দেশভাগের স্মৃতি ১-৪ এবং আল্লার জমিতে পা, অধীর বিশ্বাস। গাঙচিল, ৩৫০.০০ ও ১৭৫.০০
১৯৪৭ সাল, ১৪ অগস্ট। ‘পাকিস্তান’ নামক একটি নতুন দেশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। পূর্ববঙ্গ (অধুনা বাংলাদেশ) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। নানা সময়ে, নানা দেশে দেশভাগ-সাহিত্য রচিত হয়েছে। পঞ্জাব এবং বঙ্গের সাহিত্য-সম্ভারও কম নয়। অধীর বিশ্বাসের দেশভাগের স্মৃতি (১-৪) এবং আল্লার জমিতে পা সেই প্রবাহের অন্তর্বর্তী নয়। কারণ একটাই। ফিকশনের চেয়ে বাস্তব কখনও কখনও আরও বেশি রূঢ় ও মর্মস্পর্শী। ‘পাকিস্তানের শীত আর ইন্ডিয়ার শীতে বেশ ফারাক।’ পাকিস্তানের মানুষকে যখন ভারতের বনগাঁ-ও তাড়িয়ে দেয়, তখন নিরাশ্রয় সেই মানুষের শীত যেন বেড়ে যায় সহস্রগুণ।
‘কলকাতায় যাওয়ার সময় কাঁদতে নেই।’ কিন্তু মনের ভিতরে যে ভিটেমাটি আর নবগঙ্গার ঘ্রাণ, সেখানে তো অবিরাম অশ্রুক্ষরণ। দরিমাগুরা থেকে কলকাতা— এক অসামান্য স্মৃতিকথা। এই ‘জার্নি’ শুধু লেখকের নয়, একটা সময়ের উত্তীর্ণ হওয়া। উত্তীর্ণ, না অবতীর্ণ তা অবশ্য পাঠকের চিন্তা।
বাবা বলেছিলেন, কলকাতায় অভাব নেই। সত্যিই কি কলকাতা সেই আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ, যেখানে চাইলেই খাবার পাওয়া যায়, মেলে বস্ত্র বা বাসস্থানের হদিশ? কিন্তু কখনও লজেন্সের বয়াম, মুড়ির মোয়া বিক্রি করতে করতে বি এ, এম এ পড়ার স্বপ্নটা ফিকে হতে থাকে। কাল এগিয়ে চলে ইলিশ মাছের নৌকোর মতো। জনমজুরের কাজ চলে, শীত কাটানোর স্বপ্নে ভেসে ওঠে সবুজ-হলুদ চাদর, যার চার পাশে শঙ্খপাড়। কিন্তু স্বপ্নকে তো রঙিন হতে নেই, সে আপাদমস্তক সাদা-কালো, মর্মান্তিক বাস্তব।
দেশভাগের স্মৃতি-র ৩৮টি লেখায় আছে ব্যক্তিমানুষ ও রাষ্ট্রের সংঘাতের ইতিবৃত্ত। এই সংঘাত সাধারণত অভিজাতদের সঙ্গে দেশের হয়ে থাকে। কিন্তু এক জন প্রান্তিক মানুষ কী ভাবে রাজনীতি-দীর্ণ দুটি রাষ্ট্রের সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ‘পরিণত’ হয়ে ওঠেন, তার এক আশ্চর্য দলিল এই সন্দর্ভটি। হ্যাঁ, একে সন্দর্ভই বলা উচিত।
প্রান্তিক ও উদ্বাস্তুদের হৃদয়ের কথা এত দিন লিখেছেন অন্যরা। সাহিত্যের ধরাবাঁধা ছকে দেশভাগ-আলেখ্য বন্দি হয়েছে, প্রশ্বাস নিতে পারেনি। মান্টো, ইলিয়াসের মতো লেখকদের রচনায় দেশভাগের যে যন্ত্রণা ইতিহাসরূপে ধরা নিয়েছে, তেমন প্রতিবিম্ব বড় মেলে না। ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের গ্রাম্ভারি প্রবন্ধ শ্যাওলা বা কচুরিপানার খবর রাখে না। রাজনীতির কাছেও তারা ব্রাত্য। বট-অশ্বত্থ প্রভৃতি মহীরুহের পাশে এক বৃহত্তর প্রান্তিক জনজীবনের ছবি তুলে ধরেছেন অধীর।
দেশভাগের স্মৃতি-র পরের পর্ব আল্লার জমিতে পা বেশ চিত্তাকর্ষক। বেশির ভাগ দেশভাগ-স্মৃতিকথায় থাকে একটা কাঁদুনে কলম। অধীর বিশ্বাস সে পথে হাঁটেননি। তিনি শুধুই অভিজ্ঞতা আউড়ে গিয়েছেন, আর সেই আলেখ্য তাই এত প্রাণবন্ত, গভীর এবং মায়াময়। পাঠককে তা আরও ধীর করে, উত্তেজনার পারদ সেখানে ঊর্ধ্বমুখী নয়।
বাড়ি বিক্রির টাকা হুন্ডি হয়ে কলকাতা আসে। পরিবার ধরে টাকা গুনতে বসে। বাবা শুধু থম মেরে আছেন। ‘নারানদা, জোর করে তো নিইনি। বাড়িটা বেচবে বলেছিলে, হিন্দুরা কিনছে না তাই আমিই—। গরিব ঠকালে আল্লার জমিতে মাটি পাব না যে!’ ক্রেতা গফুর মিঞা পরোটা আর কাঁচাগোল্লা খাইয়ে বলেছিলেন। সই করার পর থেকে বাবা কেঁদেই যাচ্ছেন।
লেখক তাঁর উত্তরপুরুষের হাত ধরেন। পূর্ববঙ্গ থেকে পিতার হাত ধরে যেমন ভাবে এক দিন এসেছিলেন, ঠিক তেমন করেই নিজের পুত্রের হাত ধরে একটি ব্যস্ত রাস্তা পার হন। ভাবেন, পুত্রকে তো বাবার মতো স্বপ্ন দেখাতে পারলেন না!
একটি রাস্তা কিংবা কাঁটাতার— তার একপাশে স্বপ্নরা পড়ে থাকে, অন্য পারে অন্নচিন্তা। দুটি বইয়েরই প্রচ্ছদ অসামান্য, রয়েছে শিল্পী বিপুল গুহ-র মুনশিয়ানার ছাপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy