অভিযান-এ শেষের দৃশ্যটি মনে পড়ে? শেঠজির ঘোড়ার গাড়ি থেকে গুলাবি লাফ মেরে নরসিংহের ট্যাক্সিতে উঠে পড়ছে... শট নেওয়ার সময় চারুপ্রকাশ ঘোষের (শেঠজি) দিকে একবার তির্যক তাকিয়ে তারপর লাফ দেন ওয়াহিদা। সঙ্গে সঙ্গে মুগ্ধ বিস্ময়ে সত্যজিত্ বলে ওঠেন ‘ঠিক এটাই করার কথা আপনাকে বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই আপনি করে ফেললেন।’ ওয়াহিদা রেহমান-এর এই অভিজ্ঞতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অমোঘ মন্তব্যটি মনে করিয়ে দেয়: ‘পরিচালক আদর্শ দর্শকের মতো অভিনেতার অভিনয় দেখেন’।
নাসরিন মুন্নি কবীর-এর সঙ্গে কথোপকথন-গ্রন্থটিতে ওয়াহিদা কবুল করেছেন সত্যজিত্ রায়কে প্রথম দেখার পর কী মনে হয়েছিল: ‘গগনচুম্বী ব্যক্তিত্ব। গভীর গলার স্বর, কথা বলেন একটা নির্দিষ্ট স্টাইলে।’ কী ভাবে যোগাযোগ হয়েছিল? ফিল্মফেয়ার-এর সম্পাদক বি কে করনজিয়া ওয়াহিদার বাড়িতে একজনকে পাঠিয়েছিলেন সত্যজিতের একটি চিঠি সঙ্গে দিয়ে, তাতে লেখা ছিল: ‘আমার প্রধান অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং ইউনিটের সদস্যরা বিশ্বাস করেন, আপনাকেই সবচেয়ে বেশি মানাবে গুলাবি চরিত্রটা, আমার পরবর্তী ছবির নায়িকা। আপনি যদি রাজি থাকেন, আমরা আনন্দিত হব।’ প্রথমে একটু দ্বিধাই ছিল ওয়াহিদার, একে বিশ্বখ্যাত পরিচালক, তায় ছবিটা বাংলা। আশ্বস্ত করেন সত্যজিত্, বিহার-বাংলা সীমান্তের মেয়ে গুলাবি, কথা বলে ভোজপুরি আর বাংলা মিশিয়ে, অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়। ওয়াহিদাকে চরিত্রটা বোঝানোই নয়, প্রতিটি দৃশ্যের স্কেচ এঁকে, কোন লেন্স ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও জানিয়ে রাখতেন সত্যজিত্।
একটি দৃশ্যে গুলাবির গান শোনানোর কথা নরসিংহকে, সসংকোচে ওয়াহিদা জানালেন, ‘আমি গাইতে জানি না, গলার স্বরও ভাল না।’ বোঝালেন তখন সত্যজিত্ ‘আমরা তো লতা মঙ্গেশকর কিংবা আশা ভোঁসলের গলা শুনতে চাইছি না, একটি গ্রাম্য মেয়ে গুলাবির গলা শুনতে চাইছি, আপনার গলাটাই স্বাভাবিক শোনাবে সেখানে। আপনি ভুলে যাচ্ছেন, আমার ছবি বাস্তবানুগ।’
ওয়াহিদার সাক্ষাত্কারের দীর্ঘ অংশ স্বাভাবিক নিয়মেই গুরু দত্তকে নিয়ে, সারাক্ষণ তাঁকে গুরুদতজি বলে সম্বোধন করেছেন ওয়াহিদা, পরিচালক-অভিনেতার সম্পর্কে তা নানা দিক থেকে আলো ফেলেছে। ওয়াহিদার কথোপকথনে, পঞ্চাশের দশকে তাঁর অভিনয়-জীবনের শুরু থেকে, নানান স্মৃতি ও ঘটনার সূত্রে হিন্দি ছবির একটা অলিখিত ইতিহাস যেন উঠে আসে বইটিতে। তাঁর অভিনীত ছবির তালিকার সঙ্গে দুর্লভ সব ছবি ওয়াহিদার, ফিল্মব্যক্তিত্বদের সঙ্গে এবং সপরিবার। ন’বছর বয়সে ভারতনাট্যম শিখছেন, বা তাঁর পঞ্চদশবর্ষীয় ছবিও আছে বইটিতে।
বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ নিয়ে রিঙ্কি রায় ভট্টাচার্যের আনটোল্ড স্টোরিজ-এর শুরুতেই বৈজয়ন্তীমালার ‘মেমরিজ অব মধুমতী’, লিখছেন ‘সিনেমার প্রতি নিবেদিত-প্রাণ আর কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন বিমলদা। মধুমতী চরিত্রটা নিয়ে তাঁর কল্পনাদৃষ্টি আমার মধ্যে এমন ভাবে বুনে দিয়েছিলেন যে আমার থেকে সেরাটুকু আদায় করে নিতে পেরেছিলেন।’ কারণ, ‘অভিনেতাদের সঙ্গে অনায়াসেই এক স্বচ্ছন্দ সম্পর্ক তৈরি করে ফেলতেন তিনি, আমাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাজটুকু আদায় করার আগেই।’— মনে হয়েছে বৈজয়ন্তীমালার। পরোক্ষে হলেও পরিচালকেরা অভিনেতাদের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করেন তারও একটা আন্দাজ পাওয়া গেল অমিতাভ বচ্চনের ‘আ ট্রিবিউট’ রচনাটিতে: ‘অনেকগুলি ছবিতে তো হৃষীদা (হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়) আর আমি একসঙ্গে কাজ করেছি, বিমলদার (বিমল রায়) প্রতিভার ভাবমূর্তি প্রায়শই যেন ফুটে উঠত আমাদের কথাবার্তায়। তাঁর গল্প-বলার সূক্ষ্মতা, সম্পাদনার একটা নির্দিষ্ট ধরন, আলোকসম্পাতের কোনও শৈলী, শট নেওয়ার আগে ক্যামেরা-কোণের কোনও বিকল্প বিন্যাস। সবটাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে শিষ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বলতেন— হৃষীদা।’
বিমল রায়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা রিঙ্কির স্মৃতির অনুষঙ্গে এ-বইয়ের ভূমিকায় উঠে এসেছে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বা নবেন্দু ঘোষের কথা, যাঁদের সাহচর্যে পঞ্চাশের দশক থেকে বিমল রায় এক নতুন বাস্তবতা নিয়ে এলেন বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। বইটিতে ‘ফ্রম দি আর্কাইভস’ বিভাগে তাঁর ফিল্মপঞ্জিটি সযত্নে সাজানো এই ভাবে: ‘বিফোর অ্যান্ড আফটার মধুমতী’ (শৌনক চক্রবর্তী-কৃত); রয়েছে ‘মধুমতী’র পরিচয়লিপি, পুরস্কারাদি, সলিল চৌধুরী সুরারোপিত তুমুল জনপ্রিয় গানগুলির লিপি, বুকলেট-এর সারাত্সার, রিভিউ। ‘আদার ভয়েসেস’ বিভাগে অমিতাভের সঙ্গে মৈথিলী রাওয়ের লেখা, ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে এ-ছবির স্থান নিয়ে। সঙ্গে ছবিটির পোস্টার, স্টিল, ছবি-সংক্রান্ত নানান স্থিরচিত্র।
বেশ মোটাসোটা একটা বই জুড়ে দিলীপকুমারের আত্মজীবনী। সেখানে বিমল রায়ের ছবিতে অভিনয় এবং অশোককুমার-সহ সে সময়ের বম্বের বাঙালি পরিচালক ও সাহিত্যিকদের সঙ্গলাভের সুবাদে ‘আমার হৃদয়ে বাংলা ভাষার প্রতি একটা দুর্বলতাই তৈরি হয়ে গিয়েছিল’, জানিয়েছেন দিলীপকুমার। ‘সাগিনা মাহাতো’ করার সময় দীর্ঘ অ্যাকাডেমিক আলোচনায় তাঁকে চরিত্র ও কাহিনির প্রেক্ষিত-সময়কাল বুঝিয়ে, অভিনয়ের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন তপন সিংহ, চাপিয়ে দেননি কোনও কিছু। ‘আমায় বলেছিলেন, আমি মুক্ত, আমার ইচ্ছেমতো আমি ইম্প্রোভাইজ করতে পারি। এমন এক জন পরিচালক ছিলেন তিনি, অভিনেতাকে প্রথমে চিত্রনাট্যটা ভাল ভাবে পড়ে এবং বুঝে নিতে বলতেন, তার পর তাকে বলতেন ইম্প্রোভাইজ করতে। কখনও পরিচালক হিসেবে নিজের গাইডলাইনটা অভিনেতার ঘাড়ে বোঝার মতো চাপিয়ে দিতেন না।’ দিলীপকুমারের স্মৃতিতে আজও তাই ‘সাগিনা মাহাতো’র অভিজ্ঞতা ‘জেনুইন প্লেজার’।
দীর্ঘ অভিনয়জীবন নিয়ে বলে গিয়েছেন উদয়তারা নায়ারকে, তাঁরই সুসম্পাদনায়, স্বচ্ছন্দ ভাষায়, নানান অধ্যায়ে গ্রন্থিত এই আত্মকথন। মুখবন্ধটি সায়রা বানুর। প্রচুর সাদাকালো-রঙিন ছবি, দিলীপকুমারেরর সঙ্গে কখনও ইন্দিরা গাঁধী, কখনও বা লতা মঙ্গেশকর। অভিনীত ছবির স্থিরচিত্র, পোস্টার, তালিকা, পুরস্কারপঞ্জি তো রয়েইছে। তাঁকে নিয়ে বলেওছেন বিভিন্ন ফিল্মব্যক্তিত্ব।
নাসিরুদ্দিন শাহের আত্মস্মৃতি ভিন্ন ধারার ভারতীয় ছবির ছেঁড়া ছেঁড়া পরিসর। তারকার স্মৃতি নয় বলেই তাঁর লেখনীতে রুপোলি পর্দার ঝলমলে একটেরে ইতিহাসটা চেপে বসেনি। বরং একটা ব্যক্তিমানুষকে চেনা যায় তাঁর ফেলে আসা দিনগুলির গোধূলিতে। সত্তরের মধ্যপর্বে সিনেমায় এই যে অসামান্য অভিনেতার আবির্ভাব, তাঁর স্মৃতিকথনে উলের সুতোর মতো জড়িয়ে গিয়েছে নৈনিতাল-আজমেঢ়ের ক্যাথলিক স্কুল, আলিগড় ইউনিভার্সিটি, পারিবারিক দিনকাল, বন্ধুরা, প্রেমিকা-স্ত্রী, দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা, পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, ওম পুরী, শাবানা আজমি, এবং অবশ্যই শ্যাম বেনেগাল। তরতাজা গদ্যে পড়তে বড় চমত্কার তাঁর এই স্মৃতির আখ্যানটি। তবে যতটা ব্যক্তিগত ইতিবৃত্ত ততটা অভিনেতা হয়ে-ওঠার ইতিবৃত্ত নয়, হয়তো সে আখ্যান পরে কখনও লিখবেন। বরং পড়তে-পড়তে তাঁর মত বা মন্তব্য নিয়ে তর্কও উঠতে পারে, কিন্তু মতান্তর থাকলেও এক সত্ অকপট ভণিতাহীন নাসিরকে চেনা যায়। আর এই আত্মস্মৃতি সততই সুখের নয় বলে মজা ও মাধুর্যের সঙ্গে তিতকুটে স্বাদও পাবেন পাঠক, ডার্ক চকলেট-এর মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy