মাতৃভাষায় আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার সুফল ব্যাপক পাঠককুলের কাছে পৌঁছে দেওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। সুশীল চৌধুরীর গ্রন্থটি সেই ধারায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এটি এক দিকে এক বহু ভাষাবিদ লেখকের গবেষণার ফসল ও অন্য দিকে বাঙালির একদা বিখ্যাত কুশলতা-নির্ভর ও অতি-মহার্ঘ বস্ত্রশিল্পের বর্ণাঢ্য বর্ণনা। দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ লাভজনক অংশ হিসেবে চিহ্নিত এই শিল্পের সমস্ত প্রক্রিয়ার নিপুণ ছবি এতে ফুটে উঠেছে।
বইটিতে বিস্তারিত তথ্যসূচি ও মূল সূত্রের উল্লেখ থাকায় পাঠকের পক্ষে প্রয়োজনে সেগুলি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। গ্রন্থকার কুশলতার সঙ্গে বিভিন্ন ভাষার তথ্যের সমাহারে অতীব পাঠযোগ্য ও মননশীল গ্রন্থ রচনা করে বস্ত্রশিল্পের নানা অংশকে আলোকিত করেছেন। বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি নানা পন্থায় বাংলার তাঁতিদের উত্পাদিত সামগ্রী সংগ্রহ করে ইউরোপে রফতানি করত। নানা দেশের অভিলেখাগারে রক্ষিত সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে পলাশির আগের ও পরের পার্থক্য তিনি দেখিয়েছেন, যাতে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব থাকলে কত সুবিধে পাওয়া যায় তা স্পষ্ট হয়েছে। অন্য দিকে, ইউরোপীয় কোম্পানিদের কর্তৃত্ব থাকলেও বস্ত্রশিল্পে তাদের মোট লগ্নি এশীয় বণিকদের তুলনায় অনেক কম ছিল। তাঁর এ বক্তব্য সুপরিচিত। এখানে তিনি বস্ত্রশিল্পের এক বহুমাত্রিক রূপকে তুলে ধরেছেন, যার এক দিকে ছিল অতি নগণ্য সরঞ্জাম ব্যবহারকারী তাঁতি ও তার পরিবার এবং অন্য দিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লিপ্ত নানা বিদেশি কোম্পানি। তা ছাড়া উত্পাদিত পণ্যের এক দিকে ছিল অতি মহার্ঘ মসলিন, যা মোগল সম্রাটদের দ্বারা আদৃত আর একেবারে নীচের তলায় সাধারণের মোটা কাপড়। কোম্পানিরাও মসলিন বেশি কেনে না, কিন্তু মহার্ঘ রেশমি কাপড়, চমত্কার মিহি ও সুতি কাপড় থেকে মোটা কাপড় কিনে নিয়ে যেত। বিপুল এই বস্ত্র বাণিজ্যের জন্য বাংলার তাঁতশিল্পকে লেখক ‘পৃথিবীর তাঁতঘর’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবু আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মসলিন, যে-নামটি এসেছে আজকের মধ্যপ্রাচ্যের মসুল থেকে। ফলে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে গড়া এই বস্ত্র নামেতেও বিদেশি জেনে হরিষে বিষাদ হয়। দু’টি মূল্যবান তালিকা দেওয়া আছে, যার একটি ইরফান হাবিবের তৈরি ও দ্বিতীয়টি গ্রন্থকারের অতি বিস্তারিত তালিকা— যা থেকে মসলিনের বৈচিত্রের রূপ বোঝা যায়। তাঁর লেখা থেকে মসলিনের সঙ্গে জাহাঙ্গিরের যোগ যেমন জানা যায়, তেমনই দামও উঠে আসে। এ ছাড়া লেখক জানান যে, এই মহার্ঘ বস্ত্রের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মানের তুলো পাওয়া যেত ঢাকার অদূরে বংশী নদীর ধারে। তৈরি হত বিভিন্ন আড়ংয়ে, যাদের প্রতিটির নিজস্ব শিল্পকুশলতার ছাপ থাকত, এমনকী বিশেষ কুশলী ধোবা ছাড়া এগুলো ধোওয়া বা বাজারজাত করা যেত না। এই জটিল প্রক্রিয়াটি অবশ্য সম্পন্ন হত সস্তা চালাঘরে, কার্যত কোনও যন্ত্র ছাড়া। লেখক দেখাচ্ছেন যে, তাঁতি নিজে মসলিন তৈরি করে স্বাধীন ভাবে ক্রেতা ঠিক করত, যদিও পলাশির যুদ্ধের পরে অবস্থাটা একেবারে বদলে যায়। এ ছাড়া, তাঁতি পরিবার-সর্দার তাঁতি-ক্বচিত্ ব্যবসায়ী এই বিন্যাস বজায় ছিল। এ দিয়ে ক্রমাগত ব্যবসা বৃদ্ধির ফলে যে বিপুল অর্থ আমদানি হল, তাতেও তাঁতির জীবনের মান বাড়ল না। তারা টিকে থাকল দারিদ্র থেকে ‘তথাকথিত দারিদ্রের’ মধ্যে। সে ক্ষেত্রে এই শ্রীবৃদ্ধি কাদের ভাগে পড়ল?
বাণিজ্যের বিস্তারিত ও আকর্ষণীয় বর্ণনা সুস্পষ্ট হয়েছে ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানিদের বাণিজ্যের তালিকায়। প্রতিতুলনায় ফরাসিরা আড়ালে থেকে গেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উত্পাদনের ক্ষেত্রে উন্নত মানের নুরমা বা বোগ্গা তুলো হত, যা থেকে উত্কৃষ্ট মানের নয়নসুখ ও বদনসুখ জাতের মসলিনও তৈরি হত।
বাংলার বালুচরি। বই থেকে
অন্য দিকে, উত্পাদনের ক্ষেত্রে মাত্র কয়েকটি স্তরে বিভক্ত তাঁতিদের কথা আলোচনায় উঠে এলেও জাতে তাঁতি ও জাতে তাঁতি আসলে বণিক তাঁতিরা যথোচিত গুরুত্ব পায়নি। কলকাতার বসাকরা যেমন আসলে বণিক জাতে তাঁতি, তেমনই কাশিমবাজার ও অন্যত্র অত্যন্ত প্রতিষ্ঠিত কাটমা বণিকরা জাতে তাঁতি হলেও আসলে সম্পন্ন ব্যবসায়ী। এগুলো এক দিকে সামাজিক গতি বুঝতে যেমন সাহায্য করে, তেমনই সমাজ যে অসম্ভব অনড় ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতেও তা ঠিক নয়, বোঝা যায়। শুধু কাটমারাই নয়, নানা জাতের লোকই বস্ত্র ব্যবসায়ে যুক্ত ছিল দেখা যায়। আর এক ধরনের ব্যবসায়ীরাও আড়ালে থেকে গেছেন। গড়া/গারা কাপড় যদিও ডাচ ও ইংরেজদের ব্যবসার প্রায় কুড়ি শতাংশ ছিল, তবুও এর নিজস্ব ব্যবসায়ের বিস্তৃত জাল গড়ে তুলে বীরভূমের এক বস্ত্র ব্যবসায়ী পরিবার অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। এরা হল বীরভূমের সুরুল গ্রামের সরকার পরিবার। এই পরিবার গড়া কাপড়ের ব্যবসার দেখভাল করার জন্য বামুন কর্মচারী রাখে, যাঁরা বিশেষজ্ঞ। এরা শুধু গড়া কাপড়ের ব্যবসাই নয়, নীল ব্যবসাতেও যুক্ত ও অন্য দিকে জমিদারও বটে। কাশিমবাজারের রেশম বণিক বা অন্য বণিকদের কথা যেমন সোমেন্দ্রচন্দ্র নন্দী লিখেছিলেন, তেমনই পঞ্চানন মণ্ডল চিঠিপত্রে সমাজচিত্র সংকলনে সরকার পরিবারের দলিল থেকে চিঠি প্রকাশ করে অতীব গুরুত্বপূর্ণ আকরের দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এঁরা হাজার হাজার গড়া কাপড় অভিজ্ঞ ধোপাদের দিয়ে কাচিয়ে গড়া কাপড় ‘খাড়া’ করতেন কলকাতার গুদামে। জহুরি বস্ত্র ব্যবসায়ীরা পর্যবেক্ষণ করবেন এই আশায়। আবার তারা সোজাসুজি জাহাজ ধরার অপেক্ষাও করেন। মনে রাখতে হবে, বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ছোট নদী দিয়ে বর্ধমানের কাটোয়া বন্দরে কাপড় এনে সোজা গঙ্গা বেয়ে কলকাতায় বড় বাণিজ্যের হাটে এসে যাচ্ছে। একটি পরিবার গোটা পদ্ধতিটা নিয়ন্ত্রণ করছে, যা সহজে চোখে পড়ে না। সব সময়ে ভাল দাম পাওয়া যায় না। এরা গ্রন্থকারের অপেক্ষায় রয়ে গেল।
এত উন্নত মানের মুদ্রণ, অক্ষর বিন্যাস সত্ত্বেও গ্রন্থপঞ্জিতে ইরফান হাবিবের নাম Infan হয়ে আছে। স্টাভোরিনাস ১৭৭০-এর দশকে বাংলায় যেমন এসেছিলেন, তেমনই ১৭৬০-এর দশকেও এখানে এসেছিলেন। কিছু খাঁটি বাংলা স্থান নাম ইংরেজি ধাঁচে কেন ছাপা হয়েছে বোঝা গেল না। যেমন ‘কগমারিয়া’ (কাগমারি) বা ‘কসাজুরা’ (কাশীজোড়া)।
এই অসাধারণ গ্রন্থটিতে বাংলার কুশলী, কৃতী তাঁতিদের যে ছবি লেখক এঁকেছেন তাতে যোগ্যতার দাম পাওয়া যে এখানে দুষ্কর এটাই ফুটে উঠেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy