চিরকাল দেখেছি, পয়লা বৈশাখ মানে ছুটির দিন। ছুটি কেন? না এই দিন থেকে বাঙালিদের নতুন বছরের শুরু। শুনেছি লালমুখো ব্রিটিশরা এ দেশ থেকে চলে যাওয়ার পরেও ফি বছর ফাস্ট জানুয়ারিতে এখানকার ইস্কুল-আপিস ছুটি থাকত। কিন্তু আস্তে আস্তে সেই ছুটি উঠে গেল। আগে পয়লা বৈশাখে গেরস্তবাড়িতে কতকগুলি মাঙ্গলিক ক্রিয়াকর্ম হত। যার প্রথমটি হল গণেশপুজো। আজকাল যে সব বাড়িতে ব্যবসার চল আছে, কেবল তাঁরাই লম্বোদরের পুজো করেন। কিন্তু আমাদের সে সব না-থাকলেও গণেশদাদার ছবিতে ফুল-মালা দিয়ে, তাঁর সামনে যদুবাজারের ঠিক উল্টো দিকের গিরীশের দোকানে তৈরি গাওয়া ঘিয়ের উপাদেয় দরবেশের ভোগ চড়ানো হত। আমি যে সময়ের কথা বলছি সেটা ’৭৮-’৭৯। তখনও বাঙালির প্লেটে এবং পেটে অবাঙালি লাড্ডুরা জুত-মতো জায়গা করে নিতে পারেনি। আমাদের স্কুলের একটি ছেলেকে এক বার এই দরবেশকে এক আশ্চর্য নামে ডাকতে শুনেছিলাম— বোঁদে-পাকানো। কারণ, হলদে এবং লাল রঙের বোঁদে হাতের তেলোয় পাক দিয়েই তৈরি করা হয় দরবেশের গোলালো শরীর। এই যে হলদের ফাঁকে ফাঁকে টুকটুকে লাল রঙের ছোপ, তা হয়তো ফকির বা দরবেশের আলখাল্লার ডিজাইনের সঙ্গে একদমই মিলে যায়। আলখাল্লাটির নানা রং, জীবনের নানা রঙের আনন্দকেই তো প্রকাশ করে। আর ফকিরি বা দরবেশি গান শুনলে তার রেশ যেমন বহুক্ষণ মনের মধ্যে লেগে থাকে, তেমনই ওই দরবেশটি হাতে নিয়ে খাওয়ার পর, আঙুলে অনেকক্ষণ দেশি ঘিয়ের সুরভি লেগে থাকত। মজার ব্যাপার, সেই সময় বিভিন্ন ক্যালেন্ডারে গণপতির যত ছবি ছাপা হত, তাতে তাঁর হাতে থাকত দরবেশ, লাড্ডু নয়। পায়ের কাছে তাঁর পোষা ইঁদুরটিকেও একটি ভাঙা দরবেশ চাখতেই ব্যস্ত থাকতে দেখা যেত।
পয়লা বৈশাখের দিন সকালে বাড়িতে একটি বিশেষ ধরনের নতুন খাতা দেখতে পাওয়া যেত যার নাম ছিল খেরোর খাতা। খাতাটি লাল কাপড় দিয়ে বাঁধানো আর ওপর থেকে একটি সাদা মোটা টনসুতো দিয়ে জড়ানো। এই খাতাটির প্রথম পাতায় সিঁদুর দিয়ে আঁকা থাকত একটি ছোট্ট মাঙ্গলিক চিহ্ন। এই খাতাটিতে ওই দিন, মানে সাল-পয়লায় প্রথম জমা-খরচের হিসেব লেখা শুরু হত। লেখা শুরু করার আগে ফুল-ধান-দুব্বো দিয়ে পুজো করা হত। একসময় কৃষিজীবী বাঙালি চাষ করে ফলানো নানান জিনিস নিজেদের মধ্যে বদলা-বদলি করে সংসারের নানা জিনিসের চাহিদা পূরণ করতে শুরু করেছিল। চালের বদলে তেল, তেলের বদলে ডাল, ডালের বদলে মাছ— এই রকম আর কি। পরে এই দেনা-পাওনার হিসেবটা যাতে গুলিয়ে না যায়, তাই সেগুলো একটি খাতায় লিখে রাখা শুরু করেছিল। বছরের শেষে পুরনো খাতার হিসেব-নিকেশ মিটিয়ে, নতুন বা হাল (ফরাসি) খাতা খোলা হত পয়লা বৈশাখে। আমাদের বাড়িতেও এই খাতায় সংসারের নানারকম হিসেব লেখা হত বলেই আবছা মনে পড়ে। সকালবেলার এই খাতাপর্বটি চুকে যাওয়ার পর ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ছাতা মাথায় আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতে পৌঁছে যাওয়া হত পয়লা বৈশাখ করতে। আর গেলেই জুটত বাড়ির তৈরি চমৎকার সব মিষ্টি এবং নোনতা। বিজয়া দশমীর মতো সকলের সঙ্গে দেখা হওয়ার ও ভালোবাসা বিনিময় করার এটাও ছিল এক সুন্দর দিন। পয়লা বৈশাখেও আমাদের নতুন জামা-জুতো হত। কিন্তু বিজয়ার রীতিটি এখনও টিমটিম করে জ্বললেও, পয়লা বৈশাখের আনন্দময় আচারগুলো বাঙালিজীবন থেকে এখন একদমই যেন হারিয়ে গিয়েছে।
ছেলেবেলায়, সাদাকালো কলকাতা দূরদর্শনের তারকাখচিত ‘নববর্ষের বৈঠক’ ছিল অনবদ্য। একবার রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকের একটি অংশ পাশাপাশি বসে পাঠ করে শুনিয়েছিলেন বর্ষীয়ান অভিনেতা কমল মিত্র এবং কাননদেবী। সেই বয়সেও তাঁদের গলার মোচড় এবং কারুকাজ এখনও যেন কানে বাজে। নববর্ষের দিন দুপুরের পাতে যে সব বাঙালি পদগুলি রান্না হত তার মধ্যে পোস্তবড়ি-ছড়ানো শুক্তো, নারকেল দেওয়া সোনামুগের ডাল আর গরম গরম তপসে মাছের বেসনে-ডোবানো বড়ার কথা বড় বেশি করে মনে পড়ে। আর শেষপাতে অবশ্যই থাকত কাঁচা আমের থকথকে চাটনি। তখন বিশেষ বিশেষ দিনে বাড়িতে কলাপাতা কিনে আনার রেওয়াজ ছিল। তার ওপরেই সরু চালের ধোঁয়া-ওঠা গরম গরম ভাত বেড়ে দেওয়া হত, যার কোলের কাছে পড়ত দু’পলা ঘি। তখন একবারের জন্যও মনে হয়নি, এই ভাবে খাবার বেড়ে দেওয়ার মধ্যে কতটা আদর, কতটা ভালোবাসা এবং কতটা বাঙালিয়ানা লুকিয়ে রয়েছে। আজ যখন চারপাশটা ক্রমশ ফাঁকা হয়ে আসছে, তখন এ সবের জন্যে মনটা কেমন হু হু করে ওঠে।
তখন চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে ভবানীপুরের পদ্মপুকুর রোডের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বড়সড় একটা চড়কের মেলা বসত। পয়লা বৈশাখের দিন বিকেলবেলায় সেখানে যাওয়ার টান ছিল প্রধানত তিনটি কারণে। বাঁশের বেহালা, টিনের ঢোল আর দড়ি-বেঁধে মাটিতে গড়িয়ে নিয়ে চলা কটকটি খেলনার দু’একটাও যদি কেউ কিনে দেন। এই চড়কের মেলা থেকেই ন’জ্যাঠাইমা আমায় জীবনের প্রথম হারমনিকাটি কিনে দেন, যা নাগাড়ে সাত দিন প্যাঁ-পুঁ করে বাজাবার পর নিঃশব্দে দেহ রেখেছিল। কোনও বার পয়লা বৈশাখের বিকেলে হু হু করে ঝড় বইত। আসত শিলাবৃষ্টি। নতুন জামা-প্যান্ট পরে রেডি হয়ে বসেও চোখের জল ফেলতে হত। বৃষ্টি একটু দেরিতে থামলে সে দিন আর মেলায় না-গিয়ে বড়দের হাত ধরে বেরিয়ে পড়তাম ভবানীপুরের নানা দোকান থেকে আসা পয়লা বৈশাখের নেমন্তন্ন রক্ষা করতে, যার বেশিরভাগই ছিল গয়নাগাটির। সে দিন ওই দোকানগুলোর দরজার ওপরটা আমপাতা আর কদমফুলের ঝালর দিয়ে সাজানো হত। গিয়ে বসলে সেখানকার কোনও কর্মচারী কাচের ছোট সাইজের গেলাসে করে হাসিমুখে এগিয়ে দিতেন বরফকুচি ভাসানো আমপোড়ার উপাদেয় শরবত। কোথাও আবার দেওয়া হত ক্যাম্পাকোলা। কাচের বোতলে স্ট্র ডুবিয়ে চুকচুক করে সেই শীতল-অমৃত পানের আকর্ষণের কাছে জীবনের সব কিছুই যেন তুচ্ছ মনে হত। এর পর কোথাও কোথাও কাচের ছোট প্লেটে করে দু’রকমের মিষ্টি ও শিঙাড়া বা নিমকির মতো কোনও নোনতা খেতে দেওয়া হত অথবা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত কালো গার্ডার আটকানো ছোট সাইজের মিষ্টির বাক্স, সঙ্গে রোল করে গোটানো বাংলা মাসের ক্যালেন্ডার। মিষ্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডারের সংখ্যাটা নিশ্চিত ভাবেই ব্যক্তিগত খাতিরের ওপর নির্ভর করত। এখন বেশির ভাগ রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়ার শেষে একটি সুদৃশ্য স্টিলের পাত্রে মৌরি ও মিছরির কুচি মিশিয়ে পরিবেশন করার যে চল হয়েছে— সে সময় সুদৃশ্য কাচের পাত্রে করে তা এগিয়ে দিতে দেখেছিলাম এমনই একটি দোকানে।
তখন পয়লা বৈশাখের একাদশী-পূর্ণিমা দাগানো বাংলা ক্যালেন্ডারে যে সমস্ত ছবি ছাপা হত তার মধ্যে ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের বুকের ভেতরে মা-কালীর মুখচ্ছবি, জানলার ধারে ধূসররঙা জোব্বা পরে সদ্য লিখতে বসা রবীন্দ্রনাথ, তেজোদীপ্ত চোখ নিয়ে নেতাজি, নজরুলের সাইডফেস কিংবা নিজের মহিমায় উদ্ভাসিত গণেশ অথবা বিষ্ণু অবতার। দেবদেবীর মুখচ্ছবি মনের মতো হলে তার ‘প্রমোশন’ ছিল অবশ্যম্ভাবী। মানে, বছর ফুরোলেই নীচের মাসগুলিকে ছেঁটে ফেলে, বাঁধাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে তাঁদের ফ্রেম-বন্দি করে সোজা ঠাকুরঘরের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হত। ফি বেস্পতিবার তাঁদের গলায় জুটত ভেজা গাঁদা বা জবার মালা। মনে পড়ে এক বছর পয়লা বৈশাখে পাজামা-পাঞ্জাবির সঙ্গে আমার একটি শুঁড়তোলা টুকটুকে নাগরা হয়েছে। দু'দিন ধরে সেখানা বাড়িতে পরে ঘুরে ঘুরে দু’পায়ের দু’জায়গায় টুলটুলে ফোস্কা। তাই সে বার একটি হাতরিকশায় চড়ে আমি জ্যাঠাদের সঙ্গে দোকানে দোকানে গিয়ে নববর্ষের নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলাম। নাগরার কদর এবং দোকানের আদর— কোনওটাই তাঁরা শেষ পর্যন্ত বাতিল করে দিতে চাননি।
কার্টুন: দেবাশীষ দেব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy