উড়ালপুল এড়াব
এমনিতেই এখন আদ্ধেক লোক ঘুরপথে অফিস যাচ্ছেন, দেড় ঘণ্টা এক্সট্রা লাগুক বাবা, উড়ালপুলের তলা দিয়ে যাব না। ওপর দিয়েও নয়। অত উঁচু থেকে পড়লে তো আর রক্ষে নেই। একটা কথা আছে ‘অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে।’ এখন ‘অতি উড় উড়ো না’-ও জুড়ে দেওয়া যায়। তবে শহরের পরিকল্পনা করেন যাঁরা, একটা-দুটো অ্যাক্সিডেন্টে তো দমবার নয়, নির্ঘাত কলকাতাকে আরও তিনশো সাতাশিটা উড়ালপুল দিয়ে ঘিরে ফেলবেন। তখন বড়লোকেরা যদি কাতারে কাতারে মাথা বাঁচাতে ধীরেআস্তে গাঁ-গঞ্জের দিকে কেটে পড়েন, একটা বিরাট সুবিধে, কলকাতার হেঁক্কোর খর্ব হয়। পশ্চিমবঙ্গ মানে শুধু কলকাতা, এই সংস্কারও তার উঁচু নাক বালিতে ঘষটায়। তখন অজ গাঁয়েও তৈরি হয় ঝকঝকে মল, ধক্কাস-ধক্কাস নাইটক্লাব, বটগাছে ভোরের দিকে গদাম ধাক্কা খায় জুভেনাইলের অডি। বাংলা জুড়ে এক আশ্চর্য সাম্য প্রতিষ্ঠা পায়। তবে, তখন আবার উন্নয়নের উৎসাহে সরকার গাঁয়ে উড়ালপুল গড়তে শুরু করলে, কেলেংকারি।
অচেনা লোকের সামনে সৎ থাকব
কারণ কার কোন পকেটে যে পুঁচকে ক্যামেরা লুকনো আছে, কে জানে। সরল মনে মানুষকে বিশ্বাস করে ঘুষ খেলাম, তার পর তা নিয়ে শয়তানেরা ঢি-ঢি ফেলে দিল। এক বার স্টিং হয়ে গেলে, যতই ‘মিথ্যে’, ‘ফোটোশপ’ বলে চিল্লাই, পাবলিক মানে না। পাশের বাড়ির বাচ্চাটা অবধি শার্টের হাতায় বার বার মুচকি মুছে নেয়। প্রেমও কেটে যেতে পারে। তার চেয়ে, একদম চেনা লোকের সঙ্গে কোরাপশন প্রাণপণ ঝালিয়ে নিলেও, অচেনার সামনে থাকুন কোরা কাপড়ের মতো সৎ। যে কোনও লোভনীয় অফার শুনেই কানে আঙুল দিন ও আপনার যে প্রোফাইলটা ক্যামেরায় সুন্দর দেখায়, সেই গালটা ফিরিয়ে ‘ছি ছি’ বলতে থাকুন সুরেলা গলায়। যদি স্টিং হয়, আপনার নামে ধন্য ধন্য পড়ে যাবে। স্টিং না হলে অবশ্য লস, কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে লাভ কী? ভয় নেই, আর বছর দুয়েকের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে স্টিং-ক্যামেরা-জ্যামার, সেটা ঘরে ফিট করে নিলেই যে কোনও ছোট ক্যামেরা আপসে অকেজো হয়ে যাবে। তখন আবার নিরাপদ দুর্নীতি, নিঃশঙ্ক সুখ। যেমন কম্পিউটারে আগে অ্যান্টি-ভাইরাস ভরে নিয়ে তার পর মহাসুখে পর্নো দেখেন, সে রকমই।
বাথরুমে টিভি লাগাব
বাঙালির সংস্কৃতির দিক থেকে শ্রেষ্ঠ জাত, আবার পেটের অসুখের দিক থেকেও। প্রায়ই সিরিয়ালের মাঝামাঝি আপনার পেট চনচন করে ওঠে। সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে রাত্তির এগারোটা অবধি একটু শান্তিতে সিরিয়াল দেখে সংস্কৃতিচর্চা করবেন, সে স্কোপটুকুও আপনাকে দেয় না এই পোড়া পেট। অথচ কোনও শিক্ষিত বাঙালি তো আর সিরিয়াল না দেখে থাকতে পারে না, তা হলে তার ঐতিহ্য ও সাধনা চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়বে, পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী ও অন্য তিনশোচৌষট্টি দিন তদ্গত সিরিয়াল-গেলন তার পবিত্র কর্তব্য। এ দিকে, প্রতি বার অ্যাড-ব্রেক হলে তবেই পাঁইপাঁই ছুটব, আবার ব্রেক শেষের আগেই প্রকৃতির কারবার শেষ করে শোঁ বেরিয়ে আসব, এ অলিম্পিক তো সম্ভব নয়। তাই বাথরুমে টিভি লাগান, যাতে সারস্বত সাধনায় কোনও ছেদ না পড়ে, একটা সিনও ননদের কাছ থেকে না শুনে নিতে হয় (সে চক্রান্ত করে আপনাকে ভুল ইনফর্মেশনও দিতে পারে, হয়তো নায়কের দ্বিতীয় বিয়েটা চেপে গেল!), কমোডে বসে তোফা দেখতে থাকুন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বউমাকে অত্যাচার। চান করার সময় জল লেগে টিভি নষ্ট হলে, ফের একটা টিভি ফিট করুন। কালচারের ব্যাপারে বাঙালির কোনও কালচে আপোস নেই!
সন্তানকে বলব, কলেজে ঢুকেই রাজনীতি কর
কারণ অনেকটা ছুটি পাওয়া যায়। একটা ঝামেলা লাগিয়ে দিতে পারলে, তার পর তো শুধু স্লোগান, গিটার বাজানো, ঘেরাও করে গালাগাল দেওয়া। সে মোটামুটি দশটা থেকে দুটো। তার পর বাচ্চাটা মল-এ ঘুরতে যেতে পারবে, প্রেম করতে পারবে। বাড়িতে এসে রেস্ট নিতে পারবে, হোয়াট্সঅ্যাপে টুকটাক চুটকি পড়ে রিল্যাক্স করতে পারবে। মোটামুটি তিন মাস যদি ঝঞ্ঝাট চলে, একটা ফেস্টিভালের আমেজে ওদের মানসিক স্বাস্থ্যটা চমৎকার থাকে। যদি গোলমাল বিচ্ছিরি দিকে মোড় নেয়, ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢোকে, ধরপাকড় হয়, আর আপনার ছেলে বা মেয়ে তার মধ্যে পড়ে যায়? ফাসক্লাস! বিপ্লবী স্টেটাস মুহূর্তে ওর রেটিং বাড়িয়ে দেবে, টিভি চ্যানেলরা হামলে পড়ে বাইট নেবে। গ্রেফতার হয়ে গেলে তো আর দেখতে হবে না। রাতারাতি মেগাস্টার। তখন ও যা-ই বলবে, মুহূর্তে ভাইরাল। গভীর তিন-চারটে কথা শিখিয়ে রাখুন, যেমন ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই’, কিংবা ‘পাগলা, মা কি তোর একার?’ ইতিহাস বা সমাজশাস্ত্র কিচ্ছু পড়তে হবে না, শুধু আবেগ-থরোথরো কণ্ঠে যেন ফাঁপা লেকচার দিতে পারে, জেলে বসে যেন মুক্তি-বক্তৃতার খসড়াটা রেডি করে ফেলে, ফাঁকি না মারে, এইটুকু লক্ষ রাখুন। ছাড়া পাওয়ার পর ওর পদধূলিও বিক্কিরি করতে পারেন, ছোট প্যাকেট, পাঁচ টাকা। পড়ার খরচাটা উঠে যাবে।
স্মার্টফোন অপারেটর রাখব
ফোনটায় ম্যাজিকের মতো কী সব হয়, কিন্তু আদ্ধেকই জানি না। ছেলেটা বা নাতিটা অনায়াসে চিচিং ফাঁক করে ফেলে, আমি হাবলার মতো বসে থাকি। প্রচুর চেষ্টা করেও দারুণ খেলাটা আনতে পারি না, যাতে একটা লোক দৈত্যকে মারছে। এ দিকে দিনকাল যা পড়ছে, ট্যাক্সি ডাকা থেকে ফিশফ্রাই কেনা, সবই স্মার্টফোনের আওতায়। ক’দিন বাদে কোঁচকানো জামা ইস্তিরি করতে দিতেও ‘আয়রনি’ অ্যাপ টকাটক করতে হবে। শিখে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বার বার ভুলে ভোঁ, লাগাতার ঠেস আর বকুনি, ‘তোমার দ্বারা মাইরি কিস্যু হবে না!’ তার চেয়ে, একটা ছোকরা দেখে ফোন-অপারেটর বহাল করুন না, দেশে তো বেকার কম নেই। লজ্জা কীসের? গাড়ির যদি ড্রাইভার রাখা যায়, ফোনেরও চালক থাকতে পারে। আপনি বলবেন, সে চালাবে। অ্যাই, মেজোমাসিকে ফোন লাগা। এখনও ট্যাক্সি ডাকিসনি, কাল থেকে বলছি সকাল সকাল বরানগর যাব? মারব এক চাঁটি, মুদিমশলা এসে পৌঁছয়নি কেন, রান্না কী তোমার বাবা এসে দুপুরবেলা শুরু করবে? বেশ ঝাল ঝাড়ারও নতুন লোক পাওয়া গেল, ফোনেও অসুবিধে রইল না। শুধু ব্যাঙ্কের টাকাপয়সায় ক্লিক করার সময়, ঘাড়ের কাছটায় ঠায় চোখ মেলে দাঁড়িয়ে থাকুন।
প্রতিবেশীকে চড় মেরেই মিষ্টি দেব
যে প্রতিবেশীর সঙ্গে আপনার গত কুড়ি বছর ধরে অনর্গল খারাখারি, ওর গাছ পাঁচিল পেরিয়ে এ দিকে ঝুঁকলেই আপনি মুড়িয়ে কেটে দেন (স্পেশাল কাঁচি কিনেছেন), আর ওর কুকুরের ‘পটি’ প্রায়ই প্লাস্টিক প্যাকেটে এসে পড়ে আপনার বারান্দায়, যাকে দেখলেই আপনি বাছাই গালাগালি দিতে শুরু করেন ও যে আপনার মা’র দিকে গরম চা ছুড়েছিল বারান্দা থেকে, তাকেও এ বার দুপুরে লাথি দেখিয়ে, বিকেলে ‘শুভ নববর্ষ’ বলুন এবং মিষ্টি দিয়ে আসুন, সেঁকো বিষ না মিশিয়েই। কারণ, কার সঙ্গে কার যে কখন জোট বাঁধতে হয়, কিচ্ছু বলা যায় না। সারা জীবন শত্রুতা করে, বাপ-মা তুলে, কোঁদল পাকিয়ে, তার পর এক সুন্দর সকালে হাত-ধরাধরি করে গালে গাল ঠেকিয়ে যে পাড়া বেড়ানো যায়, সে তো আমরা চোখের সামনেই দেখছি। কেউ বলছে এগুলো ‘কৌশল’, কেউ বলছে ‘সমাজের প্রয়োজন’, কেউ বলছে ‘বৃহত্তর বিপদের বিরুদ্ধ-স্ট্র্যাটেজি’। তা এ রকম একটা শক্ত বাংলা বা ইংরেজি আপনিও বানিয়ে নিতে পারবেন। যার সম্পর্কে রোজ বলেছেন, ওর কোনও আদর্শ নেই, নীতি নেই, রুচি নেই, শিক্ষা নেই, তাকে ‘ভাই আমার’ বলে বুকে টেনে নেওয়া যায় না, কে বললে? হয়তো দেখলেন তাতে আপনার পরকীয়ার সুবিধে হচ্ছে বা নতুন গাড়িটার পার্কিং-এর জায়গা জোগাড় করতে পারছেন। শুধু স্তম্ভিত পড়শিরা গালাগাল দিলে, একটা ‘বাদ’-এর ফান্ডা দিয়ে দিন। যেমন ‘বিশ্বভ্রাতৃত্ববাদ’, ‘কিমিতিবাদ’, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা’বাদ। খবরদার, ‘সুবিধেবাদ’ বলে ফেলবেন না।
এসি দেখে মেয়ের বিয়ে দেব
মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সময় পাত্রের কুষ্ঠি, ব্লাড রিপোর্ট, কলারের সাইজ, স্যালারি স্লিপ— এ সব পরে হবে। আগে দেখুন ও-বাড়ির শোওয়ার ঘরে এসি লাগানো আছে কি না। যে গরমটা পড়তে শুরু করেছে, মেয়ে না খেয়ে বা আধপেটা খেয়েও ক’দিন কাটিয়ে দিতে পারবে, কিন্তু এসি ছাড়া ঘুমোতে পারবে না। পাত্রপক্ষ যদি খুব গরিব হয়, তাকে বলুন গয়নাগাটির ব্যাপারটা বরং কম করে, এসি-টা বেশি করতে। আলু-পটল পরে কিনবে, এখন ইএমআই দিয়ে এসি কিনুক। রান্নাঘরেও যদি নিতান্ত এগজস্ট ফ্যান না থাকে, বিয়ে দেবেন না। শেষে ঝোল রাঁধতে গিয়ে মেয়ে ধপাস করে পড়ে গেল, তার পর স্ট্রেট আইসিইউ, এ তো ভাল কথা নয়। ওটাও এক রকম ‘পুড়িয়ে মারা’-ই, শুধু একটু ঘুরিয়ে। যদি এমন পাত্রের সন্ধান পান, যে ফেরেব্বাজ চরিত্রহীন রগচটা কিন্তু তার ঘরে ঘরে এসি, লাফিয়ে পড়ে তার সঙ্গে বিয়ে দিন। বদ-চরিত্র মেনে নেওয়া যায়, এই লেভেলের গরম মেনে নেওয়া অসম্ভব।
অলঙ্করণ: অনুপ রায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy