Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

রবীন্দ্রচর্চাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেলপ্রাপ্তির পর স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিদেশে এক মানবিক ও মিস্টিক স্রষ্টা হিসেবে। নানা ভাষায় অনূদিত হয় তাঁর লেখা।

সুরস্রষ্টা: জন অলডেন কারপেন্টার, অ্যান মারি ক্যালওয়ে এবং ভিলহেলম স্টেনহামার। বই থেকে

সুরস্রষ্টা: জন অলডেন কারপেন্টার, অ্যান মারি ক্যালওয়ে এবং ভিলহেলম স্টেনহামার। বই থেকে

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ১১:৫৭
Share: Save:

সুদূরে বাজিছে বাঁশি/ পাশ্চাত্য সংগীতে রবীন্দ্রনাথ
শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০০.০০, সিগনেট প্রেস

রবীন্দ্রনাথ এমন এক স্রষ্টা যিনি নিত্যই নব নব ভাবে উদ্‌ভাসিত। তাঁর সৃজন নিয়ে দিগন্তপ্রসারী চর্চার নতুন নতুন দিক নিয়ত উন্মোচিত হয়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের গানে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের প্রভাব বিষয়টা প্রাথমিক ভাবে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর রবীন্দ্রসংগীতের ত্রিবেণীসংগম-এর সৌজন্যে এবং পরবর্তী গবেষণায় আমাদের অনেকটাই জানা। কিন্তু খুবই কম আলোচিত একটি বিষয় হল রবীন্দ্রসৃষ্টি কী ভাবে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে জায়গা করে নিয়েছে, কী ভাবে বিদেশি নানা কমপোজ়ার রবীন্দ্ররচনা অবলম্বনে সুরসৃষ্টি করেছেন। এই স্বল্প-আলোচিত বিষয়ে বহু শ্রম ও সনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত: সুদূরে বাজিছে বাঁশি। এ সম্পর্কে একেবারেই যে কাজ হয়নি তা নয়, আলোচ্য বইটির শুরুতেই কৃতজ্ঞতা স্বীকারে তা জানিয়েও দিয়েছেন লেখক শুভব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। যথাযথ ভাবেই উল্লেখ করেছেন তপন রায়, শুদ্ধশীল সেন, রেবা সোমের লেখার কথা। সন্দেহ নেই, বর্তমান গ্রন্থে নির্দিষ্ট কয়েক জন কমপোজ়ারের কাজের সূত্রে বিষয়টিকে আরও অনুপুঙ্খ ভাবে বিস্তৃত রূপে ধরার সযতন প্রয়াস করেছেন লেখক। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের রসগ্রাহী শ্রোতা শুভব্রত মাত্র পাঁচ বছর আগে এ সম্পর্কে উৎসাহী হন। তার পর নানা সিডি, জোড়াসাঁকোয় আয়োজিত এক অনুষ্ঠান এবং উপরি-উল্লিখিত তিন জনের লেখা পড়ে আরও অনুসন্ধানে ব্রতী হন। সেই সচেতন অন্বেষণ-গবেষণার ফল আলোচ্য গ্রন্থটি।

১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে নোবেলপ্রাপ্তির পর স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে পড়ে বিদেশে এক মানবিক ও মিস্টিক স্রষ্টা হিসেবে। নানা ভাষায় অনূদিত হয় তাঁর লেখা। প্রাচ্যের এই ঋষিকল্প সৌম্যদর্শন স্রষ্টার বিষয়ে বিভিন্ন দেশের মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বেশ কিছু কমপোজ়ারও। ইউরোপ-আমেরিকার এই কমপোজ়াররা গ্যোয়টে, হাইনে, বোদল্যের, কালিদাস প্রমুখের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের টেক্সট নিয়ে সঙ্গীত রচনায় প্রবৃত্ত হন। সে সময় প্রকাশিত গীতাঞ্জলি ও দ্য গার্ডেনার বই দু’টি থেকে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতায় (তার মধ্যে গানও আছে) উদ্বুদ্ধ হয়ে সুরারোপ করেন। যতটুকু জানা গিয়েছে, প্রায় ৩০০ জন কমপোজ়ার এই কাজটি করেছেন। দু’একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এঁদের অধিকাংশেরই রবীন্দ্রসাহিত্যের সঙ্গে তেমন কোনও পরিচয় ছিল না। রবীন্দ্রগানের স্টাফ নোটেশনের অপ্রতুলতার (১৯৩৫-এ প্রকাশিত হয়েছিল বাকে ও ফিলিপ স্টার্নের টোয়েন্টি সিক্স স‌ংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর, আর ১৯৬১-তে সংগীত নাটক অকাদেমি প্রকাশ করে ওয়ান হান্ড্রেড সংস ইন স্টাফ নোটেশন) কারণে রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কেও তাঁদের তেমন কোনও ধারণা ছিল না। রবীন্দ্ররচনার সারল্য, মানবতাবোধ, অধ্যাত্মচেতনা তথা লিরিক্যাল মেজাজে তাঁরা আকৃষ্ট হন। প্রাপ্ত অনূদিত টেক্সটের উপর ব্যক্তিগত সঙ্গীতবোধ, ক্ষমতা অনুযায়ী সুরারোপ করেছিলেন তাঁদের মতো করেই। তাঁদের এই কমপোজ়িশনগুলি উপস্থাপিত হয়েছে যন্ত্রে ও কণ্ঠে।

তবে সব সময়েই কি কমপোজ়াররা টেক্সট ঠিকঠাক বুঝে সুর রচনা করেছেন? প্রেমের গান ‘আর নাই রে বেলা’-কে জন অলডেন কারপেন্টার মৃত্যুবিষয়ক কবিতা ভেবে এতে শোকের সুর লাগিয়েছিলেন— এই মত কারপেন্টার-জীবনীকার হাওয়ার্ড পোলকের। যাই হোক, বিভিন্ন কমপোজ়ারের এই কাজগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কেমন উৎসাহী ছিলেন সে ব্যাপারে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। শুভব্রত জানাচ্ছেন, একবার এক ডাচ কমপোজ়ার বের্থা ফ্রেনসেল ভেগেনার-কুপমান তিনটি রবীন্দ্রকবিতা সুরে বসিয়ে তার একটি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন স্টাফ নোটেশনে। উত্তরে নোটেশন প্রাপ্তির কথা জানিয়ে রবীন্দ্রনাথের ধন্যবাদজ্ঞাপক চিঠিটি দেন কবির সচিব। আর এক কমপোজ়ার মেরি শেলডন রবীন্দ্রনাথের ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’-র অনুবাদ সুরে বসিয়ে তা স্টাফ নোটেশনে ছাপতে চাইলে রবীন্দ্রনাথ অনুমতি দেন। অন্য একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, ১৯৩০-এ শেষ বারের আমেরিকা সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ ‘না বলে যেও না চলে’-র রিচার্ড হেগম্যান কৃত সুরারোপের প্রশংসা করেন।

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রবীন্দ্রনাথের যে রচনাটি অধিকাংশ কমপোজ়ার গ্রহণ করেছিলেন তা হল ‘আলো আমার আলো’— প্রায় আট জন তাতে সুর বসিয়েছেন। তার পর ‘না বলে যেও না’— পাঁচ জন, ‘ওগো মা রাজার দুলাল’, ‘ধরা দিয়েছি গো’, ‘সখি প্রতিদিন হায়’, ‘ওগো ভাল করে বলে যাও’, ‘আর নাই রে বেলা’ এবং ‘এই যে তোমার প্রেম’— চার জন করে সুর দিয়েছেন।

যে তিনশো জন কমপোজ়ার রবীন্দ্ররচনায় সুর দিয়েছেন তাঁদের সকলেই সুখ্যাত নন, নৈপুণ্যেরও তারতম্য আছে স্বাভাবিক ভাবেই। লেখক এঁদের মধ্যে বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের জন্মের বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে জন্মানো কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ কমপোজ়ারকে: লেওশ ইয়ানাচেক, ভিলহেলম স্টেনহামার, আলেকসান্ডার জ়েমলিনস্কি, ফ্রাঙ্কো আলফানো, জন অলডেন কারপেন্টার, ফ্র্যাঙ্ক ব্রিজ, জন ফোল্ডজ়, কারোল শিমানফস্কি ও রুদ লাংগ। এক-এক জনকে নিয়ে এক-একটি অধ্যায়। প্রত্যেকটির শিরোনাম কাব্যিক আবার অর্থবোধকও বটে। যেমন: ‘শুভ্র পবিত্র অগ্নিশিখা’: লেওশ ইয়ানাচেক ও রবীন্দ্রনাথ, সেতু-সংগীত: ফ্রাঙ্কো আলফানো ও রবীন্দ্রনাথ, জগৎ-পারাবারের তীরে: জন অলডেন কারপেন্টার, বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা: কারোল শিমানফস্কি ও রবীন্দ্রনাথ— এই রকম। লেখাগুলি পড়লেই বোঝা যায় লেখকের সঙ্গীতভাবনা ও গবেষণার গভীরতা। ওঁর সহজ বিশ্লেষণে জানা যায় ইয়ানাচেকের ‘স্পিচ মেলডি’র কথা, জ়েমলিনস্কির ‘লিরিক সিম্ফনি’র কথা... এই ভাবে লেখক প্রত্যেক কমপোজ়ারের সুর রচনার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন নানান তথ্য, নানান সূত্র সমেত। মাঝে মধ্যে সাঙ্গীতিক পরিভাষা স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবহৃত, তবে আলোচনা সাধারণ ভাবে সহজবোধ্য— অন্তত সঙ্গীতপিপাসু মানুষজনের কাছে। কমপোজ়ারদের সুর রচনার বিশ্লেষণে আসে সংশ্লিষ্ট কমপোজ়ারের জীবনীকারের বক্তব্য, বিভিন্ন বিদগ্ধ সঙ্গীত সমালোচকের মতামত। আসে সমসময়ের আরও কমপোজ়ারের কথা। এই ভাবে বিভিন্ন কমপোজ়ার ও তাঁদের কাজ সম্পর্কে একটা চমৎকার ধারণা তৈরি হয়ে যায় লেখকের অনুপুঙ্খ আলোচনায়।

এই কমপোজ়ারদের পাশাপাশি লেখক খুব সঙ্গত ভাবেই নিয়ে এসেছেন বর্তমান কালের তিন কমপোজ়ারকে: অ্যান মারি ক্যালওয়ে, ফ্র্যাঙ্ক টিকেলি ও করিম অল-জ়ন্ড। সমসময়ের আরও অনেকেই রবীন্দ্রকবিতা সুরে বাঁধলেও উক্ত তিন জনের সঙ্গে ই-মেলে যোগাযোগ করতে পেরেছেন বলে সেই সূত্রে লেখক তুলে ধরেছেন ওঁদের সুর রচনার কথা। শেষে ‘উত্তরলেখ’-তে এসেছে দু’তিন জন প্রতিভাবান বাঙালির পাশ্চাত্য সঙ্গীতপ্রেম প্রসঙ্গ— বিশেষত সত্যজিৎ রায়ের কথা।

লেখকের কমপোজ়ার নির্বাচন নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। ভূমিকায় লেখক স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর এই প্রয়াসকে ‘ক্ষুদ্র’ ও ‘অসম্পূর্ণ’ বলেছেন। এর বাইরেও আমরা দেখতে পাই আরও নানা কমপোজ়ার রবীন্দ্ররচনা নিয়ে কাজ করেছেন। যেমন মিখেইল ইপ্পোলিটভ-ইভানভ, এরিক ফগ, জোসেফ আলেকসান্দার, দারিয়ুস মিলহাউদ, আর্থার কোয়ের্নার প্রমুখ। লেখক ভবিষ্যতে এঁদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন— তাঁর বর্তমান কাজের নিরিখে এই প্রত্যাশা রইল।

যে কোনও সঙ্গীতসৃষ্টিরই প্রধান আকাঙ্ক্ষা শ্রোতার শ্রবণে পৌঁছনো। শ্রোতা না শুনলে সবই বৃথা। সেই শোনার দিকে অমোঘ টেনে নিয়ে যায় এই বই। উৎসাহ জাগে একই রবীন্দ্ররচনাভিত্তিক বিভিন্ন কমপোজ়ারের বিভিন্ন কমপোজ়িশন শোনার জন্য। রবীন্দ্ররচনা— যা আদতে গান, কিন্তু বিদেশিরা সেগুলিকে গান বলে জানেন না, তার সুর কেমন করলেন তাঁরা— সেও শুনতে ইচ্ছে হয়। এ সব ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলাতেই এ বইয়ের সার্থকতা। শোভন ও সুমুদ্রিত বইটির সঙ্গে কয়েকটি সুরের নমুনা যদি সিডি-তে দেওয়া যেত তা হলে শ্রোতা কিছুটা তৃপ্ত হতেন।

আর একটি কথা: আমাদের তিমিরবরণ রবীন্দ্ররচনা অবলম্বনে কমপোজ়িশন করেছেন। যেমন ‘শিশুতীর্থ’। শুধু পাশ্চাত্যের নয়, আমাদের বিভিন্ন প্রদেশের অবাঙালি বা প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের কমপোজ়াররা রবীন্দ্ররচনা নিয়ে কতটুকু কাজ করলেন সে বিষয়েও পরোক্ষ ভাবে আগ্রহান্বিত করে বর্তমান গ্রন্থ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy