এ বছর পশ্চিমবঙ্গে শুধু সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই প্রায় ৭৫০ এমবিবিএস আসন কমতে চলেছে। স্নাতকোত্তর আসনও কমতে চলেছে অনেক মেডিক্যাল কলেজে। রাজ্য জুড়ে এই নিয়ে হইচই চলছে। এ কিন্তু নতুন ঘটনা নয়। বছর বছর প্রতিশ্রুতি, ‘স্যার আর ক’টা দিন সময় দিন, সব ঠিক করে নেব’ মুচলেকা, আবার পুনর্মূষিকো ভব।
আর কত দিন এ ভাবে মেডিক্যাল কলেজগুলো চলবে? এখন তথ্যের অধিকার আইনে সব মেডিক্যাল কলেজের পরিদর্শনের রিপোর্ট দেওয়া হয়। মেডিক্যাল কলেজের খামতিগুলো লুকোনো সহজ নয়। তাই আসন বাতিল না করার জন্য রাজ্য সরকারের অনুরোধ রাখাটাও কেন্দ্রীয় সরকার এবং কাউন্সিলের কাছে কঠিন হয়। বহু খামতি সত্ত্বেও কোনও মেডিক্যাল কলেজকে অনুমতি দিতে গেলে কাউন্সিলকে নিজের আইনকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে হয়।
আমাদের রাজ্যে মেডিক্যাল শিক্ষা দেখে শুধুমাত্র রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। বিশেষত স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দায় খুবই সীমিত নতুন মেডিক্যাল কলেজ বা নতুন কোর্স চালু হওয়ার সময়ে পরিদর্শন, পরীক্ষা নেওয়া ও ডিগ্রি বিতরণ। সেই কলেজ কী ভাবে চলছে, শিক্ষক আছেন কি না, গবেষণাগার, পরিকাঠামো, হস্টেল প্রভৃতি ব্যবস্থা আছে কি না, তা যাচাই করা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাতেই নেই।
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় জন্মলগ্ন থেকেই চলছে স্বাস্থ্য দফতরের ধার-করা ডাক্তার নিয়ে। উপাচার্য বাদে সবই স্বাস্থ্য দফতরের কর্মী। মনে হয়, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় হল আর একটা মেডিক্যাল কলেজ। কর্মীরা যখন-তখন বদলি হন, নতুন কর্মী আসেন অন্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে। যিনি আজ সহ-উপাচার্য, ক’দিন পরে তিনি হন বিশেষ সচিব, তার পর কোনও মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে কোনও পেশাদারিত্ব নেই। প্রশাসনিক কাজ শিখতে না শিখতেই বদলি হয়ে যান চিকিৎসকরা।
রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলেরও অবস্থা তথৈবচ। ডাক্তারি পাশ করলে রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া, এমডি বা এমএস পাশ করলে তা নথিভূক্ত করা কাউন্সিলের কাজ। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষক-চিকিৎসক আছেন, যাঁদের ডিগ্রি যথাযথ নয়। মেডিক্যাল কাউন্সিল আসন বাতিল করে থাকলে, অনেক ছাত্রছাত্রী পাশ করলেও তাঁদের ডিগ্রি স্বীকৃত নয়। আবার সরকার অনেক ক্ষেত্রে অনেককে চটজলদি পদোন্নতি দিয়ে সহযোগী অধ্যাপক করে দেয়, নিয়ম অনুযায়ী তাঁরা সেই পদের যোগ্য নন। কাউন্সিল তা মানবে না। এই সব অনিয়মের ফলে আসন বাতিলের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় যা প্রয়োজন, তা হল স্বাস্থ্য-শিক্ষা দফতরের অন্তর্গত একটি উচ্চক্ষমতা-সম্পন্ন কমিটি তৈরি করা। তাতে থাকবেন মেডিক্যালের নামী শিক্ষকরা, যাঁরা এমসিআই-এর নিয়মকানুন জানেন। থাকবেন স্বাস্থ্য বিদ্যালয়ের উপাচার্য, রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য, ও জাতীয় স্তরে মেডিক্যাল শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষাবিদ। মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি, পঠনপাঠন ও গবেষণা, প্রশাসন, এমন নানা দিক দেখবেন সদস্যরা। হঠাৎ-পরিদর্শনও করা দরকার। কারণ, হাইকোর্টের নির্দেশে জানুয়ারির ২০১৪ থেকে এমসিআই-এর সব পরিদর্শনই করতে হবে আগাম, না জানিয়ে।
আমাদের রাজ্যের একটা সমস্যা, মেডিক্যাল শিক্ষক কম। কারণ, দীর্ঘ দিন যথেষ্ট শিক্ষক তৈরির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মোট কত শিক্ষক দরকার, কোন বিষয়ের, কোন পদমর্যাদার কত শিক্ষক আছেন, কত জন অবসর নেবেন, কত নতুন শিক্ষক আসবেন তার ‘ডায়নামিক রেকডর্’ নেই। এই তথ্য না থাকলে কিছু করাই মুশকিল। এ ক্ষেত্রে সমাধানের কিছু রাস্তা ভেবে দেখা যেতে পারে।
এক, মেডিক্যাল কাউন্সিল অবসরের বয়স বাড়িয়ে করেছে ৭০ বছর। এ রাজ্যে ছিল ৬২ বছর, এখন নিয়ম শিথিল হচ্ছে। যে বিষয়গুলিতে যে পদমর্যাদার শিক্ষক কম আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে ৭০ বছর অবধি ডাক্তারদের নিয়োগ করা যেতে পারে। তার জন্য গোটা মেডিক্যাল শিক্ষা সার্ভিসে অবসরের বয়স ৭০ বছর করার দরকার নেই।
দ্বিতীয়ত, এম ডি, এম এস পাশ করা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের স্থানীয় ভাবে কিছু মেডিক্যাল কলেজে নিয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি নিয়োগের নিয়ম শিথিল করে তাঁদের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে পুরো সময়ের শিক্ষক করে নেওয়া যায়।
তৃতীয়ত, রাজ্য সরকার তাঁদের চাহিদা মতো শিক্ষক-চিকিৎসক সারা ভারতে ‘ওপেন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট’-এর মাধ্যমে নিতে পারেন। ভাল মাইনে দিলে ভাল ডাক্তারও পাওয়া যাবে। প্রবাসী ডাক্তাররা অনেকেই বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করে বিরক্ত, তাঁরা ফিরতে উৎসাহিত হবেন।
এই উচ্চক্ষমতাশীল কমিটি নিশ্চিত করবে, যেন মেডিক্যাল শিক্ষাকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা ‘বাই প্রোডাক্ট’ হিসেবে ভাবা না হয়। মন্ত্রীরা স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েই হিমশিম খান, কারণ তাতে মানুষের বাহবা পাওয়া যায়। মেডিক্যাল কাউন্সিল নতুন কলেজ খোলার জন্য নিয়মকানুন অনেক শিথিল করেছে। রাজ্য সরকারও কলেজ খুলতে চায় অথচ তার জন্য ডাক্তার-পরিকাঠামো কিছুই নেই।
নতুন মেডিক্যাল কলেজ হতে হবে কলকাতার ধারে কাছে, কখনওই দূরের জেলায় নয়। বারাসত, হাওড়া, শ্রীরামপুর, বারাকপুর, চুঁচুড়া হল আদর্শ স্থান। দূরের জেলায় প্রধান অসুবিধা হবে শিক্ষক-চিকিৎসক পাওয়া। মালদহ, বাঁকুড়া, উত্তরবঙ্গে পাঠাতে চাইলে ডাক্তারদের তদ্বির শুরু হয় স্বাস্থ্য ভবনে।
এক সময় পশ্চিমবঙ্গ ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের পীঠস্থান। আমাদের সবার লক্ষ্য সেই সুনাম, সেই স্বীকৃতি আবার ফিরিয়ে আনা। আমাদের অনেক মেধাবী ডাক্তার চিকিৎসক আছেন। আমরা পারব আমাদের ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মানের শিক্ষা দিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে।
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, মেডিক্যাল কলেজ, কলকাতা। এমসিআই এবং রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy