‘পুরবাসী’ কথাটি সাধারণত ব্যবহৃত হয় নগরবাসী পুরুষদের সম্পর্কে, অথচ ‘পুরবাসিনী’ কথাটি মূলত ইঙ্গিত করে অন্তঃপুরবাসিনী নারীর প্রতি, এমনকী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত বর্ণিত ‘অবরোধবাসিনী’র প্রতি। ভাষার এই দ্বৈত ব্যঞ্জনাই যেন ইশারা করে আমাদের দেশের সদর মহলে (পাবলিক স্ফিয়ার), জন-অঙ্গনে মহিলাদের সীমিত, খণ্ডিত উপস্থিতির বাস্তবের দিকে। আলোচ্য বইয়ে সংকলিত পনেরোটি প্রবন্ধে এই বিষয়টির নানা দিক নিয়ে মনোগ্রাহী ও প্রাঞ্জল বিশ্লেষণ পেলাম। বিভিন্ন লেখকের লেখায় সে কাল এ কালের মেয়েদের নানা সমস্যার নিপুণ বিবরণ যেমন আছে, তেমনই আছে তাঁদের বহিশ্চারণার সুযোগ এবং সম্ভাবনা অঙ্কুরিত হওয়ার কথা। বাস্তব চিত্রটা যে একমুখী, একপেশে নয়, ঘরে বাইরে মহিলাদের সক্রিয়তার বিষয়টি যে বারে বারে আন্দোলিত করে আমাদের যুক্তি-তর্ক ও কর্মপ্রয়াসকে, তার ইতিহাস-সচেতন, তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে এখানে।
স্ফীত কলেবর বইটির বহুমুখী আলোচনার সব ক’টি ধারার প্রতি সুবিচার করতে পারব, এই দুরাশা ছেড়ে দিয়ে কিছু কথা বলছি তিনটি বিষয়ে: ভারতে সদর মুলুকের রূপরেখা ও তার বৈশিষ্ট্য; সেই বাহির দেশে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সক্রিয়তার সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা; এবং সেই সম্ভাবনাকে প্রসারিত করতে মেয়েদের যূথবদ্ধ প্রয়াসের নিদর্শন ও গুরুত্ব।
জন-অঙ্গন অন্দর মহলের বাইরের এক পরিসর। একই সঙ্গে, সবার অংশগ্রহণের সম্ভাবনাময় একটি পরিবেশও বটে। আর এর সঙ্গে প্রায়শই সম্পৃক্ত হয়ে থাকে নাগরিক সত্তার পরিচয়, যদিও সদর মহল কেবল রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক সীমানায় আবদ্ধ থাকে না। তবে পরিসর, পরিবেশ ও পরিচয়-এর দ্যোতক এই সদর মহল রূপে ও স্বভাবে হাবারমাস বর্ণিত পশ্চিমি সদর মুলুকের হুবহু প্রতিচ্ছবি নয়।
তার যে একটা দেশজ রূপ ছিল এবং আছে, তারই নানা দিক যত্ন করে তুলে ধরেছেন সম্পাদক। পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আধুনিকতার আঁটসাঁট ধারণা ও তার একমাত্রিক কালনির্ণয়ের সমালোচনা করেছেন দেশজ আধুনিকতার মিশ্র কালানুক্রমের নিরিখে। ভারতীয় জন-অঙ্গনে তর্কপ্রিয়তার ধারা, সভায় সমাজে, পঞ্চায়েতে গোষ্ঠীর অন্তর্দ্বন্দ্বকে গণ-বিবাদে পরিণত করার সংস্কৃতি; প্রাক-উপনিবেশ কালে ভক্তিরসে সিঞ্চিত ভারতীয় সাধিকাদের বহিশ্চারণা; এবং অনভিজাত, নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রচিত ‘প্রতি-জনতা’র সক্রিয়তা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে সম্পাদক দেশজ সদর মহলের ধারণাকে শুধু ঔপনিবেশিক ইতিহাসের আঙ্গিকে দেখার প্রবণতা সযত্নে এড়িয়েছেন।
এ দেশে বাহির মহল স্তরীভূত, অসমতল এক ভূমি, এখানে স্বাধীনতা ও সুযোগের বণ্টন অবাধ ও অখণ্ড নয়। এই পরিসরে মেয়েদের ক্রিয়াশীলতার সুযোগ সীমিত থেকেছে অতীতে এবং এখনও। পিতৃতান্ত্রিকতার চাপ অনবরত বাধা দিয়েছে ঘরের বাইরে তাদের কর্মতৎপর জীবন যাপনে। তবু সদর মহলকে ধরাছোঁয়া নিয়ে বিবাদ, বিতর্ক ও বিরোধ আগেও থেমে থাকেনি এবং এখন ক্রমশ আরও জোরালো।
বইটিতে যেমন প্রাচীন ভারতে হিন্দু নারীদের জন-অঙ্গনে প্রবেশের বিবরণ আছে, বৌদ্ধ-জৈন সমাজে মহিলাদের খানিকটা বহিশ্চারণার স্বাধীনতার কথা আছে, মনুবাদের প্রভাবে মেয়েদের অধিকার সংকোচনের কথা আছে, তেমনই আছে গোঁড়া, রক্ষণশীল রাজনীতির চাপে মধ্যযুগে দেশের মুসলমান মহিলাদের কোরানে বর্ণিত সমমাননীয়তার বিষয়টির গুরুত্ব হারানোর মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ। সদর মহলে মেয়েদের পোশাক-আশাক, রুচির প্রশ্ন নিয়ে ঔপনিবেশিক বাংলায় জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর নতুন ভাবনাচিন্তার ব্যাখ্যা রয়েছে, যা আজকের মেয়েদের ‘dress code’ বিতর্কে বিশেষ প্রাসঙ্গিক।
আলোচনা রয়েছে মহিলা নৃত্যশিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা সদর মহলে নিজেদের শৈলী ও দেহসৌষ্ঠবের মধ্য দিয়ে নিজেদের শিল্পীসত্তাকে প্রকাশ করছেন, অথচ বহিরঙ্গণে, জনতার চোখে অনেক সময় অন্য প্রত্যাশা। বিবরণ পাই নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানে, রাজনৈতিক দলে মেয়েদের নগণ্য উপস্থিতির, তেমনই মেলে শ্রমের বাজারে মেয়েদের এবং মহিলা কর্মীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের আলোচনা। খেলার জগতে মেয়েদের সুযোগ ও ভূমিকা এবং এ বিষয়ে সরকার ও সমাজের ঔদাসীন্যের বিষয়টিও স্থান পেয়েছে বইটিতে।
তবে, আমাদের দেশে মেয়েরা তো অ-বিভাজিত, অ-স্তরীভূত, সমগোত্রীয় কোনও গোষ্ঠী নন। জাত-পাত, ধর্ম ও শ্রেণি-অবস্থান তাঁদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করে। যেমন, বইটিতে এক প্রবন্ধকারের দক্ষ বিশ্লেষণে পড়ি, দলিত মহিলাদের জীবনে সামাজিক বৈষম্যের গাঁটছড়া বিশেষ তীব্র; তাঁদের দোষের মধ্যে তাঁরা ‘ভুল’ জাতের ও ‘ভুল’ লিঙ্গের। জীবনের চাহিদার চাপে এক অর্থে সদর মহলে দলিত মেয়েদের ‘নিত্য আনা-গোনা’। কিন্তু সেখানেও রয়েছে শোষণ ও ধর্ষণ। তাই জন-অঙ্গন থেকে বহিষ্কৃতি সমস্যার একটা মুখ, সেখানে নিপীড়ন আর একটি কঠোর বাস্তব। একটি লেখায় যখন পড়ি, কী ভাবে অন্ধ্রপ্রদেশে যোগিনীরা— যাঁদের প্রায় সিংহভাগ আদিবাসী ও দলিত গোষ্ঠীর— গণ-সম্ভোগের পাত্রী হয়ে পড়েন, কী ভাবে নেপালের বাদী গোষ্ঠীর মেয়েরা মুম্বইয়ের যৌন শিল্পের চত্বরে সওদা হয়ে যান উঁচু জাতের ক্রেতাদের কাছে, তখন মেয়েদের প্রতি সাম্প্রতিক প্রবল হিংসাশ্রয়ী আক্রমণে যতটা ব্যথিত হই, ততটা আশ্চর্য হই না।
তবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে, শহরে ও গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠেছে মেয়েদের নানা উদ্যোগ, যাতে সদর মহলে তাদের সুযোগের পরিধি আরও ব্যাপ্ত হয়। যেমন আলোচিত হয়েছে রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি ও সোসাইটি ফর এমপ্লয়মেন্ট অফ উইমেন-এর উদ্যোগের কথা, শিক্ষার সুযোগ প্রসারে মেয়েদের, বিশেষ করে মুসলমান মেয়েদের নানা প্রয়াসের কথা। ঝাড়খণ্ডের আয়ো আইদারি ট্রাস্ট নিবিড় পরিশ্রমে ও সাংগঠনিক সৃজনশীলতায় গড়ে তুলেছে সাঁওতাল মেয়েদের একটি গণ-উদ্যোগ। মেয়েদের যূথবদ্ধতা বিশেষ একটি রসদ হতে পারে। সবাই সমাবস্থায় নেই, কেউ কৌম জীবনে আবদ্ধ, কেউ উচ্চবর্গের বাসিন্দা। তবুও যৌথ উদ্যোগের পরিসর বিলীন হয় না, বরং নতুন নতুন সম্ভাবনার বীজ উপ্ত হয়। আবার আয়ো আইদারি-র মহিলারা বলেন, ‘জমির অধিকারের লড়াইকে আমরা সাঁওতাল পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে বিধ্বংসী লড়াই-এ পরিণত করতে চাই না’। অর্থাৎ, সদর মহলে মেয়েদের স্বচ্ছন্দ বিচরণের প্রচেষ্টা পিতৃতান্ত্রিকতার সঙ্গে বিবাদ, এমনকী সংঘাতের দাবি রাখে, কিন্তু পুরুষের সঙ্গে বিচ্ছেদ বা বিচ্ছিন্নতার নয়।
আলোচ্য বইটিতে অনেকেরই দৃষ্টি মূলত মেয়েদের প্রতি, নারী-পুরুষের আন্তঃসম্পর্ক ও সেই সম্পর্কের সনাতন গতিপথ পরিবর্তনে নারী-পুরুষের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই। পুর পরিসরে মেয়েদের প্রবেশ ও প্রকাশ আরও স্বচ্ছন্দ করার জন্য নারী ও পুরুষ উভয়েরই যে চেতনার উত্তরণের প্রয়োজন, সেই ‘relationality’-র দিকটি উপেক্ষা করলে বিশ্লেষণ একপেশে হয়ে যায়। ভূমিকায় সম্পাদক ভারতে প্রাক-ঔপনিবেশিক, শুরুর দিকের আধুনিকতার কথা বললেও পরের প্রবন্ধগুলি প্রাক-আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক এই দুই বর্গে ভাগ করেছেন বলে খানিকটা অস্পষ্টতা তৈরি হয়। মনে হল, সদর মহল-এর জটিলতা-মুুক্ত একটি সংজ্ঞা যেন ধরে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ ও বাজার— সদর মহলের এই তিন চালিকাশক্তির জটিল আন্তঃক্রিয়া আরও খানিকটা বিশ্লেষণ দাবি করে।
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy