গত এপ্রিলে এ বই যখন তৈরি হয়, তখনও কুর্সিতে মনমোহন সিংহ। অতঃপর রাজাবদল। রাজধানীতে বইটি আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করেছেন সদ্য-প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যে উন্নয়নী মডেলের প্রতিভূ হিসেবে তিনি উদ্ভাসিত, ভূমিকা সহ আঠারোটি প্রবন্ধের এই সমাহার বহুলাংশে তার অনুসারী। সেই পথেই ভারতকে ‘ফিরিয়ে আনা’র পক্ষে সওয়াল লেখকদের। তাঁদের অধিকাংশই অর্থনীতিবিশারদ। সংকলনের মূল সুর: ‘গ্রোথ’ বা আয়বৃদ্ধির সাধনা ছেড়ে সমবণ্টনে মন দিতে গিয়ে ভারতীয় অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়েছে, এ বার ফিরাও তারে।
বিবেক দেবরায়,
অ্যাশলি জে টেলিস এবং
রিস ট্রেভর সম্পাদিত।
র্যান্ডম হাউস, ৪৯৯.০০
বিনিয়োগে উৎসাহ দাও, বাজারকে মুক্ত করো, আয়বৃদ্ধির হার বাড়াও— চেনা ছকটি আর এক বার পেশ করার মধ্যে বিশেষত্ব কিছু নেই। কিন্তু অন্যতম সম্পাদক মার্কিন প্রতিরক্ষা-বিশেষজ্ঞ অ্যাশলি টেলিস যখন তাঁর ভূমিকায় বলেন, ভারতের মানুষ ভয়ানক ভাবে চাইছেন এমন সরকার আসুক এবং তারা এমন নীতি অনুসরণ করুক, যাতে জিডিপির রেখাচিত্রটি আবার তরতর করে উঠতে থাকে, তখন সংশয় হয়, ভারতের মানুষের এই ভয়ানক রকমের চাওয়ার খবরটা কী ভাবে জানা গেল? তাঁরা যে সরকার-বদল চেয়েছেন, তা নিয়ে তর্ক নেই, কিন্তু বাজারের মুক্তির জন্যই সেটা চেয়েছেন, তার প্রমাণ কী? দশ বছর একটা জমানা চলেছে, শেষ ক’বছর অবিশ্বাস্য অপদার্থতা আর দুর্নীতিতে ম’ ম’ করেছে, তায় নির্বাক নিশ্চল প্রধানমন্ত্রী, সুদূরবিহারিণী হাই কমান্ড ও উদ্ভ্রান্ত যুবরাজ ব্রাজিলপ্রতিম পরাজয় অনেক কারণেই স্বাভাবিক ছিল। মুষড়ে-পড়া অর্থনীতি একটু চাঙ্গা হোক, এটাও নিশ্চয়ই জনতার দাবি ছিল। কিন্তু তা থেকে কি এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, তাঁরা সেনের বদলে ভগবতীই চেয়েছেন? ‘গুজরাত মডেল’-এর সমর্থকরা অধীর উৎকণ্ঠায় সেই মডেল চাইতেই পারেন, তাঁদের চাওয়ার পক্ষে যুক্তি থাকতেই পারে, কিন্তু সেই চাওয়াটাকে ‘তীব্র জাতীয় উৎকণ্ঠা’ বলে চালানো কি ঠিক?
আসলে, ‘জনগণ গ্রোথ চাইছেন, বাজার চাইছেন, সংস্কার চাইছেন’ বললে উদার নীতির পক্ষে একটা গণতান্ত্রিক সওয়াল খাড়া করা যায়। এই কারণেই মোদী সরকারের অর্থমন্ত্রীও বাজেট ভাষণে তরুণ প্রজন্মের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কথায় এমন জোর দেন। এর কোনওটাই হয়তো মিথ্যা নয়। কিন্তু জনগণ কী চাইছেন, সেটা জানতে হলে খুব বড় এবং গভীর সমীক্ষার দরকার হয় না কি? নিজেদের ধারণাটা জনাদেশ বলে চালানোর চেষ্টাটা একটু বাড়াবাড়ি।
বাড়াবাড়ির অন্য নজিরও আছে। সুরজিৎ ভাল্লা (‘ডিসম্যান্টলিং দ্য ওয়েলফেয়ার স্টেট’) রায় দিয়েছেন: ইউপিএ জমানায় ভারতে উৎপাদনশীলতা কমেছে। তাঁর যুক্তি: ১৯৮০ থেকে ২০০২, দুই দশকে দেশে বিনিয়োগের গড়পড়তা হার ছিল জিডিপি’র কুড়ি শতাংশ, ২০০২ থেকে এক দশকে সেই হার ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ শতাংশ। অথচ শতাব্দীর প্রথম দশকে বছরে গড়পড়তা প্রায় আট শতাংশ আয়বৃদ্ধি হচ্ছিল, কিন্তু ২০১১-১৪, তিন বছরে সে হার পাঁচ শতাংশে নেমে গেছে। অর্থাৎ, বিনিয়োগের অনুপাত দেড়গুণ হয়েছে, কিন্তু আয়বৃদ্ধির হার কমেছে। তার মানেই বিনিয়োগের উৎপাদনশীলতা কমে গেছে, ইউপিএ সরকার নিপাত যাক। তা যাক, কিন্তু মুশকিল হল, এক দশকের বিনিয়োগ আর তিন বছরের আয়বৃদ্ধির হার পাশাপাশি রেখে এ কেমন বিচার? যদি তুলনা করতেই হয়, আগের দুই দশকের সঙ্গে পরের এক দশকের তুলনা করুন, দেখবেন, বিনিয়োগের হার ও আয়বৃদ্ধির হার, দুইই প্রায় সমানুপাতে বেড়েছে। উৎপাদনশীলতায় লক্ষণীয় কোনও উন্নতিরও প্রমাণ নেই, অবনতিরও নয়। লেখক উৎসাহের আতিশয্যে গোলমাল করে ফেলতে পারেন, সম্পাদকরা সেটা দেখে ঠিকঠাক করে দেবেন না?
সুখের কথা, লেখকরা অনেকেই এমন অত্যুৎসাহী নন। বইটিতে বেশ কিছু মূল্যবান লেখা আছে, যেগুলি দেখিয়ে দেয় যে, আয়বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার জন্য দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ার কোনও দরকার নেই। ওঙ্কার গোস্বামী দেখিয়েছেন, ইউপিএ-র প্রথম পাঁচ বছরে— দ্রুত আয়বৃদ্ধি সত্ত্বেও— কর্মসংস্থান প্রায় বাড়েনি। ‘জবলেস গ্রোথ’-এর এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য শুধু জিডিপি বাড়লেই হবে না, সত্যিকারের শিল্প-প্রসার চাই। এবং, শ্রমের বাজারে সংস্কার ঘটিয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথ পরিষ্কার না করলে কর্মসংস্থান বাড়বে না— এই চালু যুক্তিকেও গোস্বামী বিশেষ পাত্তা দেন না; কারণ প্রথমত, রাজনৈতিক ভাবে তা সম্ভব নয় এবং দ্বিতীয়ত, ‘সহজে ছাঁটাই করা যাবে না বলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না, এটা সাধারণ ভাবে সত্যও নয়।’ এই সৎ বাস্তববোধ বাজারকৈবল্যবাদীদের করতালি আকর্ষণ করবে না।
শিক্ষা এবং দক্ষতার প্রসারের জন্য কী করণীয়, সে বিষয়ে লভীশ ভাণ্ডারীর লেখাটিও বাস্তববোধে ঋদ্ধ। সরকারি ‘বনাম’ বেসরকারি স্কুলের চেনা ছকে না ঢুকে তিনি জানিয়েছেন, গড়পড়তা বেসরকারি স্কুলগুলি হয়তো কিছুটা ভাল, কিন্তু খুব বেশি ভাল বলে মনে করার কারণ নেই। কী ভাবে লেখাপড়ার আসল কাজটা ভাল ভাবে করা যায়, সে জন্য কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। সে সব প্রস্তাব নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু তর্ক থেকেই তো পথ বেরোয়। যেমন, এক একটা বড় স্কুল বসিয়ে অনেক পড়ুয়াকে একসঙ্গে পড়ানোর প্রস্তাব। এ পথের বিপদ সহজবোধ্য, কিন্তু যেহেতু ভাল শিক্ষকের অভাব একটা বিরাট সমস্যা, সুতরাং প্রস্তাবটা উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
অশোক গুলাটি (কৃষি ও খাদ্য বণ্টন), এ কে শিবকুমার (স্বাস্থ্য), বিবেক দেবরায় (প্রশাসন), রাজীব লাল ও ঋতু আনন্দ (পরিবহণ) প্রমুখ বেশ কয়েক জনের লেখায় দরকারি তথ্য আছে, যে তথ্যগুলি থেকে ভারতীয় অর্থনীতির নির্দিষ্ট নানা সমস্যাকে চিনে নেওয়া যায়। সেই সব সমস্যার সমাধানে বাজারের বড় ভূমিকা আছে, যেমন রাষ্ট্রেরও। দুইয়ের মধ্যে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ডাকার প্রয়োজন নেই। রাজীব লাল ও ঋতু আনন্দ রেলের উন্নয়নে সরকারি এবং বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের সম্ভাবনার কথা বলেছেন। সেই সূত্রেই তাঁদের মন্তব্য: ‘বেসরকারি উদ্যোগীকেও যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।’ জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখায় সঞ্জয় জোশী জোর দিয়েছেন স্বাধীন শক্তিশালী ‘রেগুলেটর’ বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর, যে সংস্থা সরকারি এবং বেসরকারি, দুই গোত্রের উদ্যোগকেই সুস্থ প্রতিযোগিতার ঘাটে জল খাওয়াতে পারবে, যার ওপর সরকারি রাজনীতিকরা ছড়ি ঘোরাতে পারবেন না। সরকার বিশ্রী আর বাজার সর্বশ্রী— ব্যাপারটা ঠিক এমন নয়।
ঠিক তেমনই, ইউপিএ যা করেছে সব খারাপ, সুতরাং পরিত্যাজ্য, এমন কথাও তথ্যের ধোপে টেকে না। ভারতীয় কৃষির দুর্দশা নিয়ে যখন সবাই একমত, তখন অশোক গুলাটি দেখিয়েছেন, ২০০৪-০৫-এর পরে কৃষিতে বিনিয়োগ অনেকটা বেড়েছে, কৃষি উৎপাদন এবং আয়ের বৃদ্ধিতেও তার সুফল মিলেছে। ব্যর্থতা থেকে শেখার আছে, সাফল্য থেকেও। অরুণ জেটলির বাজেট যে পি চিদম্বরমকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে, তার অনেকটাই স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা।
অর্থনীতিকে অনেকে বড় বেশি সমীহ করে। অর্থনীতিকে অনেকে বড় বেশি তাচ্ছিল্য করে। কোনওটাই তার প্রাপ্য নয়। অর্থনীতি অনেক সমস্যা সমাধানের পথ দেখাতে পারে, কিন্তু সে সমস্ত সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে না। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কিংবা বাজার অর্থনীতি, কেউই পারে না। যাঁরা এই কথাটা মাথায় রাখেন, তাঁদের বিশ্লেষণ মূল্যবান, কারণ তা আমাদের চার পাশের দুনিয়াটাকে বুঝতে সাহায্য করে। এই সংকলনে তেমন অন্তত কয়েক জনকে পাওয়া গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy