এ দেশে ভাল ছাত্ররা অনেকেই চিকিৎসক হতে চান। আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে উত্তর আসে: চিকিৎসা পেশার মধ্য দিয়ে দেশসেবার কাজে যুক্ত থাকার যে সুযোগ পাওয়া যায়, তা অন্য কোথাও এত নিবিড় ভাবে পাওয়া যায় না। ইদানীং তাল কাটছে বটে, কিছু দূর পথ চলার পরে এদের অনেকেরই গতিপথ বদলে যাচ্ছে। দেশ আর দশের ভাবনা উড়ে গিয়ে ব্যক্তিগত চাওয়াপাওয়ার কানাগলিতে সব থেকে সুন্দর মাথাগুলোকে ঢুকে পড়তে দেখলে দুঃখ হয় বইকী।
তবু, অনেক অবক্ষয়ের মাঝখানেও চিকিৎসা পেশা কিন্তু তার মর্যাদা হারায়নি। মানুষের কাছে তার আবেদন ম্লান হয়নি। তার কারণ এই যে, নির্মম ‘পেশাদারিত্ব’-এর কাছে অস্তিত্ব বিকিয়ে না দিয়ে এখনও অনেক ঠিকঠাক মানুষ কাজ করছেন। বিশেষ করে যখন বিপদ আসে বড় আকারে, বন্যায়, খরায়, মহামারিতে, ভূমিকম্পে এঁদের দেখা মেলে নির্ভুল ভাবে, এঁরা ওষুধপত্র যন্ত্রপাতি কাঁধে করে ঠিক পৌঁছে যান দুর্গত অসহায় মানুষের কাছে। যেমন গিয়েছিলেন চন্দ্রকান্ত পাটিল।
২০০৮ সাল। বিহারে কোশী নদীর বন্যা আরও এক বার ছারখার করেছে সুপৌল জেলার বিস্তীর্ণ জনপদ। বাড়িঘর নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই, সেই এক চেনা ছবি, এ দেশের মানুষের চোখে সয়ে যাওয়া ছবি। কিন্তু সেই ছবি নাড়িয়ে দিয়েছিল চব্বিশ বছরের তরুণ চন্দ্রকান্তকে। মহারাষ্ট্রের ধুলে জেলার কাপড়ের কারখানার শ্রমিক পিতার সন্তান চন্দ্রকান্ত তখন মুম্বইয়ের কেইএম মেডিক্যাল কলেজে এমডি পড়ছেন। ভাল ছাত্র, ক্লাসে প্রথম সারিতে থাকেন। কিন্তু বরাবরই দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ ছিল তাঁর, এক বছর গ্রামে কাজ করার নিয়ম অনেক ডাক্তারি ছাত্রই এড়িয়ে যেতে চান, চন্দ্রকান্ত সে দায়িত্ব সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন। নানা এলাকায় সমাজ সেবার কাজ করেছেন তিনি। ইচ্ছা ছিল ‘হু’-এর হয়ে কাজ করবেন।
এই মানুষটি তো বিহারের বিধ্বংসী প্লাবনের খবর পেয়ে স্থির থাকতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, সেটা এমন একটা সময়, যখন উন্মত্ত প্রাদেশিকতা মরাঠি জাতীয়তাবাদের আগুন হাতে নিয়ে তাড়া করছে মুম্বই ও অন্য নানা শহরে পরিশ্রম করে দিনাতিপাত করা বিহার থেকে আসা মানুষদের। দেশটাকে আরও ছোট করার, ভাবনাটাকে আরও সংকীর্ণ করার এই বিষযজ্ঞ যখন জমে উঠেছে। ঠিক তখনই মরাঠি চন্দ্রকান্ত বিহারের বন্যার্ত মানুষজনের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর তাগিদ অনুভব করলেন এবং সহপাঠী ও সহকর্মীদের অনুপ্রাণিত করে মুম্বই থেকে চিকিৎসক দল নিয়ে দৌড়লেন সেখানে। দূরত্বের হিসেব করেননি তিনি, করার কথাও ছিল না। জনা পঞ্চাশেক চিকিৎসক মিলে কাজ করছিলেন বিহারের প্লাবিত অঞ্চলে, অস্থায়ী শিবির তৈরি করে। চন্দ্রকান্তরা ১৮ সেপ্টেম্বর পৌঁছে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন, ঝাঁপিয়ে পড়লেন কাজে। ২১ সেপ্টেম্বর রাত্রিবেলা খালি পায়ে, কাদামাটি মেখে বন্যাপীড়িতদের মাঝে কাজ করার সময় চন্দ্রকান্ত বজ্রাঘাতে মারা যান। এই সেপ্টেম্বরেরই ১২ তারিখে জন্ম তাঁর, উমাকান্ত আর লতা পাটিলের ঘরে। বেঁচে থাকলে তিরিশ পূর্ণ হত।
চন্দ্রকান্ত পাটিল বিদায় নিয়েছেন, দেখতে দেখতে ছ’বছর হয়ে গেল। কিন্তু তিনি হারিয়ে গিয়েছেন, এমন কথা একেবারেই বলা যাবে না। তাঁর এক সিনিয়র সহকর্মী জানিয়েছিলেন, চন্দ্রকান্তের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা তাঁকে প্রবল নাড়া দিয়েছিল। তার পর থেকে যেখানে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষ বিপন্ন হয়, তিনি চিকিৎসক দল নিয়ে ছুটে যান তাঁদের কাছে। ‘চন্দ্রকান্তকে হারানোটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল’, বলেছেন তিনি। চন্দ্রকান্তরা মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। ভরসা জাগিয়ে রাখতে পারেন আমাদের।
চিকিৎসক, লিভার ফাউন্ডেশন-এর সচিব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy