কাজের কথা। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুমন বল্লভ।
অর্থনীতির গবেষণায় একটা বড় বিষয় হল শাসনব্যবস্থার পরিচালনা, যাকে গভর্নেন্স বলা হয়। শাসনব্যবস্থা কেবল সরকারি নয়, বেসরকারিও হতে পারে। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে বিশেষ কোনও পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতি ঠিক কেমন হবে, সেটা কোনও বইয়ে লেখা থাকে না। অনেক কিছুর মধ্যে দিয়েই সেটা নির্ধারণ করতে হয় পারিপার্শ্বিকতা, পদ্ধতি ব্যবহারের সমস্যা, সমর্থক এবং প্রতিবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ভারসাম্য। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে হয়, কিছু ক্ষেত্রে তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্তও নিতে হয়। আমরা অর্থনীতির ছাত্ররা এ নিয়ে প্রচুর আঁক কষি, নতুন নতুন উপপাদ্য বার করি, রোমাঞ্চিত হই, দুনিয়ার গবেষণাযজ্ঞে আহুতি দিয়ে দাপিয়ে বেড়াই। সেখানে অনেক ধরনের নীতি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সে সব নীতি কাজে প্রয়োগ করা যে অঙ্ক কষা কিংবা বক্তৃতা করা নয়, শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করলে সেটা টের পাওয়া যায়। তাই কেউ পড়াশোনায় কেউকেটা হয়েও এ বিষয়ে একেবারে ব্যর্থ হতে পারেন, আবার নিছক বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের ভারসাম্যের জোরে কেউ ভাল প্রশাসক হতে পারেন। আমার মতে এই ভারসাম্যটা যে কোনও ধরনের শাসন পরিচালনার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি।
দিল্লির শাসনব্যবস্থায় আম আদমি পার্টির ভূমিকা একটি বহু-আলোচিত বিষয়। নিয়ন্ত্রণহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে, চমকপ্রদ দক্ষতায় নির্বাচন লড়ে আপ-এর আগমন। শিক্ষিত, পরিশীলিত, বিচক্ষণ মানুষেরা এর পিছনে রয়েছেন। তবুও কোথাও যেন সুর কেটে যাচ্ছে। শাসনব্যবস্থা যথাযথ ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং ধীরে ধীরে সুচিন্তিত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ভাবে সমস্ত সমস্যা সামলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সামর্থ্য তাঁরা দেখাতে পারেননি। দিল্লি শাসনের উদ্দেশ্য সফল করার জন্য কিছু সময়ের নিশ্চয়ই প্রয়োজন ছিল। দিল্লিতে নানা জিনিস নিশ্চয়ই বেসরকারি সংস্থা জোগান দেয়। তারা যাতে ন্যায্য দাম নেয়, তার জন্য একটা পাকাপোক্ত পদ্ধতি নিশ্চয়ই অনুসরণ করা দরকার। কিন্তু দাম বেশি বলে সবার বিরুদ্ধে এফ আই আর করে কী বার্তা দেওয়া হল? ওঁরা নিজেরা সত্ ও সাহসী, এ তো আমরা জানি। প্রয়োজন ছিল, তাঁরা শাসক হিসেবে কেমন, সেটা প্রমাণ করা। বোঝা উচিত ছিল, গদিতে বসে ঝাঁটা দিয়ে এক দিনে ময়লা সাফ করা অসম্ভব, ময়লা সাফ করার যে নীতি, তাকেও ভেবেচিন্তে প্রয়োগ করতে হয়, তা না হলে সারা জীবন ফেসবুকে ‘দুর্নীতি নিপাত যাক’ বলে চেঁচানোই সার হবে। নিজেরা কাজ করার জন্য অভিজ্ঞতা আহরণের ধৈর্য থাকা আবশ্যক। আপ কী ভাবে রাজ্য চালায়, সেটা দেখার একটা আশা তৈরি হয়েছিল। সেটা দ্রুত হতাশায় পর্যবসিত হওয়া কি ভাল?
এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের রাজ্য সরকারের কাজের কথা বলি। আমি খুব কাছ থেকে এঁদের কাজকর্ম দেখেছি, দেখছি। যে ভারসাম্যের কথাটা শুরুতে বলেছিলাম, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই সরকারের কাজে সেটা খুঁজে পেয়েছি। কয়েকটা দৃষ্টান্ত দিই।
প্রথমত, এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরে বেশ কিছু পঞ্চায়েতের কাজকর্ম থমকে যায়। তার একটা কারণ, তখন বিরোধী দলের হাতে যে পঞ্চায়েতগুলি ছিল তারা হাত গুটিয়ে নেয়, কারণ ভাল কাজ করলে এই সরকারের সুবিধে হবে। তাই পঞ্চায়েত সংক্রান্ত নতুন বিধি জারি করে জেলা ও স্থানীয় স্তরে সরকারি আধিকারিকদের ক্ষমতা বাড়ানো হল। ফলে উন্নয়নের কাজে গতি এল। গ্রামে যে কাজ হচ্ছে, তার বিভিন্ন ধরনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কাজের ব্যবস্থাপনায় উপরোক্ত পরিবর্তনটি ভাল কাজ করেছে।
দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি রোধের কথা বলি। দুর্নীতি বন্ধ করব বললেই করা যায় না। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করতে হয়। আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে অনলাইন অ্যাডমিশনের সুফল সুবিদিত। এ ক্ষেত্রেও সমস্যা কম ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতা কেউই ছাড়তে চায় না। কলেজে ভর্তি বাবদ টাকার বখরা অনেকের কাছেই পৌঁছত। কিন্তু সে সব বাধার মোকাবিলা করে আলোচনার মাধ্যমে এই নীতি পর্যায়ক্রমে প্রচলন করা হয়েছে। তবে আরও অনেক উন্নতির প্রয়োজন আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত সংস্কারের আর একটি নমুনা দিই। এ রাজ্যে পাঁচ বছর বা তার বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পূর্ণ অধ্যাপক উপাচার্য হতে পারেন, তাই তুলনায় নবীন অধ্যাপকরা উপাচার্য হতে পারছেন। অনেক আলাপ-আলোচনা বিতর্কের পর এ নীতি গৃহীত হয়েছে। সব কাজই সফল হচ্ছে বলব না, কিন্তু চেষ্টাটা চলছে। দেশে অন্য কোথাও এমনটা পাওয়া কঠিন।
তৃতীয়ত, ধারদেনায় জর্জরিত এই সরকার আজ অনেক বেশি উপার্জন করছে। কর না বাড়িয়েও যে রাজস্ব বাড়ানো যায়, সেটা অর্থনীতির বইয়ে লেখা থাকে, এ বিষয়ে অনেক গবেষণাপত্র লেখা হয়েছে, কিন্তু আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী সেটা করে দেখালেন। মাটিতে দাঁড়িয়ে অর্থনীতিকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করা কঠিন। আপাতত তিনি সে কাজে সফল। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আর একটি উদাহরণ দিই। কেন্দ্রে যখন ‘অকশন’ বা নিলাম পদ্ধতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে স্পেকট্রাম ও কয়লা কেলেঙ্কারি রাজস্ব ভাণ্ডারে ঘাটতিকে চরম সীমায় নিয়ে গেছে, তখনই বাড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে নিলাম পদ্ধতি যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করল রাজ্য পরিকাঠামো উন্নয়ন নিগম। এই সব সাফল্যের পিছনে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর একটা বড় ভূমিকা অনস্বীকার্য। সব দিকের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজটা তিনি করে দেখিয়েছেন। আপ-এর কাজকর্মে ওই ভারসাম্যের অভাব বিশেষ ভাবে প্রকট। তফাতটা এখানেই হয়ে যায়।
এ বার একটা অন্য দৃষ্টান্ত নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। খুব বিদগ্ধ পণ্ডিতরা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবকত্ব করছেন। রাজ্য সরকার এটিকে অতি উচ্চমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করতে চান। গবেষণার টাকা, বাড়তি মাইনে, পরিকাঠামোগত সাহায্য, সবই সরকার যথাসাধ্য দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যতগুলো শর্ত আছে, সেগুলি পূর্ণ না হলে সরকারি সাহায্য যথেষ্ট ফলপ্রসূ হবে না। এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা কী ভাবে চলে, বাস্তব সমস্যাগুলি কী, সেগুলি বুঝে সমস্ত দিকের ভারসাম্য রেখে চলা দরকার। প্রেসিডেন্সি বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নয় বা বিদেশি প্রতিষ্ঠান নয়, সেটা না বুঝলে অনেক সদিচ্ছা এবং সরকারের অনেক সহযোগিতা সত্ত্বেও কাজ হবে না। অনেকে হয়তো বলবেন, মেন্টর গ্রুপের ‘এলিট চরিত্র’ই সমস্যার কারণ। আমার মনে হয়, এলিটিজ্ম ছাড়া উত্কর্ষ হয় না। কিন্তু বাস্তব সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে নয়, মুখোমুখি দাঁড়িয়েই সমাধান সম্ভব। দুটি নির্দিষ্ট সমস্যার কথা বলি।
এক, কলা-বিজ্ঞান বা অন্য ধরনের মিশ্র কোর্স চালু করার প্রস্তাব অতি উত্তম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যে বিষয়গুলি নির্দিষ্ট করেছে, সেগুলি পড়াতে গেলে সে বিষয়ে ডিগ্রি লাগবে। তা হলে প্রেসিডেন্সিতে মিশ্র কোর্স করে বেরিয়ে ছাত্রছাত্রীরা কোন কলেজে পড়াবেন? এটা বাস্তব সমস্যা। সেটা বুঝতে হবে।
দুই, উচ্চ শিক্ষা সংসদ এবং শিক্ষা বিভাগে একটি বিষয়ে বহু অভিযোগ জমা পড়েছিল। অধ্যাপক পদপ্রার্থীদের কাকে কাকে ইন্টারভিউয়ে ডাকা হবে, সেটা সে বিষয়ে নির্দিষ্ট বিচারকমণ্ডলীর নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই সেই নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি এবং তার ফলে অনেক উচ্চমানের প্রার্থী ছাঁটাই হয়েছিলেন। তখন উচ্চ শিক্ষা সংসদের সভাপতি হিসেবে আমাকেও দেশেবিদেশে অনেক গালমন্দ শুনতে হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এমন সমস্যা না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
এই বিষয়গুলি নিয়ে একটু মাটির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, সরকারি নিয়মগুলির দিকে লক্ষ্য রেখে, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলার দরকার ছিল। অনেক ভাল শিক্ষক ইন্টারভিউয়ের সুযোগ না পেলে রাজ্যের উচ্চশিক্ষার স্বার্থেই সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগে। এ ক্ষেত্রেও ওই বাস্তবমুখী ভারসাম্যের অভাবই প্রেসিডেন্সিকে কিছুটা বিতর্কিত করে তুলেছে। এই অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয়, ভাল কিছু করার যথাযথ পদ্ধতি কী, সেটা স্থির করার বিশেষ প্রয়োজন আছে।
একটা কাজ কী ভাবে করা হবে, শাসকের পক্ষে সেটাই সবচেয়ে দুরূহ প্রশ্ন। মাটিতে নেমে বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করেই সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সম্ভব। আপ চাইছে, এখনই সব দুর্নীতির অবসান হোক। প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রী বা অভিভাবকদের হয়তো প্রশ্ন, এই বিশ্ববিদ্যালয় কেন এখনও হার্ভার্ড হল না? অন্য দিকে, ভোটে পাওয়া একটা ঋণগ্রস্ত, ভেঙে পড়া অর্থব্যবস্থা, গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক বশ্যতার শিকার একটা রাজ্যের প্রায় অনভিজ্ঞ প্রশাসক কিন্তু ওই ভারসাম্যকে সম্মান করে দু’তিন বছরে বেশ কিছু কাজ করেছেন। অযথা বিতর্কের ঝড় না তুলে নীতি রূপায়ণে কী ভাবে এগনো যায়, সেটাই শাসক তথা প্রতিষ্ঠানের চালকদের মূল শিক্ষা ও ভাবনার বিষয় হওয়া উচিত। বিতর্ক না এড়িয়ে, বিতর্কের গলা টিপে না ধরে, সংবেদনশীলতার সঙ্গে তার মোকাবিলাই যথার্থ শাসকের কাজ।
নীতি রূপায়ণের প্রধান শর্ত হল ঠিকঠাক পদ্ধতি নির্ণয়। পারিপার্শ্বিক বাস্তবকে মাথায় না রাখলে বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের ভারসাম্য হারিয়ে যায়। আর সেখানেই সবচেয়ে বড় সমস্যা।
কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy