রবীন্দ্রনাথের ‘খাতা’ গল্পটি অনেকেরই মনে থাকতে পারে, আবার এত বহুঘটিত এর বিষয়বস্তু যে মনে না থাকাও অস্বাভাবিক নয়। একটি ছোট মেয়ে তার নিজের একটি খাতায় নিজের মতো করে সাহিত্য রচনা করত। সে ছিল তার নিজস্ব জগত্। বিয়ের পর একেবারে অকারণ নিষ্ঠুরতায় তার গোপন জগত্টি নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ আর তার পর তার ‘বিদ্বান’ পতিদেবতার হাতে সে খাতার ধ্বংস। সমাজ ইতিহাসে অসংখ্য বার ঘটে যাওয়া এই গল্পটিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল কেবল এক পুরুষ লেখকের পরম স্নেহে চিত্রিত ওই অকারণ নিষ্ঠুরতার স্বরূপকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো। ১৮৯৩ সালে
প্রকাশিত এ গল্পের আগে, কিংবা পরেও বহু মেয়ের খাতা ছিঁড়ে ফেলা, পুড়িয়ে ফেলার বেদনাময় বিস্মৃতিতে ঢাকা পড়েছে। কিন্তু পঁয়ত্রিশ বছর পরের একটি মেয়ে সেই একই নিষ্ঠুরতার সামনে পড়ে নিজের লেখার খাতা ছিঁড়ে ফেলেনি, ছেড়ে দেয়নি লেখা। ‘বাড়ির বৌ’-এর লেখা বাইরে প্রকাশিত হলে ‘হাজার পুরুষ পড়বে, তার ওপর পত্রিকার পুরুষরা লেখা চাইতে বাড়ি ধাওয়া করবে, কথা বলবে— পতিদেবতা রাজি ছিলেন না এই অনাচার সহ্য করতে’ (পৃ ২২০)— এই নিষ্ঠুর সংকীর্ণতার মুখে দাঁড়িয়েও লেখা ছাড়েননি সেই মেয়ে। নিদারুণ মানসিক পীড়নের বিপক্ষে সেই ছিল তাঁর নিঃশব্দ বিদ্রোহ। কিংবা হয়তো বলা যায় তাঁর সমস্ত জীবন, তাঁর গোপন অথচ তীব্র আত্মপ্রকাশের সবটুকুই ছিল জীবনব্যাপী অবহেলার উত্তর, যেমন উত্তর দেয় শুষ্কভূমির পাথরের ফাটল থেকে উঠে দাঁড়ানো গাছ। এই গাছমানবীর নাম সম্পূর্ণা (১৯১১-’৮৬)। পর পর জন্মানো তিন মেয়ের কনিষ্ঠার এই নাম তার মা-বাবার দিক থেকে হয়তো ‘আন্নাকালী’র শীলিত সংস্করণ, কিন্তু নিজের বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে এ নামকে এক অন্য মর্যাদা দিয়েছিলেন নামধারিণী।
কলকাতার এমন এক পরিবারে সম্পূর্ণার জন্ম যেখানে সেই ১৯১১-১২ সালেও বাবার ছবি আঁকা ও মায়ের অসম্ভব রকম বইপড়ার নেশার জন্য বড় পরিবার থেকে ভিন্ন হয়ে আসা স্বস্তিদায়ক হয়। অথচ সেই পরিবারেই মেয়েদের স্কুল যাওয়া হয়নি, কেবল ছেলেরা গিয়েছে। সম্পূর্ণার ঠিক ওপরের দিদি ও তিনি অক্ষর শিখেছিলেন উল্টো দিক থেকে— দাদাদের স্লেট মাথার দিক থেকে দেখে দেখে। হ্যাঁ, সম্পূর্ণার সেই দিদির নাম আশাপূর্ণা। যাঁর সুবর্ণলতা আমরা আবার নতুন পাঠে পড়বার চেষ্টা করি সম্পূর্ণাকে জানবার পর। শৈশব-কৈশোরে বাড়ি ভর্তি অজস্র বই পড়তে পাওয়া দুই বোনকে কি প্রায় স্বাভাবিক ভাবে টেনে নেয় সাহিত্য রচনার দিকে? একে মেয়ে, তায় আবার পর পর তিন নম্বর, খুব একটা মনোযোগী সমাদরে কাটেনি হয়তো সম্পূর্ণা বা লক্ষ্মীর শিশুবয়স। অথচ মেয়েটি খুবই সংবেদী স্বভাবের। তার দিদিরা যখন পুতুল খেলে কিংবা ডানপিটেমি করে, ছোট সম্পূর্ণার সম্পর্কে নিজেই বলছেন পরবর্তী সময়ে, ‘অবহেলিত শিশু, খেলার উপকরণ বিশেষ ছিল না, সঙ্গীও ছিল না।’ ‘নিঃসঙ্গ আমি খাঁচার পাখির মতো ছোট্ট গণ্ডীর মধ্যে একলা ঘুরি ফিরি— হয়তো সেই নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হিসেবেই বেছে নিয়েছিলাম ওই লেখার খেলা— নিজেকে নিয়ে নিজের খেলা। উপকরণ সামান্য ফেলে দেওয়া কাগজের টুকরো, বাতিল হয়ে যাওয়া ছোট ভোঁতা পেন্সিল। (ভূমিকা-৪) আশাপূর্ণা বলছেন ‘তবে একটি খেলা ছিল তার সে হচ্ছে ছবি আঁকা। বাবা তাকে উদ্বৃত্ত খাতা পেন্সিল দিতেন কিছু, সে ঘাড় গুঁজে তাই নিয়েই বসে থাকত। আট বছর বয়স থেকে বেশ পাকা হাতে কবিতা লেখা সেই মেয়ে, পনের বছর বয়সে ‘মন্দাক্রান্তা ছন্দ’-এর পাশাপাশি যে লিখেছিল ‘আমি অনূঢ়া বঙ্গবালা/ বিরাজিত আমি প্রতি বাঙালির/ প্রতি গৃহ করি ‘আলা’... বরের জনকরূপী ক্রেতা দল/ রোজ ফিরে যান এসে/...হয়ত বা শোনো/ মাঝে মাঝে মোর/ কাপড়ে আগুনজ্বালা’ (পৃ ৪৮), পঞ্চদশী জীবন যার আশার আনন্দেও কম্পিত, ষোলো বছরে তার বিয়ে হয় ‘অলস, দরিদ্র’ উকিল পাঁচুদাস সেনের সঙ্গে। খাঁচার দরজা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ‘ভিতর দুয়ার’ যে কতখানি খোলা রেখেছিলেন ক্রমশ স্বয়ংসম্পূর্ণা হয়ে উঠতে থাকা কবি, তার কিছু কিছু মাত্র চিহ্ন তিনি নিজেই যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন বলে জানবার ভাগ্য হল আমাদের। ১৯৩১-এ জনক রোডের বাড়িতে বসে লিখছেন রেলের বাঁশিতে বেজে ওঠা নিমন্ত্রণের কথা, ‘আমি চেয়ে দেখি/ আমার জানলা লোহার গরাদ ঘেরা’ (পৃ ৬৯)। পাখা ঝাপটানোও ছিল। অন্য নামে পাঠানো কবিতাও ছাপা হয় পত্রিকায়। কিন্তু সে খবর জানাজানি হতে গৃহে প্রখর হয়ে ওঠে লাঞ্ছনা। তবু বেদনা, অসম্মান— কিছুই তাঁকে লেখা ছাড়াতে পারেনি। হয়তো একই বিষয়ের ওপর একই ভাবনায় আবর্তিত হয়েছে তাঁর লেখা, কিন্তু তা ছাড়া উপায় বা কী ছিল? তিনটি সন্তান আর সংসারের শক্ত বেড়ি ছাড়া যাঁর জুটেছে কেবলই অবহেলা আর অসম্মান— তার পক্ষে? তবু সেই বিষয়ের প্রকাশেই উঠছে কত রকম ছোটবড় তরঙ্গ। ‘রাম যদি নাই/কার ভরসায় সীতা যাবে বনবাসে/কোথায় সে নল দেবতার দল ঈর্ষা করিবে যায়?’ (পৃ ৭৮) তবু সমসাময়িক ঘটনা দেখা দিয়েছে কবিতায়। কখনও অস্ফুট কোনও মুহূর্তপুলক ‘পথে যেতে যেতে ধুলোর মধ্যে কুড়িয়ে পেয়েছি সোনা/জানবে না কেউ কী পেয়েছি আর কোথা সে লুকানো আছে’ (পৃ ১০০)। ঝিকিয়ে উঠেছে তির্যকতার ঝিলিক। তিক্ততার বিষ যখন চলকে ওঠে কবিতায় ‘পূর্বরাগ ভালোবাসা/ষাট ভাগ কল্পনা, চল্লিশ ভাগ আশা/ হাতে থাকল চোখের জল/ সারাপথের সম্বল’ (পৃ ৯৭), ‘দাম্পত্য বন্ধন? জবরদস্তি গেরোর/নিরুপায় ক্রন্দন’ (পৃ ৯৮)। পাঠক আজও চমকিত, মুগ্ধ হই ছন্দ ও প্রকরণের ওপর তাঁর দখল দেখে।
আর যেখানে আজও আমরা বিহ্বল হয়ে থাকি তা সম্পূর্ণার ছবি। কোনও তুলনার কথা না ভেবেও মনেই পড়ে অবরুদ্ধ বেদনা ফেটে পড়া আগুনে রঙের ঝলকের কথা। ‘সমাজদেবতা’র মতো তীব্র প্রকাশ, ‘যখন একলা’ ‘রামধনু দিনগুলি’ সহ পোর্ট্রেটগুলির রেখাবিন্যাস কুশলতা আর তারই পাশাপাশি যেন সমস্ত ব্যর্থ জীবনের শাসনের বিরুদ্ধে ফেটে পড়া বিদ্রোহ— ‘অবোধ পাপ’, ‘উন্মাদ মন’, ‘অবরুদ্ধ শোক’, ‘দুরন্ত ফাল্গুন’-এর মতো ছবির পর ছবি। বন্দি বিহঙ্গীর ডানা সম্পূর্ণ মেলে দেওয়া। উধাও আকাশের দিকে তার উড়াল। এই শিল্পীর আরও ছবি দেখা যাবে না, সেই আফশোস সত্যি গভীর।
জীবন যা কিছু দিতে পারে তার সব আয়োজন ছিল শুধু পুরুষতন্ত্রের অর্থহীন শাসনে তা এমন নিদারুণ ব্যর্থ হল! এমন এক কবি-শিল্পী একেবারে অজানা রয়ে গেলেন এমনকী মর্মান্তিক মৃত্যুরও তিন দশক পর পর্যন্ত! ‘বাইশ বছরের বিবাহিত জীবনের সমাপ্তির পর আবার ক্রমে আরম্ভ হয় সাহিত্যরচনা’, বলছেন তাঁর ছোট ছেলে শুভজ্যোতি (পৃ ২২০)। তখন সম্পূর্ণা মাত্র আটত্রিশ। তাঁর জীবনের বাকি তিন দশকের মধ্যে কেউ উদ্যোগী হননি এই লেখা বা ছবিগুলি উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়ে অন্তত কোথাও পৌঁছে দেওয়ার? একটু ক্ষোভের সঙ্গেই মনে আসে এই হতাশা। ১৯৮৬ সালে চূড়ান্ত হতাশায়, অভিমানে নিজের বাঁচা শেষ করে দিচ্ছেন এই একলা পথচারিণী। তত দিনে তো এমনকী কলকাতা শহরেও চর্চা শুরু হয়ে গেছে মেয়েদের লেখালিখি নিয়ে। নগরজীবনের মাঝখানে থেকেও যে এমন লুপ্ত হয়ে থাকতে পারেন কোনও সৃজনকারিণী, অন্যথায় যিনি হয়তো হয়ে উঠতেন বাংলার প্রধান লেখিকা বা শিল্পীদের এক জন, এ কথা বিশ্বাসই হত না সাবিত্রী রায়ের কথা না জানলে। কল্যাণী চক্রবর্তী সেই উত্তরকন্যা একমাত্র যাঁর কাছে সারা জীবনে কিছু দিন অন্তত, গভীর মানসিক শান্তি পেয়েছিলেন সম্পূর্ণা, যাঁর হাতে দিয়েছিলেন নিজের রচনার কিছু অংশ। তার পরও তিন দশক অপেক্ষা করতে হল ওই অসাধারণ কবিতা ও ছবির সম্ভারকে প্রকাশ পাওয়ার জন্য। পাঠকদের কষ্ট বাড়ে যখন দেখা যায় প্রিয় আত্মজনেরা সকলেই জানতেন সম্পূর্ণার সৃষ্টি এবং সম্পূর্ণার দহনের কথা। তবু এত নিঃসঙ্গ অবহেলা যে শেষ পর্যন্ত ছিয়াত্তর বছর ধরে বেঁচে থাকা এক কবি নিজের শরীরে জ্বেলে দেন আগুন। একাকীত্বে থেকে এ ভাবেই মুক্তি নিতে হয় সেই মেয়েকে যাঁর সম্পর্কে তাঁর আত্মজনেরাই বলেছেন ‘চিরদিনের অভিমানী’ ছিলেন। মুখ ফুটে জীবনভর কোনও অবহেলার প্রতিবাদ না করা মানুষীর ‘দুর্জয় অভিমানই নিঃশেষ করে দিল জীবনটাকে’। (পৃ ২২৩)
হয়তো সে কথাই সত্য যে জীবনের ধন ফেলা যায় না কিছু। তাই এত কাল পর, সম্পূর্ণার লেখা শুরু হবার নব্বই বছর পর তাঁর উত্তর প্রজন্ম প্রকাশ করলেন এই রচনা মঞ্জুষা। আর সেই প্রকাশটি তাঁরা করেছেন খুব যত্নে। সজ্জা, ছাপা, কাগজ, বাঁধাই ছাড়াও সম্পাদনার যে খুঁটিনাটি কাজ—নির্ঘণ্ট তৈরি, কবিতার প্রতিটি পর্যায় শুরুর আগের পৃষ্ঠাটিকে সুন্দর বিন্যস্ত করা, সবের মধ্যে মুন্সিয়ানা ছাড়াও স্পষ্ট ভালবাসার ছাপ। বড় মনোবেদনা নিয়ে চলে যাওয়া এই পূর্বমাতৃকাকে যদি পাওয়া যেত পঞ্চাশ বছর আগে, বুঝি সে কালের মতো আদর করে চুল আঁচড়ে, টিপ পরিয়ে, পরিষ্কার বিছানায় বসিয়ে তাঁর কাছে বসে তাঁর লেখা শোনার মতো। যেমন চেয়েছিলেন সম্পূর্ণা—
‘ছোটঘর
নেওয়ারের খাট একখানা
খানকত ভালো বই
আর একটা লেখবার খাতা
এতেই তো বেশ চলে যায়’ (পৃ ১০১)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy