শাস্তি। দিল্লির ধর্ষিতা মেয়েটির মৃত্যুর পরে এক প্রতিবাদ সমাবেশে। আমদাবাদ। ছবি: এএফপি
দ্রুত বিচার চাই, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, ফাঁসি চাই: শক্তি মিলস-এর চিত্রসাংবাদিক ও টেলিফোন অপারেটরের তিন ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ডের রায়ে উদ্বেল সমাজের এই সব দাবিই একত্রে পূরণ হল। মুম্বই মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয় এই কলঙ্ক মুছতে সরকার কতটা তৎপর, মেয়েদের কাজের, পড়াশোনার অধিকারের সঙ্গে তাদের আনন্দ-স্ফূর্তির অধিকারেও সমতা আনার জন্য কী পদক্ষেপ জরুরি, এই মামলার তদন্ত ও বিচার সেটা কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। দিল্লির ঘটনার মতোই তদন্তের ক্ষেত্রেও নানা অপ্রচলিত পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে মুম্বই পুলিশও উদাহরণ তৈরি করেছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিগত ভাবে আগ্রহ নিয়েছিলেন বাণিজ্যনগরীর সুনাম পুনরুদ্ধারে। এও নিশ্চয় প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে যে, সরকারের উপর, প্রশাসনের উপর সব ধরনের মেয়েরা আস্থা রাখতে পারেন। যে সময়ে ওই চিত্রসাংবাদিকদের নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, ওই একই সময়ে যে আরও একটি অনুরূপ ঘটনা আর এক কর্মী মেয়ের সঙ্গে ঘটেছে, অভিযুক্তরা এলাকাটিকে তাদের দুষ্কর্মের নিয়মিত লীলাভূমি বানিয়েছে, প্রায় এক মাস বাদে এই অভিযোগ এলেও সেটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গৃহীত হয়েছে, একই রকম গুরুত্ব দিয়ে দুটি ঘটনায় তদন্ত ও বিচার চলেছে। চিত্রসাংবাদিক মেয়েটি তাঁর পেশা এবং শ্রেণির কারণে কোনও রকম বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছেন, এটা বলার অবকাশ একেবারেই তৈরি হয়নি।
পশ্চিমবঙ্গের সরকার ও প্রশাসন এর থেকে শিক্ষা নেবেন বলে আশা করা যায়। সব চেয়ে বড় কথা, দিল্লির বাসে প্যারামেডিক ছাত্রীর নৃশংস গণধর্ষণ ও হত্যার পরে যে জনরোষ তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারি দণ্ডবিধি সংশোধন করে পরপর এক ধরনের ঘটনা ঘটালে ‘মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে’ বলে যে ধারা (৩৭৬ ই) যুক্ত হয়েছিল, এই রায়ে তার প্রয়োগ হয়েছে, বিখ্যাত সরকারি আইনজীবী উজ্জ্বল নিকম বলেছেন যে এই প্রথম কোনও ধর্ষিতা তাঁর জীবদ্দশায় ধর্ষকদের ফাঁসি নিজের চোখে দেখে যেতে পারবেন।
এর আগে, দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডে প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্তদের ফাঁসির সাজা ‘ফাঁসি ধর্ষণ কমাতে পারে কি না’ তা নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক তৈরি করেছিল। এই নিবন্ধকার মোটেই মৃত্যুদণ্ড বিলোপের প্রবক্তা নন। ধর্ষণ করে হত্যা করা হলে ধর্ষণের জন্য না হলেও হত্যার জন্য মৃত্যুদণ্ড যুক্তিসংগত হতেও পারে, কিন্তু নিগৃহীতা জীবিত থাকলে, তাঁর কোনও দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক ক্ষতি না হলে (আইনে আছে হত্যা না করা হলেও তাঁকে শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ অক্ষম করে দেওয়ার কথা) কি মৃত্যুদণ্ড যুক্তিযুক্ত? তা কি সেই ‘রেয়ারেস্ট অব রেয়ার’ ঘটনা? তা তো আপাত ভাবে প্রচলিত ন্যায়ের ধারণারও বিরোধী। লোকসভা অচল করে দেওয়া রাজনীতিক থেকে সাধারণ মানুষ সব ধর্ষণেই ফাঁসি চেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত লিঙ্গপ্রবেশকে একটি মেয়ের শারীরিক না হলেও আত্মিক হত্যা সেই বিশ্বাসটাকেই পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। সারা দেশ জুড়ে এ নিয়ে এক ধরনের মোটা দাগের সম্মতি নির্মিতও হয়েছে। এই ভাবনা তো মেয়েদের প্রতি চলতি বৈষম্যেরই পুনঃপ্রকাশ, একটি মেয়ের শরীরী ‘শুদ্ধতা’ই তার ‘সম্মান’-এর একমাত্র উৎস এই বিশ্বাস, তা হরণকারী হত্যার যোগ্য যা দাবি করে ধর্ষিতারা ‘জিন্দা লাশ’, সেই ভাবনাতেই এ বার মহামান্য আদালতের সিলমোহর লাগল না? শুধুমাত্র ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ড হলে আমরা সৌদি আরব, পাকিস্তান আর ইরাকের সঙ্গে এক কাতারেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছি, যেখানে মেয়েটিকে পরিবারের সম্পত্তি বলে মনে করা হয় বলেই অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড হয়, এমনকী এ জন্য অভিযুক্তকে হত্যা করা হলেও তা যদি ‘সম্মানরক্ষার জন্য’ বলে প্রমাণ করা যায়, তা হলে বেকসুর খালাস পায়।
নিগৃহীতা বেঁচে থাকতেও মৃত্যুদণ্ড মানে তো আলোচনার কেন্দ্রে নিগৃহীতা আর তাঁর অধিকার নয়, কারণ তাঁরা এখনও কোনও পুনর্বাসন-সহায়তা পাননি, বরং রাষ্ট্রের সম্মান, রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান মেয়েদের সুরক্ষা দানে তার ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এক সোচ্চার প্রয়াস। এই রায়ে যেন বলা হচ্ছে এ বার তো সমাজের সম্মান রক্ষা হল, যে সম্মানের ধারণা, মেয়েদের শরীরী শুদ্ধতার ধারণা পুরুষের সম্পত্তির ভাবনার প্রসারিত রূপ। সংবাদে প্রকাশ, সরকারি কৌঁসুলি উজ্জ্বল নিকম টুইট করেছিলেন মৃত্যুদণ্ড আবশ্যক কারণ মেয়েটি তার ‘কৌমার্য’ আর ‘সম্মান’ হারিয়ে আর কখনও তার পুরনো সত্তাটিকে ফিরে পাবে না। তা হলে তো উত্তর চব্বিশ পরগনার যে ছাত্রীটিকে তার স্কুল আর বন্ধু-শিক্ষিকা সবাই মিলে আগলে রাখবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাঁদের সব প্রয়াস তো এক ফুঁয়ে উড়ে যায়। অথচ আমরা তো আবার তাকে সব গ্লানি মুছে নতুন করে জীবনে ফিরবার কথা বলি, সেই পুনর্বাসনের জন্য সরকারের যা যা কিছু করার আছে, সেই দায়বদ্ধতা দাবি করি, তা মিথ্যা হয়ে যায়। অরুণাচলের যে ছাত্রীটিকে মন্ত্রীর আত্মীয়সহ ১৬ জন গণধর্ষণের পর স্কুল তাকে ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করলে সেই স্কুলকে আমরা নিন্দা করি, গুয়াহাটিতে গিয়ে কেন তাকে পরিচয় লুকিয়ে অন্য স্কুলে ভরতি হতে হবে সেই প্রশ্ন তুলি।
সুতরাং, যুক্তি বলছে, কঠোরতম শাস্তি নয়, ধর্ষণে শাস্তির হার ২৬% থেকে কী ভাবে আরও উপরে তুলে আনা যায় সেটাই আপাতত মূল লক্ষ্য হওয়া দরকার। একমাত্র তা হলেই কমতে পারে ‘যে কোনও কিছু করে পার পেয়ে যাওয়া যায়’ এই সর্বব্যাপী বিশ্বাস। দিল্লির অভিজ্ঞতা বলছে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের পর যৌনহিংসার ঘটনা নথিভুক্ত হওয়াটাই শুধু বেড়েছে, তার তদন্ত ও বিচার শেষ করার হার এখনও সেই নীচেই রয়ে গেছে। দিল্লিতে নির্ভয়ার ঘটনায় প্রাণদণ্ডের সমসময়ের ওই আদালতেই ২৩টি মামলায় অভিযুক্ত খালাস পেয়ে গেছে। সেগুলি নিশ্চয় মিথ্যা মামলা ছিল না। মনে রাখতে হবে সারা ভারতে ধর্ষণের তথ্য যা নথিভুক্ত হয়, তার মধ্যে নব্বই শতাংশের একটু বেশি পরিচিতরা করে। আর শিশুনিগ্রহের বেশির ভাগ হয় পরিবারের মধ্যে। তাই বার বার করা হলেও পরিবার কখনও অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবে না, কারণ তারা চাইবে না যে পরিবারের কোনও সদস্যের এ জন্য প্রাণ চলে যাক। শুধুমাত্র ধর্ষণের জন্য প্রাণদণ্ডের ব্যবস্থা সমগ্র বিচার প্রক্রিয়াকেই আরও শ্লথ করে দেবে, নিম্ন আদালত দিলেও তা উচ্চ থেকে উচ্চতর আদালতে আপিলে সময় চলে যাবে, আর যত দিন মামলা চলবে, নিগৃহীতা তাঁর দুঃস্বপ্নের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন না, পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য তাঁকে মনে করে রেখে দিতে হবে।
এই মৃত্যুদণ্ড কি মেয়েদের স্বনির্ভরতাকে বাড়াচ্ছে? বাড়ছে কি নিরাপত্তার আশ্বাস? বরং পরিবারের নারীবৈষম্য আর নীতি-পুলিশ তো আরও গভীরে শিকড় ছড়াচ্ছে, মোবাইল, পোশাক, বাইরে বেরোনো, বন্ধুবাছাই সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রণের নিগড় আরও শক্ত হয়ে বসছে। তাই একটি দুটি ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড নয়, যৌনহিংসার সমস্ত ঘটনায় দ্রুত, যথাযথ তদন্ত ও বিচার হোক। কেন্দ্রীয় সরকার যে নিয়মবিধি প্রস্তাব করছে, সেটি প্রচারিত হোক আর সর্বস্তরে তা মান্য হোক। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার যে, শক্তি মিলসের মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি সূর্যনেল্লির গণধর্ষণের ঘটনার রায়ও একই দিনে পাওয়া গেল, যেখানে ১৯৯৬ সালে একটি ১৬ বছরের কিশোরীকে অপহরণ করে ৪০ দিন ধরে ধর্ষণের দায়ে অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, পুলিশ আধিকারিকসহ ২৪ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিচার পেতে লেগে গেল ১৬টি বছর! এই যদি পরিস্থিতি হয়, একটি-দুটি মৃত্যুদণ্ড কি ধর্ষণ কমাতে পারবে?
সব শেষে আরও একটি কথা ভাবার মতো। ভারতে এখন ৪৭৭ জন মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দি আছেন, বলছে হিসেব। কেউ কেউ এই দণ্ড মাথায় নিয়ে ৩০ বছর পর্যন্ত কারাবাস করছেন। যদি মৃত্যুদণ্ডই ধার্য হয়, তবে তা কার্যকর করতে এত সময় লাগার কারণ কী? এত দিন ধরে কারাবাস করেছেন বলে সুপ্রিম কোর্ট তো তাঁদের মুক্তিও দিতে পারে। রাহুল গাঁধীর খেদোক্তি আমরা গণমাধ্যমে জানতে পারি, বাকি পরিবারগুলির কথা তো প্রচারমাধ্যমে সামনে আসে না। মৃত্যুদণ্ড যদি দিতেই হয়, তবে তা দ্রুত কার্যকর করার পথে আমরা কেন হাঁটতে পারি না? প্রতিবেশী বাংলাদেশও পারে, অথচ আমরা পারি না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy