বাঙাল বাড়িতে বড় হয়ে ওঠার সুবাদে ‘পার্টিশন’ শব্দটি বাংলা শব্দ বলেই মনে করতাম। তাই দেশভাগ নিয়ে দু’টি বই হঠাত্ই হাতে চলে আসায় কিছুটা কৌতূহল হল— ফেলে আসা ‘দেশ’-এর গল্পকথার ছোটবেলার অনুষঙ্গ, যা আজ অনেক দূরের হয়ে গেছে, তা হয়তো কিছুটা ফিরে দেখা যাবে।
প্রথমেই আসা যাক নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিদ্যালয় আয়োজিত দেশভাগ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে পঠিত প্রবন্ধের সংকলনটিতে (পার্টিশন-সাহিত্য)। ‘বিভাজন সাহিত্য’ শব্দবন্ধটির পরিবর্তে ‘পার্টিশন সাহিত্য’ শব্দবন্ধের ব্যবহার নিয়ে সম্পাদকের ব্যাখ্যা, ‘পার্টিশন’ শব্দটির গায়ে যে ‘কলোনির কান্না-ঘাম-রক্তের বাস’, তা বিভাজন শব্দটিতে নেই। বইটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি জানাচ্ছেন, তথাকথিত ‘হাই পলিটিক্স’-এর বিশ্লেষণের পুনরাবৃত্তি থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর ইতিহাসে এই সর্ববৃহত্ উদ্বাসনের ঘটনা সাধারণ মানুষের চেতনা, মননে যে গভীর আলোড়ন, অস্থিরতা এবং ভয়াবহতা সৃষ্টি করেছিল এবং যার জের আজও ভারতবাসী টেনে চলেছেন, তাকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা।
প্রবন্ধগুলো বিষয়গত ভিত্তিতে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম, ‘পার্টিশন সাহিত্যের সন্ধানে’। এ অংশের প্রবন্ধগুলো ভারত ব্যবচ্ছেদ ঘিরে যে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এবং হয়ে চলেছে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তার বিশ্লেষণ। এই অংশে দেবেশ রায়ের উপস্থাপনাসূচক প্রবন্ধটি অবশ্য কিছুটা অন্য ধাঁচের। আলোচনা চক্রটির বাংলা এবং ইংরেজি প্রস্তাবনার একাধিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনা নিয়ে তিনি কিছু কূটতর্কের অবতারণা করেছেন, যা তাঁর ভাষায় ‘জল ঘোলা করা’। একই সঙ্গে দেশভাগ সংক্রান্ত বর্তমান গবেষণার ধারার কিছু দিক সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন, যা থেকে চিন্তার মূল্যবান রসদ মেলে। যেমন, তিনি সমালোচনা করেছেন সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চায় মার্কিন বিদ্যা চর্চার কেন্দ্রগুলির প্রথানুযায়ী ‘দক্ষিণ এশিয়া’ নামক এক কাল্পনিক ভূখণ্ডের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভাজনের অতিনির্দিষ্টতাকে বিলীন করার প্রবণতাকে। তবে নানা কূটতর্ক দিয়ে শুরু হলেও আলোচনা পরিশেষে কিন্তু মস্তিষ্ক নয়, হৃদয়কেই ছুঁয়ে থাকে। দাঙ্গা, উদ্বাসন, হিংস্রতার বিবরণ তিনি এ কথা দিয়েই শেষ করেন যে, ভারতীয় উপনিবেশের ইতিহাসে দাঙ্গাবিধ্বস্ত সমাপ্তিই একমাত্র সত্য নয়, দু’শো বছরের প্রতিরোধের ইতিহাসও সমান সত্য এবং এই দুই সত্যের সমন্বিত স্মৃতির মধ্য থেকেই তৈরি হয়েছে এবং হবে ভবিষ্যতের রূপরেখা।
দেশভাগ বিষয়ে একগুচ্ছ বাংলা ছোটগল্পের অনুবাদ করে সংকলন করেছিলেন বাসবী ফ্রেজার। তাঁর আলোচনা সেই সংকলন নিয়েই। বাসবী দেখিয়েছেন, নবেন্দু ঘোষ, গৌরকিশোর ঘোষ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, জ্যোতির্ময়ী দেবী, সকলের গল্পেই দেশভাগের স্মৃতি, মর্মবেদনার মধ্যে ঘুরেফিরে আসে হঠাত্ গড়ে ওঠা এক ‘না-আত্মবোধ’। নানা তাত্ত্বিক প্রসঙ্গে ভারাক্রান্ত লেখাটির ফাঁকে ফাঁকে এই মর্মস্পর্শী গল্পগুলোর উল্লেখ মূল সংকলনটি সম্পর্কে কৌতূহল জাগায়। সেলিনা হোসেন সাহিত্যের আরও বিস্তারিত, বহুমাত্রিক ক্যানভাসে এই বেদনার স্মারকগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সালমা বাণী লিখেছেন দেশভাগের সাহিত্যে ‘নির্যাতিত অংশের প্রতিনিধি’ হিসেবে নারীর অবিরত প্রতীকায়ন বিষয়ে। বাসুদেব দাসের অসমিয়া ও বাংলা সাহিত্য-নির্ভর আলোচনায় এসেছে পার্টিশনের অভিঘাতে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অসমের জটিল সামাজিক বিন্যাসের জটিলতর হয়ে ওঠা এবং সে সূত্রে পরবর্তী কালের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, বরাক উপত্যকার অভিবাসীদের লাঞ্ছনা, অসম আন্দোলন ইত্যাদি প্রসঙ্গ। শ্যামল ভট্টাচার্য বাংলা এবং পঞ্জাবের বিভাজনের সাহিত্যের তুলনা করে জানিয়েছেন যে, পঞ্জাবি সাহিত্যে গণহত্যা, দাঙ্গা, নারীর অপহরণ নির্যাতনের ঘটনা দেশভাগের সঙ্গে সমার্থক হয়ে গিয়েছিল, তুলনায় বাংলা সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা, বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে উঠে উন্নততর চেতনার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বার বার এসেছে শ্রমজীবী মানুষের ক্ষমতার কথা। এ বিভাগের রচনাগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং মনোজ্ঞ। কিন্তু বেশ কিছু রচনায় ভাষার অস্বাচ্ছন্দ্য এবং অস্বচ্ছতা পাঠককে ব্যাহত করে। কারণ কি তাত্ত্বিক বিষয় ইংরেজি থেকে অনুবাদের প্রবণতা?
দ্বিতীয় বিভাগ ‘দেশ কাল’-এ সাধন চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিবসন্তপা কুণ্ডু বা মোঃ চেঙ্গীশ খানের আলোচনায় সাহিত্যের প্রসঙ্গ এলেও, মূল ঝোঁক থেকেছে দ্বিবিধ গোষ্ঠীচেতনা গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত, অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধর্মের কারবারিদের ভূমিকা, রাজনীতি জাতীয় বিষয়। ত্রিদিবসন্তপা কুণ্ডুর আলোচনায় পাওয়া যায় এ সংক্রান্ত ‘সাবঅলটার্ন’ এবং নারীবাদী আধুনিক গবেষণার ধারায় ভিন্নতর এবং অ-প্রথাগত তথ্যসূত্র খোঁজার চেষ্টা এবং এর মধ্যে দিয়ে অবদমিত কণ্ঠস্বর শ্রুতিগোচর করার প্রয়াসের পর্যালোচনা।
ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ-ভিত্তিক তৃতীয় ভাগটি অন্য বিভাগগুলোর তুলনায় অনেক বেশি হৃদয়স্পর্শী। যাঁরা ‘বিষাদবৃক্ষ’ পড়েছেন, তাঁরা আন্দাজ করে নিতে পারবেন মিহির সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণের অন্তরঙ্গ এবং বিষাদের সুরটি। সুনন্দা সিকদারের স্মৃতিচারণ যদি মনকে স্পর্শ করে, সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভয়াবহ’ স্মৃতিকথার স্মৃতিচারণ বা যতীন বালার উদ্বাস্তু ক্যাম্পের নরকযন্ত্রণার কথা পড়ে মনে হয় যে বিস্মরণেই মানুষের মুক্তি।
চতুর্থ ভাগ ‘অন্য দেখা’ হিন্দু-মুসলমানের বৈপরীত্য-ভিত্তিক প্রচলিত দেশভাগের আখ্যানে কয়েকটি তুলনায় উপেক্ষিত বিষয়ের দিকে নজর ফেরায়। যেমন, মৃন্ময় প্রামাণিক যেখানে তুলে ধরেন নমঃশূদ্র জাতির বিপর্যয়ের কাহিনি, জ্যোতির্ময় রায়চৌধুরির রচনায় উঠে আসে আন্দামানে পুনর্বাসিত সমাজের পত্তন, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে আদানপ্রদানের মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় গড়ে ওঠা। আবার অভিজিত্ সাধুখাঁ ও অভিজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে এসেছেন এক অতি পরিচিত প্রসঙ্গ, ‘ঘটি বাঙালের’ তরজা। খোঁজার চেষ্টা করেছেন ‘ঘটি’ শব্দটির উত্পত্তি, বিবর্তন, দেখিয়েছেন ‘বাঙাল’ শব্দটি ঘিরে ছড়ায়-লোককথায় শ্লেষের প্রাচুর্য।
এ ছাড়াও বইটিতে আছে দু’টি পরিশিষ্ট— বিভাজনের মানচিত্র ও ১৯৬৪-র মার্চ থেকে ১৯৪৭-এর ১৫ অগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক ঘটনাবলির একটি তালিকা।
দ্বিতীয় বইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ আয়োজিত ‘উজ্জীবনী পাঠমালা’য় প্রদত্ত বক্তৃতার সংকলন। বইটির বেশির ভাগ লেখা বাংলায় হলেও দু-তিনটি ইংরেজি প্রবন্ধ আছে। লেখকদের অনেকেই আলোচিত অন্য বইতেও লিখেছেন। এ বইয়ে প্রবন্ধগুলির কোনও বিষয়ভিত্তিক ভাগ করা হয়নি। সাতাশটি প্রবন্ধে নানা প্রসঙ্গ এসেছে, যার মধ্যে অনেক পুনরাবৃত্তি আছে। তাই, কয়েকটি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য প্রবন্ধ নিয়েই এখানে আলোচনা করা হল।
দেশভাগের আলোচনায় মেয়েদের প্রসঙ্গ সাধারণ ভাবে ব্যক্ত হয় তাদের যন্ত্রণা, অসহায়ত্ব ও নানা রকম দুর্ভোগের নিরিখে। অথচ অশ্রুকুমার সিকদার দীর্ঘ আলোচনায় দেখিয়েছেন উদ্বাস্তু জীবন কী ভাবে বস্তুত মেয়েদের সামনে মুক্তির পথ খুলে দেয়। যে-সব হিন্দু মেয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসেন, বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই তাঁদের জীবনে অনেক প্রথাগত সংস্কার শিথিল হয়ে আসে। আবার অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে সম্পন্ন ও শিক্ষিত অনেক মুসলমান মহিলা পূর্ববঙ্গে চলে যাওয়ায় নেতৃত্বহারা এখানকার মুসলমান মেয়েরা অনেকটাই অনগ্রসর থেকে যায়। লেখক তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থন খুঁজেছেন সমকালীন এবং পরবর্তী সাহিত্যে। দেশভাগ ও বাংলা সাহিত্য নিয়ে অলোক রায়ের প্রবন্ধটি অত্যন্ত মনোজ্ঞ ও সমৃদ্ধ। দেশভাগ বিষয়ে সত্যপ্রিয় ঘোষের রচনা খুব কমই তার প্রাপ্য গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। রুশতী সেন তাঁর প্রবন্ধে এই অবহেলা পাঠকদের নজরে আনলেন। সুশীল সাহার ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্র নিয়ে প্রবন্ধে তানভীর মোকাম্মেলকে পাঠানো প্রশ্নাবলি এবং মোকাম্মেলের উত্তর এই সংকলনটি থেকে অন্যতম প্রাপ্তি। এ ছাড়াও দেশভাগ ও বাংলা নাটক নিয়ে দর্শন চৌধুরির ‘দেশভাগ ও বাংলা নাটক’, কৃষ্ণা সেনের ‘রিপ্রেজেন্টেশন্স অফ দ্য পার্টিশন ইন ইন্ডিয়ান ইংলিশ ফিকশন’, রতন খাসনবিশের ‘নমঃশূদ্র রাজনীতি ও যোগেন মণ্ডল’ প্রবন্ধগুলি উল্লেখযোগ্য। তবে, বইটি ছাপার ভুলে ভর্তি। বইটির বিন্যাস ও পরিবেশনায় সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপের অভাব চোখে পড়ে।
ইংরেজিতে থাকলেও, বাংলা ভাষায় বিভাজন সংক্রান্ত এ জাতীয় প্রবন্ধসংকলন বিরল। বই দু’টি এ অভাব অনেকটা মেটাল।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লেখ্যাগারের অধিকর্তা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy