Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২

আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে বৃহত্তর বাংলার স্পর্শ

আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় জনসমাজ ও সংস্কৃতির বিষয়বৈচিত্র আলোচনা বহু ক্ষেত্রে অভিনব হয়ে ওঠে। কখনও বিষয়ের চৌহদ্দি আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে বৃহত্তর বাংলার স্পর্শ জাগিয়ে তোলে। ঘরবাড়ি, লোকদেবতা, তুলসীমঞ্চের সর্বজনীন রূপ যেমন লোকায়ত ধর্মের আঞ্চলিক ধারা অন্বেষণের প্রতি বহুবিস্তারি দৃষ্টিপাতেও চর্চার কাঠামো তৈরি হয়।

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

আঞ্চলিক পত্র-পত্রিকায় জনসমাজ ও সংস্কৃতির বিষয়বৈচিত্র আলোচনা বহু ক্ষেত্রে অভিনব হয়ে ওঠে। কখনও বিষয়ের চৌহদ্দি আঞ্চলিকতা ছাড়িয়ে বৃহত্তর বাংলার স্পর্শ জাগিয়ে তোলে। ঘরবাড়ি, লোকদেবতা, তুলসীমঞ্চের সর্বজনীন রূপ যেমন লোকায়ত ধর্মের আঞ্চলিক ধারা অন্বেষণের প্রতি বহুবিস্তারি দৃষ্টিপাতেও চর্চার কাঠামো তৈরি হয়।

বাংলার ঘরবাড়ি নিয়ে ‘স্বদেশচর্চা লোক’ (সম্পাদক: প্রণব সরকার) এক বৃহত্তর পরিসর তৈরি করেছে, যা শুধু শৈলীগত তত্ত্বকথায় বৈচিত্রকে তুলে ধরে না। পুরনো সময়ের লেখার সঙ্গে সমসাময়িক চর্চা, প্রতিবেদন এমনকী ভ্রমণের তথ্যেও বাংলার স্থাপত্য কাঠামোকে জানা যায়। প্রায় শ’দেড়েক লেখায় আছে বাস্তুশিল্প, চালাশিল্পের ঐতিহ্য, ডাকবাংলো, দুর্গ, রাজপ্রাসাদ, আখড়া, নীলকুঠি, ভূতুড়ে বাড়ি থেকে মুম্বইয়ে হোমি ভাবার বাড়ির নিলাম তথ্য, পাবনায় সুচিত্রা সেনের বাড়ি বেদখল আর দখলমুক্তির প্রতিবেদন। তাই পুরাতনী, সাধারণী, জেলা, অন্য রাজ্য, ভিন রাষ্ট্র ইত্যাদি অধ্যায় আলোচনায় আছে নানা তথ্য নিদর্শন। ‘মাটির বাড়ি’-তে অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘কিন্তু সুরেন কর ও নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে আলকাতরা মেশানো মাটি দিয়ে ‘শ্যামলী’-র ছাদ তৈরি হলেও দু-একটা বর্ষার বেশি তা টিকল না। সেখানকার বাস তুলে দিতে হল রবীন্দ্রনাথকে।’ পুনর্মুদ্রণের সঙ্গে আছে রূপনারায়ণের কূলে শরৎচন্দ্রের বাসভবনে যাওয়ার ভ্রমণবার্তাও।

রঙ্কিণী, ঘণ্টাকর্ণ, নাংটাসিনি, নীলকুমারী, গেঁড়িবুড়ি, খ্যাঁদা পার্বতী, কালুয়াষাঁড়, বীরবাঁকুড়া, বলদাবুড়ি, চন্দ্রগোল— এমন নামবৈচিত্রে লোকদেবতা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের ‘লোকভাষ’ (সম্পাদক: তরুণ সিংহ মহাপাত্র) পত্রিকা। সুচারু এই পত্রিকায় রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম-জনপদে ধর্মাচরণের কথা-কাহিনিতে আছে লৌকিক দেব-দেবীর অধিষ্ঠান আর জনগোষ্ঠীর একাত্মতার তথ্য-বিবরণ। জল জঙ্গল পাহাড় ভূমির অন্তঃস্থ জগতের ধর্মবিশ্বাসে আলো ফেলেছেন নানা জন। প্রাসঙ্গিক আলোচনায় এসেছে পুথিপ্রসঙ্গ, আদিবাসী দেবদেবী। লোকদেবতা প্রসঙ্গে প্রারম্ভিক কথা লিখেছেন বঙ্কিমচন্দ্র মাইতি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও লোকদেবতা নিয়ে আলোচনা করেছেন মুহম্মদ আয়ুব হোসেন।

তুলসীমঞ্চ বিষয়ে পূর্ব মেদিনীপুরের হলদিয়া থেকে ‘মেঘবল্লরী’ (সম্পাদক: প্রাণনাথ শেঠ) পত্রিকার প্রয়াস উল্লেখযোগ্য। পুরাণ গল্প কবিতা আর লোকসংস্কৃতির নানাবিধ উল্লেখে তা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। স্মৃতিকথায় তুলসীমঞ্চ প্রসঙ্গে অনিল ঘড়াই লিখেছেন, ‘বাবা স্নানের পরে প্রতিদিন খালি গায়ে ভেজা বস্ত্রে পেতলের ঘটিতে করে তুলসীমঞ্চে জল ঢালতেন।’ তুলসী পাতার ভেষজগুণ নিয়ে লোকাচারে তুলসীমঞ্চের ভূমিকা আছে। মাটির তুলসীমঞ্চ নিয়ে প্রবালকান্তি হাজরা, পোড়ামাটির তুলসীমঞ্চের শিল্পশৈলী নিয়ে তারাপদ সাঁতরার তথ্যের বাইরেও আছে নানা কথাপ্রসঙ্গ।

সত্যপির ও সত্যনারায়ণ বিষয়কেন্দ্রিক লোকধারায় মুসলমান ও হিন্দুর যে খণ্ডিত আলোচনা তা প্রকৃত অর্থেই সার্বিক বিষয়-বিন্যাসের অনুসারী। বীরভূমের সিউড়ি থেকে প্রকাশিত ‘রাঢ়কথা’ (সম্পাদক: শ্যামল বেরা, কিশোরী দাস) সত্যপির-সত্যনারায়ণ বিষয়ে সেই বিশাল আঙিনাকে উদ্ভাসিত করেছে। ‘ইতিহাসের মধ্যযুগ: পির-ভারত পির-বাংলা’ শিরোনামে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় এক সুদীর্ঘ সামাজিক সালতামামি দিয়েছেন। সম্প্রীতির উৎস হিসেবে আলোচনা করেছেন গোপীকান্ত কোঙার। জেলাভিত্তিক তথ্য আলোচনা ছাড়াও কাব্যধারা, পাঁচালি, পালাগান, পটের গান ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন স্বপনকুমার ঠাকুর, শিবেন্দু মান্না, সৌরভ বেরা, মেঘদূত ভুঁই প্রমুখ। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, দ্বিজ কীর্তিচন্দ্র, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মুন্সী আব্দুল করিমের দুর্লভ রচনায় সমৃদ্ধ এই বিশেষ সংখ্যা। পরিশিষ্টে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদে রক্ষিত সত্যনারায়ণ সত্যপির সম্পর্কিত পুথি-পুস্তক-পাঁচালির তালিকা প্রয়োজনীয় সংযোজন।

‘এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন নামটা আজকের। কিন্তু গ্রামবাংলায় বহুদিন ধরে চলেছে। কলকাতায় কোন মহিলা কবে কী চালু করলেন তার ওপর নির্ভর করে ছিল না।’ মুসলিম বিয়ের গানের প্রসঙ্গে আর নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে আধ্যাত্মিকতার জন্য যে ধর্মের দরকার নেই, তা বলেছেন রত্না রশীদ। বর্ধমান জেলার জাহানারা বিবি ও সাইফি বিবির গীত-গাউনি এই কথালাপেরই সূত্রধার। হুগলির ত্রিবেণী থেকে প্রকাশিত সুসম্পাদিত নবম বার্ষিক সংকলন ‘সহজিয়া’-য় (সম্পাদক: মধুসূদন মুখোপাধ্যায়) অন্যান্য লেখার মধ্যে আছে বেতার জগৎ নিয়ে বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় ও দৃষ্টিপ্রদীপ শিরোনামায় দৃষ্টিহীন সংগীত ও নাট্যশিল্পী সুভাষ দে-র কাজের কথা আর বাস্তবতার কাহিনি।

দুর্গাপুরের তারাপদ সাঁতরা স্মারক নিধি প্রকাশিত ‘পুরালোক বার্তা’ (সম্পাদক: সোমনাথ রায়) পঞ্চম বার্ষিক সংখ্যায় আছে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসাবশেষের আড়ালের প্রসঙ্গে পৃথ্বী সেনগুপ্ত, প্রত্নতত্ত্বে মাছ বিষয়ে দিগেন বর্মন আর অপেশাদার প্রত্ন অনুসন্ধান প্রসঙ্গে অরুণ নাগের লেখা। এ ছাড়াও আছে মন্দির, দুর্গোৎসব, সংগ্রহশালা নিয়ে লেখা। এ সব ভিন্নধর্মী লেখা ও অন্য নথি ও তথ্য পরিবেশনায় কিছু দুর্বলতা থেকে গেছে। ক্রোড়পত্রে তারাপদ সাঁতরাকে নিয়ে সমাজবীক্ষণে তাঁর আর্তি প্রদীপ ঘোষের লেখায়, আর আছে প্রবালকান্তি হাজরাকে লেখা চিঠির কথাসূত্র।

বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর থেকে প্রদীপ কর ও তুলসীদাস মাইতি সম্পাদিত ‘টেরাকোটা’ মাসিক পত্রের বৈশাখ ১৪২১ সংখ্যা কলেবরে ক্ষীণকায় হলেও বিষয়বৈচিত্রে অভিনব। কালীঘাটের পট, ভাওয়াইয়া গানে গাড়িয়াল, জলন্দির পাটবাড়ি, বৈষ্ণব পদাবলী, অম্বিকানগর, বনৌষধি, আঁটপুরের মন্দির— এমন বহুবর্ণী চর্চায় আলোকপাত করেছেন অঞ্জন সেন, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, আদিত্য মুখোপাধ্যায়, অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ মাহাতো, দেবাশিস নন্দী প্রমুখ।

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy