Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

কবি সৃষ্টি করেছিলেন নতুন শিল্পভাষা

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন তাঁর সংগীত কালজয়ী হবে। একেবারে ভবিষ্যদবাণী। কবির জন্মের দেড়শো বছর পরেও তাঁর গান ইউ টিউবে, বাঙালির মোবাইলের রিং টোনে। বাঙালি অনেক মান-মর্যাদা খুইয়েছে বটে কিন্তু তাদের গুরুদেব-বিশ্বকবিকে আঁকড়ে থেকেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পী চেহারাটি নিয়ে বাঙালির আগ্রহ সীমিত।

স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন তাঁর সংগীত কালজয়ী হবে। একেবারে ভবিষ্যদবাণী। কবির জন্মের দেড়শো বছর পরেও তাঁর গান ইউ টিউবে, বাঙালির মোবাইলের রিং টোনে। বাঙালি অনেক মান-মর্যাদা খুইয়েছে বটে কিন্তু তাদের গুরুদেব-বিশ্বকবিকে আঁকড়ে থেকেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্পী চেহারাটি নিয়ে বাঙালির আগ্রহ সীমিত।

অনেকেই হয়তো জানেন না যে অশিক্ষিতপটুত্বের অসামান্য পারদর্শিতায় ১৯২৮-১৯৪১ এই চোদ্দো বছরে রবীন্দ্রনাথ দু’হাজারেরও বেশি ছবি এঁকেছিলেন। ক্যানভাস ও তেলরঙ নয়, তাঁর মাধ্যম ছিল কাগজ, রঙিন কালি এবং জল রঙ। এই সংবাদ হয়তো আপাত ভাবে বিস্ময়কর নয়, কারণ ঠাকুর পরিবারে অনেক দিন থেকেই শিল্প রসাস্বাদন, সংগ্রহ ও চর্চার পরিবেশ ছিল। ৬ নং জোড়াসাঁকোর ‘দক্ষিণের বারান্দায়’ শিল্প চর্চায় মগ্ন গগনেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেশবিদেশ থেকে বিখ্যাত শিল্পীরা মোলাকাত করতে আসতেন। এসেছিলেন ওকাকুরা, রদেনস্টাইন ও অন্য অনেকে। তা ছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজে শিক্ষা ব্যবস্থায় শিল্পকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দিয়েছিলেন; ১৯১৯ সালেই শান্তিনিকেতনে কলাভবনের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু আশ্চর্য এই যে রবীন্দ্রনাথের নিজের আঁকা তাঁর ভাইপো অবনের বিখ্যাত ‘বেঙ্গল স্কুল’ বা শান্তিনিকেতনের ভিন্নধর্মী শিল্পধারা, এই দুই ধরন থেকেই একেবারে স্বতন্ত্র।

সুপ্রিয়া রায় ও সুশোভন অধিকারী। নিয়োগী বুক্স, ২৪৯৫.০০

রবীন্দ্রনাথের ছবির প্রথম বড় প্রদর্শনী হয়েছিল বিদেশে; শিল্পের পীঠস্থান খোদ প্যারিসের গ্যালারি পিগাল-এ, রবীন্দ্রনাথের বিদেশিনি বন্ধু ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর উদ্যোগে ১৯৩০-এ। ভারতীয় শিল্পের পরম্পরা থেকে একেবারে ভিন্ন ধাঁচার এই সব ছবি দেখে বস্তুত তাক লেগে গিয়েছিল প্যারিসের শিল্প সমালোচকদের। এবং পরবর্তী কালে ভারতীয় দর্শকদের, যদিও তাঁদের অবাক হওয়ার কারণ স্বতন্ত্র। কী সেই কারণ?

রবীন্দ্রনাথের ছবি দৃশ্যমান জগতের বাস্তবানুগ অনুকরণ, অথবা চেনা শৈল্পিক ফর্মের অনুসরণ নয়। নিসর্গ, নারী-পুরুষ বা পশুপাখি যাই হোক তা কোনও ভাবেই বাস্তবের দাসত্ব করেনি— না তার অত্যাশ্চর্য রঙের ব্যবহারে, না তার ফর্ম ভাঙার পদ্ধতিতে। তাঁর ছবি দর্শকের মনে কোনও সহজ তৃপ্তি এনে দেয় না; তারা প্রচলিত অর্থে নয়নসুখকর ‘সুন্দর’ নয়। বস্তুত ‘কিম্ভূত’ (গ্রটেস্ক) গড়নের প্রতি ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট। তাঁর ছবি জুড়ে আছে ফুলো গোল গাল, নোটা নোটা কান, খোঁচা নাক, তেরছা চাউনির ‘সে’ জাতীয় পুরুষ অথবা প্যাঁচানো লম্বা গলা, করাতের মতো দাঁত, বেঢপ গড়ন পশুপাখি বা এদের মাঝামাঝি এমন সব জীব যাদের প্রকৃতি কখনও সৃষ্টি করার কথা ভাবেনি।

কোথা থেকে এল এই প্রাণীরা? বা জ্যামিতিক আকারের নারী-পুরুষেরা, নৃত্য বিভঙ্গে শূন্যে ভাসমান অথবা অপার্থিব এক চরাচরে স্থাণু? এরা কি সবাই একেবারে অস্থির মনোজগতের কল্পনাপ্রসূত? তবে কি রবীন্দ্রনাথের ছবি তাঁর সমকালীন ইয়োরোপীয় আধুনিক অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট-এর নিরিখে বুঝতে হবে? প্রশ্নটা জাগে কারণ ভ্রমণসূত্রে ১৯১৩-তেই রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন মাতিস, ভ্যান গগ, গগ্যাঁ তো বটেই, এমনকী কানডিনস্কি, তুলুস ল্যোত্রেক, দ্যুশ্যাম্প প্রভৃতি সাড়া জাগানো মডার্নিস্ট শিল্পীদের কাজ। ১৯২০ দশকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ জার্মান এক্সপ্রেশনিস্টদের কাজের সঙ্গেও পরিচিত হন। শুধু পশ্চিমী নয়, প্রাচ্য— চিন ও জাপানের শিল্প, পেরু ও উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার ‘প্রিমিটিভ আর্ট’, বিশেষত মুখোশ, কাঠখোদাই-এ মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

সুতরাং ভাবা যেতেই পারে যে একেবার সাতষট্টি বছর বয়েসে, ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করছিলেন এক নতুন শিল্প-ভাষা। সেই ভাষার সঙ্গে বাঙালি পাঠক-দর্শকের কোনও পরিচয় ছিল না। ১৯৪১-এ শিল্পী যামিনী রায়কে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন যে তাঁর দেশবাসীর ছবি দেখার চোখ তৈরি হয়নি, তারা শিল্পের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে তাঁর সর্ব অর্থে ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্প বুঝতে পারবে ভবিষ্যতের ভারতবাসী। বস্তুত তাই হয়েছে।

১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অংশ হিসেবে ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন মহানগরে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী, শতবার্ষিকী গ্রন্থে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য ছবি আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথের আলোচনা। তার পরের পঞ্চাশ বছরে বিশ্ব-বাজারে সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের দরের ওঠাপড়া চললেও তাঁর ছবির মূল্য এবং মূল্যায়নের ধারা ঊর্ধ্বগামী।

২০১৪ সালে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ টেগোর/ হিজ ওয়ার্ল্ড অব আর্ট বইটির দুই লেখকের বিশ্বভারতীর সঙ্গে সংস্রব বহু দিনের। সুপ্রিয়া রায় রবীন্দ্রভবনের গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন; তাঁর কাজের মূল বিষয় রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ। শিল্পী ও শিল্প-সমালোচক সুশোভন অধিকারী নন্দনের কিউরেটর। তাঁর কাজের সঙ্গে বাঙালি পাঠক পরিচিত— কেতকী কুশারী ডাইসনের সঙ্গে লেখা রঙের রবীন্দ্রনাথ বই-এর সূত্রে। এ ছাড়াও সুশোভন নিয়মিত লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের ছবি ও তার প্রেক্ষিত নিয়ে। এই গ্রন্থে তাঁদের নিজস্ব গবেষণার এক সুন্দর যুগলবন্দি হয়েছে। শুধু রবীন্দ্রনাথের ছবির আলোচনা এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য নয়, সে কথা লেখকরা ভূমিকাতেই বলে নিয়েছেন। বইটির শিরোনামেও তা স্পষ্ট। দশটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা এই বইটিতে রয়েছে একান্ত ভাবে ছবির পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে রবীন্দ্র জীবনের এক কালানুক্রম; বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য ভ্রমণ, তাঁর রঙ ব্যবহার নিয়ে আলোচনা, রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে চিত্রকলার সম্পর্ক, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী শিল্প-ইতিহাসের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক। এবং এসেছে বাঙালি পাঠকের প্রিয় বিষয় রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্স। কাদম্বরীর সঙ্গে কিশোরবেলার মধুরতা, সদ্য তরুণ কবির উচ্ছ্বাস তো আছেই, কিন্তু সময়ের সীমা ধরে দেখা হয়েছে জীবনের হেমন্ত-পর্বে— রাঙা গোধূলিতে, রূপসী তরুণী রাণু অধিকারীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের স্নেহ-ভালবাসা-যৌন আবেগঘন সম্পর্ক। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর রবিকা’র ছবি আঁকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লাভা-র অগ্ন্যুৎপাত কথাটি ব্যবহার করেছিলেন। স্পষ্টতই যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার সাক্ষী তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছিল এর মধ্যে রয়েছে এক আশ্চর্য প্যাশন।

রসেবশে থাকা শিল্পী, ছবি আঁকার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ ও আবেগের মধ্যে সিগমুন্ড ফ্রয়েড সাহেব— এক ধরণের যৌন-অবদমনের মুক্তি, সাবলিমেশন, অবচেতনের ভূমিকা, সমস্ত টেনে আনা যেতেই পারে। কিন্তু তার মানে কি এই যে ঈষৎ লম্বাটে মুখাবয়বের, দীঘল টানা চোখের বিষাদ-প্রতিমা রহস্যময়ীরা সবাই রাণু? ভিন্ন ভাবে বলতে গেলে এদের মধ্যে কাদম্বরী, ভিক্টোরিয়া বা মৃণালিনীকেই খুঁজতে হবে কেন? কবিকে যদি তার জীবনচরিতে খুঁজতে যাওয়া বৃথা, তেমনই চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথকেও নিশ্চয়ই বায়োগ্রাফির বিশদে দেখতে চাওয়ার একটা বিপদ আছে। বস্তুত আলাদা করে এর তেমন প্রয়োজনও ছিল না, প্রচুর মূল্যবান অজানা তথ্য, রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির অজস্র কালার প্লেট, ফটোগ্রাফ সংবলিত এই সুখ ও সহজ পাঠ্য গ্রন্থে। সাধারণ পাঠকের কাছে তো বটেই শিল্পে আগ্রহীদের কাছেও এটি সুন্দর উপহার।

খালি একটি আক্ষেপ থেকে গেল। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবর্ষে প্রকাশিত এই বইয়ের ভূমিকায় ১২৫ বছর শব্দটি হয়তো মুদ্রণ বা সম্পাদনার প্রমাদ।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

book review swati gangopadhyay rabindranath tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy