Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

আমৃত্যু চললেন সেই দুঃসাহস নিয়ে

পুলিশের খাতায় বা সরকারি নথিতে তিনি এখনও নিখোঁজ, ৪৩ বছর পরেও। তবে ময়দানের ঘাসে তাঁর কবন্ধ লাশ ১৯৭১-এর অগস্টে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলেন কেউ-কেউ। সম্ভবত পত্রপাঠ তা লোপাট করে দেওয়া হয়। বহুস্বর ভারতীয় গণতন্ত্রে তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বর শাসকদের কাছে বড় বিপন্নতা সৃষ্টি করে থাকবে। তাই কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক সরোজ দত্ত ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান।

গৌতম রায়
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

পুলিশের খাতায় বা সরকারি নথিতে তিনি এখনও নিখোঁজ, ৪৩ বছর পরেও। তবে ময়দানের ঘাসে তাঁর কবন্ধ লাশ ১৯৭১-এর অগস্টে রক্তাক্ত পড়ে থাকতে দেখেছিলেন কেউ-কেউ। সম্ভবত পত্রপাঠ তা লোপাট করে দেওয়া হয়। বহুস্বর ভারতীয় গণতন্ত্রে তাঁর অনন্য কণ্ঠস্বর শাসকদের কাছে বড় বিপন্নতা সৃষ্টি করে থাকবে। তাই কবি, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক সরোজ দত্ত ‘নিখোঁজ’ হয়ে যান।

ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া ছাত্র সরোজ দত্ত তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন অমৃতবাজার পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসাবে। এর আগে থেকেই তিনি ‘অগ্রণী’ ও ‘অরণি’ পত্রিকায় কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লিখতেন। পরে কর্মী-ধর্মঘটে যোগ দিয়ে চাকরি খোয়ালে ‘পরিচয়’ ও ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় সম্পাদনার কাজে যুক্ত হন। ‘কোনো বিপ্লবী কবির মর্মকথা’য় ১৯৩৯ সালেই তিনি লিখেছিলেন— ‘দুঃসাহসী বিন্দু আমি বুকে বহি সিন্ধুর চেতনা’। আমৃত্যু সেই দুঃসাহস নিয়ে চললেন, বামপন্থী বুদ্ধিজীবী থেকে উত্তীর্ণ হলেন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীতে, শেষে কমিউনিস্ট বিপ্লবীতে। কিন্তু পদ্যে-গদ্যে তাঁর শানিত কলম তাঁকে স্বতন্ত্র করে তোলে প্রথমাবধি। বুদ্ধদেব বসু ও সমর সেনের সঙ্গে তাঁর সাহিত্যিক বিতর্ক বঙ্গীয় সাহিত্য অঙ্গনে তোলপাড় তোলে। বুদ্ধদেব বসুকে উদ্দেশ করে তাঁর লেখা ‘বৃহন্নলা, ছিন্ন করো ছদ্মবেশ’ প্রগতিবাদী সাহিত্যশিবিরের আত্মপ্রতারণা ও দেউলিয়াপনাকে উন্মোচিত করে দেয়।

অনুবাদ সাহিত্যেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন সরোজ দত্ত। তাঁর অনুবাদে রম্যা রল্যাঁর আত্মজীবনী ‘শিল্পীর নবজন্ম’, ক্রুপস্কায়ার লেখা ‘লেনিনের স্মৃতি’, টলস্টয়ের ‘পুনরুজ্জীবন’ ও ‘সেবাস্তোপোলের কাহিনী’, তুর্গেনিভ-এর ‘বসন্ত প্লাবন’ সে সময় রীতিমত জনপ্রিয় হয়। তা ছাড়া, প্যাট্রিস লুমুম্বা, বের্টোল্ট ব্রেখট, পারভেজ শাহেদি, চেন-ই, বুলগেরিয়ার মজুর-কবি নিকোলা ভ্যাপসারভ প্রমুখের কবিতা সরোজ দত্তের অনুবাদে সাড়া ফেলে। তবে রাজনৈতিক প্রবন্ধের জন্যই পরে সরোজবাবু সকলকে চমৎকৃত করতে থাকেন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে সিপিআইএম তৈরি হলে তিনি শেষোক্ত সংগঠনে যোগ দেন এবং দলীয় মুখপত্র ‘দেশহিতৈষী’র সম্পাদকমণ্ডলীতে যুক্ত হন। ‘শশাঙ্ক’ ছদ্মনামে তাঁর আগ্নেয় লেখাপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। অতঃপর নকশালবাড়ি, দেশহিতৈষী থেকে দেশব্রতী এবং চারু মজুমদারের নেতৃত্বে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা রূপে তাঁর বিকাশ।

তাঁর নিয়মিত কলাম ‘পত্রিকার দুনিয়ায়’ গোগ্রাসে গিলত সে সময়ের তরুণ প্রজন্ম। এ সময়েই তাঁর সবচেয়ে বিতর্কিত ভূমিকা মূর্তি ভাঙার রাজনীতি প্রশ্নে। নকশাল তরুণরা তখন বুঝে, না-বুঝে এক-একজন ‘মনীষী’র মূর্তি ভাঙছে ‘বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থা’য় আঘাত করতে, আর সরোজবাবুর লেখনী সেই মনীষীর সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসের নজির তুলে ধরে সেই ভাঙনকে যুক্তিসিদ্ধ করছে, বৈধতা দিচ্ছে। তাঁর মতে, নতুন কিছু গড়তে গেলে পুরনোকে ভাঙতে হয়। মঙ্গল পাণ্ডের মূর্তি বসাতে গেলে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙতে হবে। সিপাহি বিদ্রোহের অর্থাৎ ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের মূর্তি স্থাপন করতে হলে সেই বিদ্রোহের সমর্থকদের মূর্তি ভাঙা দরকার। লক্ষণীয়, তিনি কিন্তু বিদ্যাসাগর, রামমোহন, সুরেন্দ্রনাথ, বিপিন পালের মূর্তির জায়গায় লেনিন-স্তালিন-মাও কিংবা মার্ক্স-এঙ্গেলস্-এর মূর্তি বসাতে বলেননি। তিনি দাবি করছিলেন কানাইলাল-ক্ষুদিরাম, সিধু-কানু-বীরসা মুণ্ডা, ঝাঁসির রানি, মঙ্গল পাণ্ডের মূর্তি বসানোর। ওই সব মূর্তি তখনও ছিল না, অনেক পরে কোথাও-কোথাও বসানো হয়েছে।

সরোজ দত্ত তাঁর দীক্ষাগুরু মাওয়ের মতো মনে করতেন, বিপ্লব দামাল শিশুর মতো, সে মার্জিত, বিনয়ী, সংযত, দয়ালু ও উদার হতে পারে না। আর নকশাল তরুণরা মূর্তি ভাঙার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাজই শুরু করেছে। তাঁর নৈতিক প্রশ্রয়ে বা তাত্ত্বিক আস্কারায় নকশাল তরুণরা যে কালাপাহাড়ি তাণ্ডব চালিয়েছিল, তার ফলেই অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের তথাকথিত মনীষীদের ধুপ-ধুনো জ্বালিয়ে পুজো করার বদলে যথার্থ মূল্যায়নের আগ্রহ শিক্ষিত বাঙালি সমাজে তৈরি হয়। সেই সঙ্গে সমগ্র বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা নবজাগৃতির পুনর্মূল্যায়নের তাগিদও সৃষ্টি হতে থাকে। বিনয় ঘোষের মতো নিষ্ঠাবান গবেষক এই মূল্যায়নের কাজে হাতও দেন এবং নবজাগরণ সম্পর্কে তাঁর আগের ধারণা সম্পূর্ণ বর্জন করেন। আর রণজিৎ গুহের নেতৃত্বে যে নিম্নবর্গীয় ইতিহাস রচনার ধারা সূচিত হয়, তার প্রেরণা সমসাময়িক ইতিহাসে ওই নকশাল রাজনীতিরই চ্যালেঞ্জ। তাই এ ব্যাপারে সরোজ দত্তকে পথিকৃতের ভূমিকা দেওয়াই সঙ্গত।

এ বছর সরোজ দত্তের জন্মশতবর্ষ। সেই উপলক্ষে সরোজ দত্ত স্মৃতিরক্ষা কমিটি পাঠককে উপহার দিয়েছে এক অনুপম সংকলন—মরণে মেলেনি ছুটি। সংকলনে সরোজবাবুর কিছু কবিতা, দুটি গল্প, কয়েকটি অনুবাদ-কবিতা এবং প্রবন্ধ ছাড়াও স্থান পেয়েছে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত প্রত্যক্ষদর্শী এবং স্ত্রী, পুত্র, দাদা-বৌদির সাক্ষাৎকার, যার মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে অফুরান প্রাণশক্তির আধার এই ছোটখাট চেহারার আপসহীন সংগ্রামী মানুষটির ব্যক্তিত্ব। এ ছাড়াও আছে বেশ কিছু দুর্লভ ছবি। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সরোজ দত্তের অন্তর্ধানের এক মাস পরেই ‘নিহত কবির উদ্দেশ্যে’ লিখেছিলেন— ‘যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে/ সেই সব কালের জল্লাদ/ তোমাকে পশুর মতো বধ করে আহ্লাদিত?/ নাকি স্বদেশের নিরাপত্তা চায় কবির হৃৎপিণ্ড?’ সরোজ দত্তের অন্তর্ধান বা হত্যার তদন্তে বাম বা দক্ষিণ কোনও সরকারই কোনও কমিশন বসায়নি।

অন্য বিষয়গুলি:

gautam roy book review saroj dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy