয়ে যায়।”
জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব একটু চমকালেন। গঙ্গাপুত্র পিতামহ আজকাল জীবাণুর খবরাখবরও রাখেন! কিন্তু অর্জুন তত ক্ষণে কথা শুরু করেছেন, “এই বছরটাকে কেমন যেন গোয়েন্দাদের মৃত্যুবর্ষ বলে মনে হয়, পিতামহ। এ-দিকে ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ও-দিকে জেমস বন্ড শন কনরি। জন ল্য কার অত চমৎকার স্পাই থ্রিলার লিখতেন, তিনিও এ বছরেই মারা গেলেন। সব যেন হারিয়ে ফেলছি।”
পিতামহ জানেন, তৃতীয় পাণ্ডব আজকাল খুব থ্রিলার দেখেন। সেই যে অজ্ঞাতবাস পর্বে শমীগাছে ঝুলন্ত মড়ার আড়ালে অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে এসেছিল, এক বছর বৃহন্নলা সেজে থাকল, তার পর থেকেই গোয়েন্দা, গুপ্তচরেরা ওর খুব প্রিয়। তিনি শুনেছেন, সকলের অজ্ঞাতসারে ভিডিয়ো গেমসেও অর্জুন আজকাল গাণ্ডীব প্র্যাকটিস করে। তিনি বললেন, “শুধু ল্য কার বা শন কনরি কেন? যবনদেশে ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে যুবরাজ চার্লস অনেকের কোভিড হয়েছিল, সেরে গিয়েছেন। কিন্তু হতভাগ্য বাঙালিদের দেখো। ও-দিকে আনিসুজ্জামান, এ-দিকে হরি বাসুদেবন বা অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতো মানুষ চিরতরে হারিয়ে গেলেন। পাণ্ডববর্জিত ওই জাতির আর কোনও ধ্রুবপদ থাকল না হে!”
শুধু ধ্রুবপদ? যুধিষ্ঠির জানালেন, “বাঙালির গান থেকে শুরু করে ব্রাত্য এবং লোকায়ত ধর্মমত নিয়ে সুধীরবাবুর গ্রন্থগুলি রুদ্ধশ্বাসে পড়তাম।” ধর্মের সূক্ষ্ম গতি নিয়ে সেই দ্বাপর যুগ থেকে তিনি আগ্রহভরে মার্কণ্ডেয় মুনি, লোমশ ঋষির কথা শুনেছেন। এখানে এসে বলাহাড়ি, সাহেবধনী সম্প্রদায় নিয়ে সুধীরবাবুর লেখাও পড়েছেন।
অর্জুন বরাবরই রোম্যান্টিক। দ্রৌপদীর বাইরে সুভদ্রা, চিত্রাঙ্গদাদের প্রতিও তাঁর সমান প্রেম। তিনি মৃদু স্বরে বললেন, “আহা, অলোকরঞ্জন! বার্ধক্যে, প্রবাসে মারা গেলেন ঠিকই, কিন্তু কী সব লাইন! তুমি এসো বার্লিনের দু দিক থেকে/ অবিভক্ত সাদা-কালো খঞ্জন আমার/ ছৌ-কাবুকির ছদ্মবেশে/ চূর্ণ করে দাও যত অলীক সীমান্ত।… এক নিশ্বাসে এ ভাবে যিনি প্রেমের প্রতীকে বার্লিন প্রাচীর, ছোটনাগপুরের ছৌ নাচের সঙ্গে সীমান্ত ভেঙে জাপানি কাবুকি নিয়ে আসতে পারেন, তিনিই তো প্রকৃত কবি, পিতামহ।” ভীষ্ম সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন। গাণ্ডীবে শরযোজনা থেকে মেয়েদের মন, কবিতা— কত কী বোঝে ছেলেটা! সাধে যুদ্ধের আগে রথ থামিয়ে ওকে গীতা শুনিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ।
নকুল বলছিলেন, “সেন্স অব লস। এ বছর বাঙালিদের সব হারানোর বিষাদ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাসপাতালে অত দিন লড়াই করলেন, কোভিড সেরেও গেল। কিন্তু তত ক্ষণে সে যা ক্ষতি করার করেও দিয়েছে।” বিদ্বান সহদেব মাঝে মাঝে সহোদরকে খেই ধরিয়ে দেন। তিনি বললেন, “আমরা তো শুধু সেলেব্রিটিদের নিয়ে কথা বলছি। তার বাইরেও বাংলায় এ বার বার্ধক্য এবং অন্যান্য কারণেও কত মানুষ চলে গেলেন! মনু মুখোপাধ্যায়ের মতো চরিত্রাভিনেতা কি আর আসবেন? সারা সমাজে সর্বগ্রাসী বিষাদ। সেজদার বিষাদযোগ তো ছিল ব্যক্তিগত। পিতামহ, গুরু দ্রোণ, কৌরব ভাইদের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে হবে, তাঁদের বধ করতে হবে। কিন্তু এখানে তো যুদ্ধ নয়, ভাইরাস। নারী-পুরুষ সকলকেই সমান তালে লড়তে হয়। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে রোগাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে গেল। স্বামী ভেন্টিলেটর থেকে বেঁচে ফিরল, স্ত্রী চিরতরে হারিয়ে গেল।”
“এই বছরে মৃত্যু মানে তো শুধু রোগশয্যা নয়।” যুধিষ্ঠির এ বার বললেন, “এই মৃত্যুবর্ষের শুরুতে অনেকে মারা গিয়েছেন। তাঁদের স্ত্রী-পুত্র-পরিবার দেখাও করতে পারেননি। পিপিই কিট পরে অন্যরাই তাঁদের মরদেহ চুল্লিতে দিয়েছেন। পিতামহ, যুদ্ধশেষে মহাভারতের স্ত্রীপর্বে আমাদের অসহায় নারীরা তাও ভূরিশ্রবার ছিন্ন হাত, জয়দ্রথের ছিন্ন মুণ্ড দেখে কান্নায় গড়াগড়ি দিয়েছিল। মায়ের নির্দেশে ধর্মক্ষেত্রে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কর্ণের উদ্দেশেও জলাঞ্জলি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে তো সেই সুযোগও ছিল না।”
“শুধু শারীরিক রোগের হিসেব করে লাভ নেই।” মধ্যম পাণ্ডব গর্জে উঠলেন, “এই বছরে কত কী যে ঘটল! মানসিক রোগে কত লোক অসুস্থ হয়েছে, শুধু বেঁচে থাকার জন্য কত লোক কাজ হারিয়ে ঠেলাগাড়িতে সব্জি বেচতে শুরু করেছে,
কেউ বা দু’চোখে অন্ধকার দেখে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, ইয়ত্তা নেই। এই অতিমারি কবে শেষ হবে, পিতামহ?”
“অতিমারি শেষ হয় না। ভাইরাসের একটার পর একটা নতুন প্রজাতি আসে, আর তোমাকে তার মধ্যেই বেঁচে থাকতে হয়। একশো বছর আগে, ১৯২০ সালে এ রকমই স্প্যানিশ ফ্লু নামে একটা জ্বরের জীবাণু এসেছিল।” ভীষ্ম জানালেন, “মর্তের লোকে তখন এ ভাবেই পারস্পরিক দূরত্ব রেখে, মুখে মাস্ক এঁটে চলাচল করত।”
“প্রতিষেধক পাওয়া যায়নি?” প্রশ্ন করলেন সহদেব।
পিতামহ হাসলেন, “ভাইরাস আর মহামারি যে কত রকম! বাস্তব দুনিয়ায় সব কিছুর কি ঝটিতি প্রতিষেধক পাওয়া যায়? সম্প্রতি কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরে, এই স্বর্গের অন্য স্তরে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ় নামে ঋষিকল্প এক ব্যক্তির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাদের বেদব্যাসের আশ্রমে এসেছিলেন। তাঁর মুখে শুনছিলাম, মাকোন্দো নামে এক জায়গায় তাঁদের তপোবন ছিল। সেখানে সকলে ভ্রান্তিবিলাসের মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছিল। ভুলে-যাওয়া ঠেকাতে শেষ অবধি গাভিদের গলায় নোটিশ ঝুলিয়ে দিতে হয়েছিল, এটা গরু। দুইলে দুধ পাওয়া যায়। ভুলে যাওয়ায়, স্মৃতিহীনতায় কতটা সেন্স অব লস, বুঝতে পারো নকুল? সর্বত্রগামী এই সব হারানোর বোধটাই অতিমারির চারিত্র।”
“ঠিক”, যুধিষ্ঠির পিতামহকে প্রণাম সেরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “বিশ্বকাপের সময় আর মর্তে যাব না। মারাদোনার মৃত্যুর পর থেকে মনে হয়, বাঙালিরা আর পেলে বনাম মারাদোনা, আর্জেন্টিনা বনাম ব্রাজিল নিয়ে তর্ক করবে না। এই মৃত্যুবর্ষের পর কলকাতার দেওয়ালে সেই নীল সাদা জার্সি, বাঁ পায়ে শটের ছবি আর কেউ আঁকবে না। বছরটা সবাইকে রিক্ত করে চলে গেল।”
“ভুলো না”, শীতের সন্ধ্যায় পিতামহ ফিসফিস করে বললেন, “সৌমিত্র থেকে মারাদোনা, অলোকরঞ্জন থেকে আনিসুজ্জামান, কাউকে ভুলো না। ওখানেই মানুষের জয়। প্রতিষেধক আবিষ্কারে বা একটা অভিশপ্ত বছরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ায় নয়। মনে রেখো, ভাইরাসের স্মরণশক্তি নেই। মানুষের আছে।”
পঞ্চপাণ্ডব ফেরার জন্য প্রস্তুত হলেন।
এই শীতের অন্ধকারে তাঁদের এখনও অনেকটা যেতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy