মানিকদা যে ধরনের অভিনয়ে বিশ্বাস করতেন তা হল ইনট্রোস্পেকটিভ অ্যাক্টিং। অন্তর্মুখী অভিনয়। উনি কিন্তু বহিরঙ্গের অভিনয় পছন্দ করতেন না। রিয়ালিস্টিক ছবির যে অভিনয় মানিকদাই তা প্রথম দেখান ফিল্মে, ‘পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু করে এবং সেখানে মিনিমাম অব বিহেভিয়ারিজম, মিনিমাম অব মুভমেন্ট করে, ম্যাকসিমাম অব ইমপ্যাক্ট অন দ্য অডিয়েন্স কি করে আনতে হয় তা একমাত্র উনিই জানেন।’’ রবি ঘোষ যখন ‘পরিচালক সত্যজিৎ রায়’কে নিয়ে লেখেন, মনে হয় যেন সিনেমার শিল্প-ইতিহাসে সত্যজিতের বৈভবগুলিকে চিনিয়ে দিচ্ছেন। এমনই আরও নানা ব্যক্তিত্ব, মঞ্চ ও পর্দা-র শিল্পরূপ নিয়ে লিখেছেন, লিখেছেন নিজেকে নিয়েও। সপ্তর্ষি থেকে প্রকাশিত তাঁর আপনমনে-তে (সম্পা: অভীক চট্টোপাধ্যায়। ২৫০.০০) অনেকটা বিশ্লেষণ, অনেকটা আত্মকথন। অনবদ্য অভিনয়ের মতো তাঁর বিচারভঙ্গিও অনবদ্য। যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে: ‘‘আমরা তখন খুঁজে বেড়াচ্ছি একটা চমকপ্রদ মুখ বা চেহারা, যাকে দেখলে মনে হবে লোকটা স্বাভাবিক। সৌমিত্র ‘অপুর সংসার’-এ আবির্ভাব হয়ে সেই আশাটা দেখাল।’’ আবার যখন ‘ফিরে দেখা’ অধ্যায়টি লিখছেন, তখন যেন এক অভিনেতার ভিতরের ব্যক্তিমানুষটিও আস্তে আস্তে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে আসে আমাদের কাছে। যেমন ‘অভিযান’-এর অভিজ্ঞতা। অভিনয়ের জন্যে প্রথম মুখোমুখি হচ্ছেন সত্যজিতের, সত্যজিৎ বললেন, ‘‘সৌমিত্র ড্রাইভার তুমি ক্লিনার। ক্লিনার দেখেছো? বললাম, ‘দেখেছি মানে? আমি কালীঘাটের ছেলে। ক্লিনারদের মতো দারুণ সিটিও দিতে পারি। সিটি মেরে কত পায়রা উড়িয়েছি।’ সেই শুরু আমাদের যৌথ যাত্রা।’’ পরিশিষ্টে তাঁর জীবন ও কর্মপঞ্জির বিস্তৃত বিবরণের সঙ্গে তাঁকে নিয়ে শর্মিলা ঠাকুরের লেখা। বিভিন্ন সূত্র থেকে রচনাগুলি আহৃত হলেও দু’মলাটের মধ্যে চিনিয়ে দেয় রবি ঘোষকে। শুরুতেই তাঁর সম্পর্কে লিখছেন তপন সিংহ ‘কী সিরিয়াস চরিত্রে কী কমেডি রোলে ও ছিল সমান পারদর্শী। রবিকে কমেডিয়ান বলে ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একজন টোটাল অ্যাকটর বলতে যা বোঝায় রবি ছিল তাই।’
রবি ঘোষ তখন রামপুরহাটে গুগাবাবা-র শুটিংয়ে, তিন বন্ধুকে নিয়ে সেখানে হাজির হলেন নিমাই ঘোষ, সফরসঙ্গী বলতে ভাঙা একটা ক্যামেরা। আর তাতেই এমন ছবি তুললেন যে সত্যজিৎ বললেন ‘আপনি তো মশাই আমার অ্যাঙ্গেল মেরে দিয়েছেন।’ তৈরি হল অচ্ছেদ্য গ্রন্থি। ‘মানিকদার বাড়ির নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা ছিল... বিকেলের সময় ঘরের কোন জানলা দিয়ে আলো আসতে পারে— কিংবা কোন সময় ব্যাকলাইটটা প্রবল হচ্ছে বা জানলার বাইরে কোন গাছটা কখন বড়ো হচ্ছে, কোন গাছে কোন ফুল ধরছে— সমস্ত কিছুই আমি পর্যবেক্ষণ করতাম।’ অবিরত বলে গিয়েছেন নিমাই ঘোষ তাঁর সাক্ষাৎকার-এ (দেবভাষা, ৩৫০.০০) সৌরভ দে আর দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের কাছে। আলোকচিত্রী হিসেবে শুধু সত্যজিৎ নন, আরও কত নক্ষত্র বা বিষয় তাঁর তোলা ছবির ঝুলিতে— যা ‘খনিজ সম্পদের মতো অজ্ঞাতেই রয়ে গেছে’, সেই ‘অনুসন্ধিৎসাই’ কথোপকথনের মূল অভিপ্রায়, জানিয়েছেন তরুণদ্বয়। সেই সঙ্গে কিছু ছবিও আছে নিমাইবাবুর, যা তাঁর ভিতরকার শিল্পীকে চিনিয়ে দেয়।
‘সত্যজিৎ বুঝতে পারলেন... প্রাকৃতিক দৃশ্যে, স্বাভাবিক আলোতে আর চরিত্রানুযায়ী অপেশাদারি অভিনেতাদের নিয়ে কম পয়সাতেও ভাল ছবি করা যায়।’ সুনীত সেনগুপ্ত তাঁর সত্যজিৎ রায়-এ (দোয়েল, ১৫০.০০) লিখেছেন ‘পথের পাঁচালী’ তৈরিরও অনেক আগে থেকে সত্যজিতের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ছোটরা কাঙ্ক্ষিত পাঠক হলেও বড়দেরও ভাল লাগবে সত্যজিতের মতো শিল্পীর কর্মময় জীবনীটি পড়তে।
সিনেমার রূপকথা-য় (মন্দাক্রান্তা, ১০০.০০) ফিল্মের আঁতুর ঘর থেকে ডিজিটাল যুগ নিয়ে ছোটদের জন্য লিখেছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তবে তাঁর ভাষ্য ও ভাষান্তরে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো-র ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ (সপ্তর্ষি, ১৫০.০০) প্রয়োজনীয় সংযোজন। ‘‘ত্রুফোর প্রথম ছবি ‘ফোর হানড্রেড ব্লোজ’ আত্মজীবনীকে ইতিহাসের পথে পৌঁছে দিয়েছে। নবতরঙ্গ শুধু সিনেমার ইতিহাসে একটি অধ্যায় নয়; গোদার, ত্রুফো ও রেনের প্রথম তিনটি কাহিনিচিত্র আমাদের বেঁচে থাকার সেলুলয়েড-লিপি। গোদার একসময়ে বলেছিলেন, যদি সিনেমা পড়া যেত কি ভালোই যে হত! সেই ভেবেই... চিত্রনাট্যটির ভাষান্তর করেছিলাম।’’ শুরুতেই জানিয়েছেন সঞ্জয়, তবে চিত্রনাট্যটি পড়া শুরুর আগে অবশ্যই পড়ে নিতে হবে তাঁর ‘হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা: ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো’।
ত্রুফো প্রয়াত, কিন্তু নবতরঙ্গের অন্য দিকপাল তো এখনও কর্মময়, তাঁকে নিয়ে চণ্ডী মুখোপাধ্যায়ের জঁ লুক গোদার (গাঙচিল, ৩০০.০০)। তাতে তাঁর ছবি সম্পর্কে লেখকের অভিমত: ‘গোদার বলেন, সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে সত্য, এমনকী মিথ্যের মধ্যেও। এই যে জীবনের বৈপরীত্য, যা গোদার বার বার ছবিতে প্রকাশ করেন। এ তো ছবির বিষয়গত প্রক্রিয়া। ছবির আঙ্গিকগত জায়গাতেও ইমেজ ও শব্দের মধ্যেও তিনি তৈরি করেন বৈপরীত্য ও দ্বান্দ্বিকতা।’ গোদারের ছবির পোস্টার ও পঞ্জিও বইটিতে।
‘কঠোর পরিশ্রম না করলে ভালো কাজ করা যায় না। উনি সারাজীবনই কঠোর পরিশ্রম করেছেন।’ গৌতম ঘোষের মন্তব্য রামানন্দ সেনগুপ্ত সম্পর্কে তাঁর ছায়াছবির ছায়াপথে-র (দীপায়ন, ২০০.০০) শুরুতেই। অনুলেখক ও সম্পাদক কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায় শতায়ু রামানন্দবাবুর সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে কথোপকথনের ভিত্তিতে তৈরি করেছেন এ বইয়ের গদ্য, অনুবাদ করেছেন তাঁকে লেখা জাঁ রেনোয়ার পত্রগুচ্ছ। বইটি বিশিষ্ট সিনেমাটোগ্রাফারের স্মৃতির সরণি ধরে হাঁটতে-হাঁটতে তুলে আনে চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের সেই সন্ধিক্ষণের ইতিহাস, যখন এক তোলপাড় সময়ে ভারতীয় সিনেমায় নতুন দিগন্ত প্রায় আসন্ন। সঙ্গে কিছু দুর্লভ ছবি।
ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির আজীবন সদস্য অসীম সোমের সেই পঞ্চাশের দশক থেকে সিনেমা নিয়ে সিরিয়াস চর্চা... আর্টফর্ম হিসেবে ফিল্মের বৈভব ও বৈচিত্র নিয়ে তত্ত্ব ও তথ্যের মিশেলে লিখেছেন নিয়মিত। সেই নিয়েই বই— চলচ্চিত্র বিচিত্রা (রক্তকরবী, ২৫০.০০)। স্বাদেশিক ও আন্তর্জাতিক চিহ্নে যাঁরা চেনেন চলচ্চিত্রকে, তাঁদের চিন্তার খোরাক এ-বই। অসীমবাবুর আগের বইটি সত্যজিৎকে নিয়ে, সাম্প্রতিক বইটিতে সত্যজিতের জীবনীকার মারি সিটন-এর ১৯৫৬-য় কলকাতায় একটি ফিল্ম সেমিনার সম্পর্কে তিনি লিখছেন ‘‘মারি সিটনের মতে যে-কোনো মানদণ্ডে ‘পথের পাঁচালী’ বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ তিনটি ছবির অন্যতম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy