‘আমাদের অতীত কিছু অগৌরবের নয়; মোটে দু’হাজার, দেড় হাজার বছরের হ’লই বা!’
(বাঙলাভাষা আর বাঙালীজাতের গোড়ার কথা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সবুজ পত্র, আশ্বিন ১৩৩৩)
আধমরাদের ঘা মেরে। রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী।
বাঙালি আয়নায় নিজের মুখ দেখে বটে কিন্তু আমি কে বা আমরা কে, এই আত্মজিজ্ঞাসায় নিজেকে বড়ো একটা খোঁচাতে চায় না। একশো বছর আগে ১৩২১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে প্রকাশিত ‘সবুজ পত্র’ নামের সুপরিকল্পিত ছিপছিপে মাসিকপত্রটি সেই চেষ্টা করেছিল। পয়লা বৈশাখ সে আত্মপ্রকাশ করেনি, প্রথম প্রকাশের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছিল পঁচিশ বৈশাখকে। তবে প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত এই পত্রিকা যে নতুন বাংলা বছরে আধ-মরা বাঙালি জাতিকে ঘা মেরে বাঁচাতে চাইছিল, তার নানা নিশান ছড়িয়ে ছিল পাতায় পাতায়। সম্পাদক লিখেছিলেন, ‘সাহিত্য, জাতির খোরপোষের ব্যবস্থা করে দিতে পারে না কিন্তু আত্মহত্যা থেকে রক্ষা কর্তে পারে।’
‘সবুজ পত্র’ প্রকাশিত হল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। এই সময়ের আগে যাঁরা স্বদেশ-স্বজাতি নিয়ে ভাবতেন তাঁদের অধিকাংশের চিন্তায় ‘পুরনো ভারত’ ও ‘নব্য ইউরোপ’ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। প্রমথ চৌধুরীর মনে হয়েছিল, ‘আমরা বর্তমান ইউরোপ ও অতীত ভারতবর্ষ, এই উভয়ের দোটানায় পড়ে বাঙ্গলা প্রায় ভুলে গেছি।’ ‘সবুজ পত্র’ এই ভুলে যাওয়া বাংলার সঙ্গে আধুনিক বাঙালির যোগসূত্র স্থাপন করতে চেয়েছিল।
তবে কোনও অর্থেই ‘সবুজ পত্র’ স্থানীয় সংকীর্ণতার কাগজ ছিল না। এই সাময়িকপত্রেই প্রকাশিত হয়েছিল অতুলচন্দ্র গুপ্তের ধারাবাহিক রচনা ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’। ভরত, আনন্দবর্ধন, অভিনব গুপ্ত প্রমুখেরা সংস্কৃত ভাষায় কাব্য বিচারের যে শাস্ত্র লিখেছিলেন, অতুলচন্দ্র গুপ্ত সহজ বাংলায় তা আম বাঙালির দরবারে পেশ করেছিলেন। নলিনীকান্ত গুপ্ত লিখেছিলেন ‘ফরাসী-কবি বোদলের’ নিবন্ধ। রাধাকমল মুখোপাধ্যায় আবার যখন ‘সাহিত্যে বাস্তবতা’ নিবন্ধে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি লেখকদের পাশ্চাত্যপনার বিরোধিতা করেন, তখন প্রমথ চৌধুরী তার প্রতিবাদ করেন। সংস্কৃত ও ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতা ‘সবুজ পত্র’ করেনি, বলতে চেয়েছিল, ‘ভাবের বীজ যে দেশ থেকেই আন না কেন, দেশের মাটিতে তার চাষ করতে হবে।’ আর তখনই সেই কাজ সম্ভব যখন বাঙালি পুরনো ভারত ও নব্য ইউরোপকে বাঙালিয়ানার রসে জারিয়ে নেবে।
সুনীতিকুমারের মতে এই বাঙালিয়ানার ইতিহাস বেদের মতো পুরনো নয়। আবার ইউরোপের মুখোমুখি হয়ে উনিশ শতকে বাঙালির আত্মপরিচয়ের যে বাসনা জেগে উঠেছিল তার মতো নব্যও নয়। সুনীতিকুমারের মতো সচেতন ভাষাবিদ দেখিয়েছিলেন এই বাঙালিয়ানার ইতিহাস দেড় থেকে দুহাজার বছরের পুরনো। পূর্বাংশে নানা অনার্য প্রাকৃত জাতির বসবাস ছিল। এই প্রাকৃত ভাষা-সভ্যতার সঙ্গে নানা স্তরে সংস্কৃত সভ্যতার সংমিশ্রণ ঘটেছিল। বাঙালি তার এই নিজস্ব প্রাকৃত বোধের শিকড়টিকে বজায় রেখে যদি সংস্কৃত আর পাশ্চাত্যের ধারাকে নিজের দেশের উপযুক্ত করে তুলতে পারে তা হলেই বুঝি সব দিক থেকে মঙ্গল। বর্তমান ইউরোপ আর অতীত ভারতবর্ষের দোটানায় পড়ে বাঙালি তখন নিজেকে ভুলে যাবে না।
বাঙালিকে এই বোধে জাগিয়ে তোলা ছিল খুবই শক্ত। ‘সবুজ পত্র’ যে এ কাজে পুরোপুরি সফল হয়েছিল, তা বলা যাবে না। তবে চেষ্টাটি ছিল খুবই অভিনব। এই সবুজ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের বিতর্কিত ও বহু আলোচিত গল্প ‘স্ত্রীর পত্র’ মৃণাল নামের মেয়েটির চিঠি। চিঠিটি সংস্কৃতায়িত বাংলায় লেখা নয়। দুর্গম পাড়াগাঁয়ের মেয়ের পক্ষে যে চলিত বাংলা লেখা সম্ভব চিঠিটি সে ভাষাতেই লেখা। স্বামীর ঘর ছেড়েছে সে। এসেছে শ্রীক্ষেত্রে। তার সামনে সমুদ্দুর। আর ফিরবে না কলকাতার মাখন বড়াল লেনের গলিতে। কেন ফিরবে? ও বাড়িতে তার কথার কোনও দাম নেই। কথাহারা গুরুত্বহীন পুরুষের পায়ের তলার জীব হয়ে সংসারে অচলা সতী হয়ে থাকতে চায় না মৃণাল। সে কথা ক’টা জানাতেই মৃণালের এই চিঠি।
অনেকেরই মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ নব্য ইউরোপের নারী মুক্তির বাসনাকে বাংলা ভাষায় বুঝি চালান করছেন। জাতীয়তাবাদী বাঙালি নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের ‘নারায়ণ’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের এই গল্পটি সমালোচিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃণাল অবশ্য ইংরেজি পড়ে নারী স্বাধীনতা শেখেনি। পুরনো ভারতীয় মহাকাব্য মহাভারতে স্বামীর ঘর ছাড়া মেয়েদের কথা ছিল। গঙ্গা তো শান্তনুর গৃহত্যাগ করতে দ্বিধা করেনি। মৃণাল কিন্তু পুরনো ভারতের দোহাই দেয় না। সে লেখে মীরার কথা। ‘মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল, ছাড়ুক বাপ, ছাড়ুক মা, ছাড়ুক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্রভু তাতে তার যা হবার হোক।’ মীরা পুরনো ভারতের মেয়ে নয়, নব্য ইউরোপের সঙ্গেও তার সম্বন্ধ নেই। সে তুলনায় অর্বাচীন, মধ্যযুগের মেয়ে। পঞ্চদশ ষোড়শ শতাব্দীর মীরা তার পদে যে ভাষা ব্যবহার করত তাও প্রাকৃত জনের ভাষা, নানা উপাদানের মিশেলে তৈরি। বাঙালি মৃণালের কানে এই প্রাকৃত মীরার গান ও কাহিনি ভেসে আসা খুবই সম্ভব। প্রাচীন ভারতের উজ্জ্বল অতীতের কল্পনা করতেন একদল জাতীয়তাবাদী, নব্য ইউরোপের কথা ভাবতেন আর এক দল প্রগতিবাদী, এই দুইয়ের বাইরে ভারতের নানা জাতের নিজস্ব নানা সংস্কৃতি ছিল। মধ্যযুগে এই নানা প্রাকৃত সংস্কৃতির মধ্যে যোগাযোগও ছিল। সংস্কৃতের তুলনায় কমবয়সি এই ধারাটিকে সুনীতিকুমার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মীরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন, নিজের গানে বিভোর হয়ে থাকতেন। এই ‘বেশরম বেহুদা’ রমণীটিকে পুরুষতান্ত্রিক পরিবার প্রথা আটকে রাখতে পারেনি। পারেনি বিশ শতকের কলকাতার মৃণালকেও। সে পুরুষের ঘরের শেকল খুলে বাইরে এসেছে।
মেয়েদের এই বাইরে আসার শক্তি কিন্তু মধ্যযুগের প্রাকৃত জনের কথা-কাহিনির মধ্যেই আছে। ‘সবুজ পত্র’-পর্বে রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীরা এই কথাটুকুই এক ভাবে বলতে চেয়েছিলেন। খুবই জরুরি এই বোধ। ভারত এমনিতে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে নানা জাতের নানা ভাষার মানুষের বাস। পুরনো সংস্কৃত বা নব্য ইউরোপের দোহাই দিয়ে তাদের এক সংস্কৃতির ছাঁচে ঢালাই করলে অপমান করা হয়। নানা ভারতীয় ভাষা ও গোষ্ঠীর মানুষ তাঁদের প্রাকৃত পরম্পরাটি খেয়াল রেখে যদি অন্য উপাদানগুলিকে নিজের করে নেন, তা হলে গোষ্ঠীর নিজস্বতা বজায় থাকে, আবার সংকীর্ণতাও গিলে ফেলে না।
স্থানীয় দলগুলির আধিপত্য রাজনীতির ক্ষেত্রে খানিকটা হলেও এই বিষয়টিকে সম্ভব করেছে। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা হয়নি। নতুন বছরে নতুন চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কী?
লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy