এ দেশ তো বটেই, বাকি দুনিয়াটাই এখন আর জনপ্রিয় হিন্দি ছবিকে ভারতীয় সিনেমার পরিচয়ে মানছে না, ‘ভারতীয়’ লেবেলটা তুলে সেখানে এঁটে দিচ্ছে ‘বলিউড’। অভারতীয়রাও এতে ভারতকে জাতি বা রাষ্ট্র হিসেবে দেখছে না, আদরণীয় ‘এন্টারটেনমেন্ট’ হিসেবেই নিয়েছে। আবার অনাবাসী ভারতীয়রা তাতে খুঁজে নিচ্ছে ‘ভারতীয়তা’। জনপ্রিয় হিন্দি ছবির আগে যে ‘মেনস্ট্রিম’ বিশেষণটা লাগানো হত, সেটাও উঠে গেছে, কারণ বলিউড যে মূল ধারা তা তো বলাই বাহুল্য, আর ‘পপুলার’ তো বটেই। এম কে রাঘবেন্দ্র মনে করেন, এতে মদত জোগাচ্ছেন যে সব ‘কালচারাল ন্যাশনালিস্ট’, তাঁরা সব সময় ভারতবাসী না হলেও নিশ্চিতই ভারতীয়। কেন এমনটা ঘটল, কী কী ঘটল, এখনই বা কী ঘটছে, তারই বিশ্লেষণ তাঁর নতুন বইটিতে: দ্য পলিটিক্স অব হিন্দি সিনেমা ইন দ্য নিউ মিলেনিয়াম।
ভারতীয় জাতিসত্তাকে এই ‘বলিউড’ এমন একটা ‘কমিউনিটি’ বা সম্প্রদায়ের আদলে দেখায়, সেখানে বহুস্তরীয় আঞ্চলিকতা, শ্রেণিবৈষম্য, পুরুষশাসন, সবই চাপা পড়ে যায়। সেখানে ভারতীয়দের একটাই পরিচয়— একমাত্রিক সম্প্রদায়। ‘আ পিরিয়ড অব ট্রানজিশন’ উপ-অধ্যায়ে রাঘবেন্দ্র নব্বই দশক থেকে তুলে এনেছেন ‘গ্লোবাল’ দর্শকদের জন্যে তৈরি ‘হাম আপকে হ্যায় কৌন’-এর উদাহরণ, রুচি আচার রীতি পোশাক খাদ্যাভ্যাসের ভিতর দিয়ে এক সুখী ভারতীয় পরিবারের বিবরণ। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’তে সেই পারিবারিক বিবরণই অনাবাসী আর দেশি ভারতীয়দের মেলবন্ধনে। ‘মোহাব্বতেঁ’ বা ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এ ওই আদলটাই ফিরে আসছে বিদ্যালয়ের কাঠামো, গুরুকুল, সঙ্গীত শিক্ষা ইত্যাদির মধ্যে। ‘বর্ডার’ বা ‘লগন’-এ আবার দেশপ্রেমের প্রকাশ, কখনও রণক্ষেত্রে, কখনও ক্রিকেটের মাঠে।
এই সূত্রেই এই বইয়ে ২০০১-’১২-র মধ্যে তৈরি বলিউডের বিভিন্ন ছবিতে ভারতীয় সম্প্রদায় ও ভারতীয়তার ইতিবৃত্ত নিয়ে আলোচনা। তাতে গদর, মুন্নাভাই, ধুম, দাবাং, জিন্দেগি না মিলেগি দোবারা-র মতো সব জনপ্রিয় ছবিই ঠাঁই পেয়েছে নানা বর্গভেদে। যেমন ইকবাল, চক দে ইন্ডিয়া, পান সিং তোমার-কে নিয়ে অধ্যায়টির নাম: ‘দ্য স্পোর্টিং নেশন আফটার লগন’।
বলিউড তার এই সম্প্রদায়গত বৃত্তান্তে স্বাতন্ত্র্যের বদলে ব্যক্তিকে গড় চেহারাতেই দেখাতে ভালবাসে। কে না জানে, বলিউডের আধিপত্য আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে সমাজজীবন পর্যন্ত প্রসারিত, তার সিনেমা পরিবার আর রাষ্ট্রের যোগসূত্র তৈরি করে, দেশের স্বাচ্ছন্দ্যের মাপকাঠি ঠিক করে দেয়, পরিবার বা রাষ্ট্র ব্যেপে গণতন্ত্রের বোধ নিয়েও সবিস্তারে মত প্রকাশ করে। সব সময়ই তা ‘ডমিনেন্ট অর হেজিমনিক ইডিয়োলজি’ তৈরি করে দেয়, লিখেছিলেন সিনেমার এক তাত্ত্বিক। একেই ‘দ্য পলিটিক্স অব বলিউড’ বলে চিহ্নিত করেছেন রাঘবেন্দ্র।
বলিউড যে হেতু হিন্দি ফিল্মের ইন্ডাস্ট্রি, সেই ইন্ডাস্ট্রির নিরিখেই ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে বিধৃত করে ছবিতে, তাতে ক্ষমতা-কেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের বিপরীতে কোনও ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য তো প্রকাশ পায়ই না, বরং সম্প্রদায় যখন নিজেকে কোনও মিথ্যা পরিচয়ে ভোলায়, ব্যক্তিও সেই পরিচয়কে নিজের পরিচয় বলে মনে করে। সেই মিথ্যা আত্মপরিচয়েই বলিউডের ব্যক্তি-নায়ক প্রতিবেশী পাকিস্তানকে শত্রু বানায়। মিলখা সিংহকে নিয়ে ছবিটি, ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ শুরু হয় রোম অলিম্পিকে মিলখার পরাজয় দিয়ে, আর শেষ হয় পাকিস্তানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাথলিটকে হারিয়ে সোনা জেতায়। যেন এ ভাবেই মিলখা তাঁর রোমে হেরে-যাওয়া ‘আইডেনটিটি’ পুনরুদ্ধার করলেন!
‘গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড হিন্দি সিনেমা’, এই উপ-অধ্যায়ে রাঘবেন্দ্র বলিউডের এই অভিনব কাঠামো গড়ে ওঠার একটা হদিশ দিয়েছেন। উদার অর্থনীতির যুগেই হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে মুড়ে ফেলা হল বলিউড ব্র্যান্ড-এ। সমাজ-অর্থনীতির এই পরিবর্তন দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় আদৌ কী বদল আনল তা তর্কের বিষয়, তবে তা স্বাধীনতা-উত্তর সংস্কৃতিতে যে অভিঘাত আনল, তাতেই হিন্দি ফিল্ম বদলে গেল বলিউডে। এই বদল এক কথায়, উঁচুতলার সংস্কৃতিতে উন্নীত হওয়া। একুশ শতকের শুরুর দশক জুড়ে বলিউড সদাব্যস্ত, ছবির চরিত্র থেকে দর্শক সকলেই যাতে মার্জিত সংস্কৃতির বশবর্তী হতে পারে। বইটির দ্বিতীয় শিরোনামই ‘বলিউড অ্যান্ড দ্য অ্যাংলোফোন ইন্ডিয়ান নেশন’।
উদাহরণে আসি। ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ আপাত প্রেমের ছবি হলেও আদতে কমিউনিটি-আইডেনটিটি-র ছবি, সম্প্রদায়গত সংহতির বার্তা জনপ্রিয় করার চেষ্টা। নায়ক উত্তর ভারতের, হিন্দি ও ইংরেজিভাষী, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, সত্ পেশায় যুক্ত, সর্বোপরি ভারতীয় সংস্কৃতিকে ‘গ্লোবাল’ করে তোলায় ব্যস্ত। অন্য দিকে নায়িকা দক্ষিণ ভারতের, মূলত তামিলভাষী, সুন্দরী বুদ্ধিমতী বলেই মূল ধারায় মিশে যেতে আগ্রহী। আর তার দোর্দণ্ডপ্রতাপ পিতা অসত্ পেশায় যুক্ত, তাই সে পলায়নোন্মুখ। অতএব এগিয়ে-থাকা নায়ক তুলনায় পিছিয়ে-পড়া নায়িকাকে তার আঞ্চলিক রুচি আর পরিমণ্ডল থেকে টেনে বের করে এনে যেন এক ‘সাফসুতরো’ ভারতীয়তায় স্থাপন করে দেয়। বলিউড এখন এ ভাবেই জাতি ও দেশের আত্মবিকাশের বিষয়টিকে ছবিতে তুলে আনছে, স্বদেশজিজ্ঞাসার কোনও গভীরতায় না ঢুকে শুধু উপরিতল থেকে এক আধিপত্যকামী সম্প্রদায়গত স্বপ্নকেই কাঙ্ক্ষিত করে তুলছে ছবিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy