বিদেশি শিল্পীর চোখে ভারতীয় প্রকৃতির বিস্ময়। ওরিয়েন্টাল সিনারি, টমাস ড্যানিয়েল (১৭৮৯-৯০)।
‘পিকচারেস্ক’। ছবির মতো। যেমন তেমন ছবি নয়, এক বিশেষ ধরনের চিত্রশৈলীর বিশেষণ হিসেবেই শব্দটির ব্যবহার। মূলত প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি আঁকার এই রীতি আঠেরো-উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে চূড়ান্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। বস্তুত ফরাসি ইমপ্রেশনিস্টদের প্রভাব পড়ার আগে পর্যন্ত ব্রিটিশ চিত্রকলা বলতে একেই বোঝাত। প্রকৃতিকে শিল্পে নিয়ে আসার এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা আঠেরো শতকের গোড়াতেই, অল্প দিনের মধ্যেই উইলিয়াম গিলপিনের লেখায় তৈরি হল ‘পিকচারেস্ক’ রীতির তত্ত্বভিত্তি, যা আরও প্রসারিত হল নাইট এবং প্রাইস-এর হাতে। চিত্রকলা থেকে উদ্যান-রচনায় ছড়িয়ে গেল এর প্রভাব। প্রকৃতিতে যা কিছু অমসৃণ, রুক্ষ, ভাঙাচোরা তা-ই এই রীতির শিল্পীর কাছে আকর্ষণীয়; সাজানো বাগান নয়, অযত্নবর্ধিত ঝোপঝাড় বা ছায়াচ্ছন্ন বনজঙ্গল; নিখুঁত বাড়িঘর নয়, ধ্বংসাবশেষই একমাত্র গ্রহণযোগ্য। তার সঙ্গে অবশ্যই থাকতে হবে বিস্ময়ের ছোঁয়া, আকস্মিকতার অভিঘাত। আবার প্রকৃতিতে যেমনটি আছে তেমনটিই যে আঁকতে হবে তা নয়। শিল্পীর থাকবে নিজস্ব পরিকল্পনা, প্রকৃতির নানা উপাদানকে সংবদ্ধ করে তাঁকে তাঁর ছবির একটি ‘চরিত্র’ তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে প্রকৃতিকে ‘সংশোধন’ করে নিতে হলেও ক্ষতি নেই। মোটের উপর এই হল এই রীতির মূল সূত্র।
কিন্তু একটি বিশেষ সময়ের ব্রিটিশ শিল্পরীতি হিসেবেই কি শুধু ‘পিকচারেস্ক’-এর গুরুত্ব? আদৌ নয়। সতেরো শতকের সূচনায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক উদ্যোগ শুরু হলেও পলাশির যুদ্ধে তারা যখন প্রথম রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ পেল তার পর থেকেই এ দেশের প্রকৃতি ও মানুষজন ইংল্যান্ডের ভাগ্যান্বেষীদের সঙ্গে শিল্পীদেরও আকৃষ্ট করতে লাগল। তাঁদের চোখে এ দেশের প্রায় সব কিছুই ‘ইগজটিক’, অদ্ভুত। চেনা জগতের একেবারে বাইরের জিনিস। প্রকৃতির অপরিসীম বৈচিত্র আর আশ্চর্য সব স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে শিল্পীরা সহজেই খুঁজে পেলেন ‘পিকচারেস্ক’-এর সেরা উপাদান। বিস্ময় তো সেখানে পদে পদে। বিলেতে তখন ‘পিকচারেস্ক’-এর রমরমা বাজার, কাজেই শিল্পীদের অন্য কিছু ভাবার কারণ ছিল না। উইলিয়াম হজেস ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পা দেন, তিনিই প্রথম শিল্পী যিনি ভারতীয় বিষয় নিয়ে এই ধারার ছবির সূচনা করলেন। এডওয়ার্ড লিয়র ১৮৭৫-এ ভারত ছাড়েন, তাঁকে মোটামুটি এই ঘরানার শেষ প্রতিনিধি বলা যায়, কারণ ফটোগ্রাফি তখন দ্রুত এই ধরনের বিষয় নিয়ে আঁকা ছবির বাজার কেড়ে নিতে শুরু করেছে। তবে এই একশো বছরে শিল্পীদের ছবি আঁকা আর ছবি বা ছবির বই বিক্রি করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি ‘পিকচারেস্ক’। ইংল্যান্ড তথা বিশ্বের দরবারে ভারত-সাম্রাজ্যের বিশেষ চেহারা তুলে ধরার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফল করার পাশাপাশি সার্বিক ব্রিটিশ-সংস্কৃতিতে এর ভূমিকা হয়ে উঠেছিল সর্বাত্মক, বিশেষত উপনিবেশে। সেখানে ‘পিকচারেস্ক’ শুধু মাত্র এক চিত্রশৈলী ছিল না, হয়ে উঠেছিল সাম্রাজ্য-ভাবনার অন্যতম প্রধান অঙ্গ, আর তাই তার প্রকাশ ঘটেছিল নানা বিচিত্র মাধ্যমে।
‘পিকচারেস্ক’ নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। হজেস থেকে ড্যানিয়েল খুড়ো-ভাইপো, চার্লস ডয়লি, জেমস বেইলি ফ্রেজার কি লিয়র পর্যন্ত শিল্পীদের অনেককে নিয়েই নানা গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু শিল্পরীতি থেকে সাম্রাজ্য-ভাবনায় চারিয়ে যাওয়ার যে বিচিত্র গতিপথ, তা নিয়ে সামগ্রিক বিশ্লেষণ কোথায়? রমিতা রায়ের আন্ডার দ্য বেনিয়ান ট্রি/ রিলোকেটিং দ্য পিকচারেস্ক ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সেই কাজটাই করতে চেয়েছে। পল মেলন সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ব্রিটিশ আর্টের তরফে প্রকাশিত এই বইটি স্বাভাবিক ভাবেই কোনও ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত নয়। স্থানবিশেষ, গাছপালা, প্রাণীজগৎ ও মানুষ— ভারতীয় প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে থেকে চারটি বিশেষ উদাহরণ বেছে নিয়েছেন রমিতা। দার্জিলিং, বটগাছ, হাতি এবং দলিপ সিংহ। ‘পিকচারেস্ক’ ধারার বিকাশ-বিস্তারের স্থানিক মাত্রায় দার্জিলিঙের কোনও জুড়ি নেই। আবার বটগাছ ও হাতি, এই দুটি উদাহরণ কী ভাবে নিতান্ত সাধারণ থেকে খুবই অসাধারণ হয়ে উঠল, ছড়িয়ে গেল সবখানে, মর্যাদা পেল প্রতীকের, তা খুঁটিয়ে দেখেছেন রমিতা। আর দলীপ সিংহকে স্বয়ং ভারতসম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া তথা ব্রিটিশ রাজ কী ভাবে দেখতে এবং দেখাতে চেয়েছিল, সেই ইতিহাসেও একই ভাবে লুকিয়ে আছে ভারতকে দেখা ও দেখাতে চাওয়ার বৃত্তান্ত।
‘পিকচারেস্ক’ প্রসঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর রমিতা ছুঁয়ে গেছেন কলকাতা থেকে বারাণসী। বারাণসী যে হজেস থেকে শুরু করে অসংখ্য শিল্পীকে টেনে এনেছিল তা সবারই জানা। বারাণসীর ঘাট, মন্দির জায়গা করে নিয়েছে ‘পিকচারেস্ক’ শিল্পধারায়, রমিতা বিস্তারে বলেছেন সে কথা। এমনকী উনিশ শতকের শেষে বা বিশ শতকের গোড়ায় ভারতীয়রা ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি বা আলোকচিত্রের মাধ্যমে এই ধারার অংশভাক হয়ে উঠছিলেন, ‘পিকচারেস্ক’ এক দিকে হয়ে উঠছিল ঔপনিবেশিকতার অন্যতম অস্ত্র আর অন্য দিকে মিলেমিশে যাওয়ার মধ্যেও লুকিয়ে ছিল ‘সাবভার্সন’, প্রতিরোধের বীজ, রমিতা দেখিয়েছেন তা-ও। তবে, পরবর্তী তিনটি অধ্যায় নিঃসন্দেহে এই বইয়ের সব থেকে কৌতূহলোদ্দীপক অংশ।
লাটসাহেবের গ্রীষ্মাবাসের পাশাপাশি দার্জিলিঙ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল অনেকগুলি কারণে। চিন-তিব্বতের বাণিজ্যপথ, অসংখ্য চা-বাগিচার অবস্থিতি, হিমালয় অভিযাত্রীদের যাত্রাপথ, সেনাবাহিনীতে গোর্খাদের নিয়োগের কেন্দ্র, এবং ভূপ্রকৃতি ও উদ্ভিদজগতের বিস্ময়কর বৈচিত্রের জন্য। এত সব উপাদানের জন্য বস্তুত দার্জিলিঙের ক্ষেত্রে ‘পিকচারেস্ক’কে নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হয়েছে। উদ্ভিদবিদ জোসেফ ডালটন হুকারকে কেন্দ্র করে রমিতা দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক শক্তি দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার বিস্তারে কী ভাবে এই নতুন সংজ্ঞাকে কাজে লাগিয়েছিল। উদ্ভিদ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে ভৌগোলিক অনুসন্ধান তো ওতপ্রোত, আর সাম্রাজ্যবিস্তার থেকেই বা তার দূরত্ব কতটুকু!
ভারতের উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ সতেরো শতক থেকে প্রায় তিনশো বছর ঔপনিবেশিক শক্তিগুলিকে কৌতূহলী করে রেখেছিল। বাণিজ্যিক প্রয়োজনের বাইরে যে একটি গাছ পর্যটকদের প্রত্যেককে বিস্মিত এবং শিল্পীদের নিরন্তর আগ্রহী করে রেখেছে, সেটি হল বট। অদ্ভুত আকার, বিশালত্ব, ধর্মীয় ঐতিহ্য সব মিলিয়ে বটগাছ ভারতীয় ‘পিকচারেস্ক’-এর অন্যতম সুপরিচিত প্রতীক হয়ে ওঠে । রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির সিল থেকে মাদাম বেলনস-এর বইয়ের প্রচ্ছদ, বারাকপুরের লাটবাগান থেকে শিবপুর বোটানিক্যালের বটগাছ প্রাক-উপনিবেশ থেকে রাজ-পর্বে অনায়াস-বিস্তৃত, তার ছায়ায় আশ্রয় পেয়েছে বিপুল ইতিহাস। একই ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে হাতি, প্রাক-ঔপনিবেশিক পর্বে যে কোনও রাজার আভিজাত্যের প্রতীক, উপনিবেশেও তার আভিজাত্য অটুট— বড়লাট হার্ডিঞ্জ হাতিতে চেপেই ১৯১২-য় দিল্লিতে ঢুকেছিলেন— এও ভারতীয়‘ পিকচারেস্ক’-এর আর এক প্রধান প্রতীক। কালীঘাট পটেও আছে হাতির পিঠে চেপে সাহেবের বাঘশিকার, সাহেবের হাতে ধরা উল্টো বন্দুক। উইলিয়াম ডার্টনের উদ্ভাবিত খেলনায় হাতির ব্যবহার অন্য মাত্রা পেয়েছে।
ঔপনিবেশিক পর্বেই থেমে যাননি রমিতা। দিল্লির লোদি গার্ডেনস থেকে বিলিতি ওয়ালপেপার কি কাপডিশের নকশায় এই ধারার প্রবহমানতা দেখিয়েছেন স্বচ্ছন্দে। আর এই ভাবেই তিনি ‘পিকচারেস্ক’কে প্রতিষ্ঠা করেছেন এক আধুনিক নান্দনিক প্রকল্প হিসেবে, সমসময়েও যার গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy