২০১৪-র ফুটবল বিশ্বকাপে নেদারল্যান্ডস-এর প্রথম খেলায় প্রতিপক্ষ ছিল গত বারের বিশ্বকাপজয়ী স্পেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ডাচ জনসাধারণ মোটেও আশাবাদী ছিলেন না দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার ব্যাপারে, বরং বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে যখন গেস করার খেলা চলছে, সেখানে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েই রেখেছিলেন তাঁরা। বিশ্বাস করা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু এখানকার মানুষ এ ভাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। তাঁদের আবেগ তাঁরা নিয়ন্ত্রণেই রাখেন। যুক্তিকে তার কাছে হার মানতে দেন না। নিজের দেশ বিশ্বকাপে খেলছে বলেই তাকে ফাইনালিস্ট ভেবে বসতে হবে, সে মনোভাব থেকে তাঁরা শত যোজন দূরে।
বরং এখানে যে ভারতীয়রা থাকেন, তাঁদের মধ্যে নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে উদ্দীপনা অনেক প্রবল। স্থানীয় সময় সন্ধ্যে ছ’টায় খেলা শুরু হবে বলে সব কাজ সেরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে টেলিভিশনের সামনে হাজির হচ্ছেন তাঁরা। এমনকী তাঁদের কেউ কেউ ব্রাজিলেও যাচ্ছেন সেমিফাইনাল-ফাইনাল খেলা দেখবে বলে। স্পেনের সঙ্গে খেলার পর দিন এক ডাচ বন্ধুর কাছ থেকে শুনলাম খেলাটা সে দেখেছে জিম-এর টিভি স্ক্রিনে, বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে নয়!
তবে প্রথম খেলায় স্পেনকে ৫-১ গোলে দুরমুশ করার পর ডাচদের মনোভাব অনেকটাই বদলায়। কিন্তু তার পরেও কোনও উন্মাদনা লক্ষ করিনি কোথাও। খেলা নিয়ে উত্সাহ উদ্দীপনা ধরা পড়ছে শব্দে নয়, রঙে। ক্রমশ দেশের ছোট-বড় শহরগুলো বর্ণময় হয়ে উঠছে কমলা রঙের বেলুনে, পতাকায়। যে দিন নেদারল্যান্ডসের খেলা থাকছে, স্কুলে বাচ্চারা অরেঞ্জ জামা পরে যাচ্ছে। জামাকাপড়ের দোকানে দেশের অরেঞ্জ জার্সি বিকোচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে। নেদারল্যান্ডসকে ‘Orange Country’ বলে ডাকা হয়। নামটা এখন আক্ষরিক অর্থে সত্য।
প্রথম রাউন্ডের দ্বিতীয় খেলায় অস্ট্রেলিয়াকে ৩-২ গোলে হারাবার পর ডাচরা এখন বেশ উত্সাহী। এই খেলার আগেই বিশ্বকাপে পুরুষদের হকির ফাইনালে ডাচরা অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয়েছে, ফুটবল মাঠে যেন তারই শোধ তুলল তারা। তবে এই ‘শোধ-বোধ’-এর ভাবনা আমরাই ভাবতে ভালবাসি, সাধারণ ডাচরা এ-সব মনেও আনেন না। এমনকী ডাচ মিডিয়াকেও কখনও এ ধরনের চোখা মন্তব্য করতে শুনিনি। ডাচরা ‘বর্তমান’ নিয়ে বাঁচেন, অতীত-ভবিষ্যত্ নিয়ে নয়। আবারও আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা। দ্বিতীয় খেলার পর দিন যখন এক ডাচ বন্ধু বলল যে, সে গত কাল সন্ধ্যেবেলা খেলা চলাকালীন সুপারমার্কেটে গিয়েছিল বাজার করতে। খেলা ছিল বলে অপেক্ষাকৃত ফাঁকায় বাজার করতে পেরে সে খুবই খুশি। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের আবহে বড় হয়ে ওঠা, সারা পাড়া একসঙ্গে রাত জেগে বিশ্বকাপ দেখা ‘আমরা’ সুদূর কল্পনাতেও এ কথা ভাবতে পারি না।
নেদারল্যান্ডসের তৃতীয় খেলা চিলির বিরুদ্ধে। সেই খেলায় জেতার পর অবশ্য দু-একটা বাজি ফাটার শব্দ শোনা গেল। বড় জোর মিনিট দশেক, তার পর আবার সব শুনশান। আমার ডাচ বন্ধুদের মধ্যে অন্যদের তুলনায় যার বিশ্বকাপ নিয়ে উত্সাহ একটু বেশি, তাকে পরের দিন জিজ্ঞেস করলাম, গত কালের খেলা কেমন দেখলে? তার উত্তরে আমাকে অবাক করে সে বলল, কাল খেলার ফার্স্ট হাফ-এর সময় ডিনার রেডি করছিল, তাই দেখা হয়নি। সেকেন্ড হাফটা অবশ্য দেখেছে। কী নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি! হতাশ আমি ওর সঙ্গে রসিকতা করার জন্যই বললাম, এই জন্যই কাল নেদারল্যান্ডস ফার্স্ট হাফ-এ গোল করেনি। কী বুঝল কে জানে!
এখন এখানে ভরা গ্রীষ্ম। সূর্যের আলো থাকছে প্রায় রাত সাড়ে দশটা অবধি। বৃষ্টির প্রকোপও এখন অনেকটাই কম। টেলিভিশনের সামনে বসে খেলা দেখার থেকে খানিক ক্ষণ রাস্তায় দৌড়ে আসা বা কয়েক কিলোমিটার সাইক্লিং করা বা মাঠে গিয়ে কিছু ক্ষণ ফুটবল খেলে আসায় এদের উত্সাহ অনেক বেশি। ২০১০-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে যখন স্পেনের বিরুদ্ধে নেদারল্যান্ডসের জমজমাট খেলা চলছিল, তখনও দেখেছি আমার প্রতিবেশী ভদ্রলোককে বাড়ির বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকতে।
ওয়ার্ল্ড কাপ শুরুর আগে আমাকে এক ডাচ বন্ধু বলল, জানো, বোধহয় কাল থেকে বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হচ্ছে। আমি তো অবাক। গর্বের সঙ্গে বললাম, জানি মানে! বিশ্বকাপের নাড়ি-নক্ষত্র আমাদের নখদর্পণে। এ বার আমার বন্ধুটির অবাক হওয়ার পালা। বলল, ‘সে কী! ফুটবল নিয়ে এত উত্সাহ, অথচ ইন্ডিয়াকে তো কখনও বিশ্বকাপে খেলতে দেখিনি, ইন্ডিয়া তো শুধু ক্রিকেট খেলে জানি।’ মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবলাম, শুধুমাত্র আবেগ আর উদ্দীপনাকে সম্বল করে কি আর সাফল্য আসে!
ওয়ার্ল্ড কাপ-এ নেদারল্যান্ডস দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার পর অফিসের লাঞ্চ আওয়ার-এ খেলা নিয়ে আলোচনার পারদ কিছুটা চড়ছে। শহরের পাবগুলোয় ভিড় বাড়ছে একসঙ্গে খেলা দেখার জন্য। তবে এখানকার ইমার্জেন্সি সার্ভিস তো বটেই, অন্যান্য প্রাত্যহিক পরিষেবাতে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটে না খেলার জন্য। রাত জেগে খেলা দেখে পর দিন স্কুল-কলেজ-অফিস কামাই করার কোনও প্রশ্নই নেই। খেলোয়াড়দের নিয়ে কোনও মাতামাতি নেই, ব্যক্তিপুজো নেই। কেউ এখানে হিরো নয়, তাই তো এই দেশ থেকেই জন্ম নেয় ‘টোটাল ফুটবল’।
১২৭ কোটি মানুষের ভারতবর্ষ আর কত দিন আবেগে ভেসে ফুটবল মাঠে শুধু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে যাবে! ফুটবলের দুনিয়ায় ভারতের হয়ে গলা ফাটানোর দিন কি কখনওই আসবে না আমাদের?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy