Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

প্রকৃতি আর মানুষকে নিয়ে গল্প

বহরমপুর থেকে ছোটবড় মিলিয়ে পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে নয় জনের যে দল শিমলা পৌঁছে আরও উঁচুতে উঠতে লাগল, তাদের বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই দোলনচাঁপা দাশগুপ্তের চন্দ্রতালের পরিরা (আনন্দ, ১৫০.০০)।

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বহরমপুর থেকে ছোটবড় মিলিয়ে পায়ের তলায় সর্ষে নিয়ে নয় জনের যে দল শিমলা পৌঁছে আরও উঁচুতে উঠতে লাগল, তাদের বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাই দোলনচাঁপা দাশগুপ্তের চন্দ্রতালের পরিরা (আনন্দ, ১৫০.০০)। কথক যে হেতু ক্লাস সেভেনের এক কিশোর, তাই বিস্ময়, আনন্দ, অপেক্ষা তার কাহিনির পরতে পরতে। শিমলা থেকে গন্তব্য চন্দ্রতাল— পথে পড়ল লাহলুং গ্রাম। সেইখান থেকে ঘুরে গেল গল্পের মোড়। সূত্র মিলল পৃথিবীবিখ্যাত এক শল্যচিকিৎসকের হারিয়ে যাওয়ার রহস্যের। এক দিকে সেই নিরুদ্দিষ্টের খোঁজ, পাশাপাশি কিশোর মনের স্বপ্নমাখা কৌতূহল— চন্দ্রতালের নির্মল আকাশে পরির দেখা মেলার আকাঙ্ক্ষা— ‘‘বড়দের নিয়ে গন্ডগোলটা বাধে কারণ ওরা আমাদের নির্ভেজাল বিশ্বাস করতে পারে না।’’ কিন্তু না, সববয়সীদের এক যাত্রায় পৃথক ফল হয় না— বাবার মধ্যে বন্ধু খুঁজে পেয়ে যায় সে— বিজ্ঞান আর কল্পনার যে কোনও সত্যিকারের আড়ি নেই।

রমা ঘোষের টাবু (ঋত প্রকাশন, ১৫০.০০) পাঁচটি গল্পের সঙ্কলন। ‘ফুটির ডুম’ গল্পে রাজ্যের নাম দিলাকাশ, শুনলেই প্রাণ জুড়োয়। সেইখানে খেতের ফুটির ফলন বিখ্যাত। নকুল চাষির আজব ফুটি একটা ছোটখাট পাহাড়ের আকার নিল। রাজার নিষেধ সত্ত্বেও সেই ফুটি কেটে চেখে দেখতে গিয়ে সে কী কাণ্ড— ফুটি ফেটে নদী বইল দিলাকাশের বুকে। প্রকৃতি আর মানুষকে জুড়ে গল্প তৈরি হয়, তাকে প্রাণবন্ত করে কল্পনার মিষ্টি মিশেল। এই ভাবে ‘এক ফোঁটা শিশির’, ‘ঝিঙে ভূত’, ‘টাবু’, ‘ইতুর বন্ধু’ ছোটদের নরম মনে অবাধ প্রবেশাধিকারের নানা গুণে ভরা। পথ হারানো ছোট্ট মেয়ে ইতু জঙ্গলে পশুরাজ ও তার সঙ্গীসাথির মাঝখানে পড়ে। গায়ে তার কোনও বিপদের আঁচ লাগে না। কে তাকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেবে তাই নিয়ে নানান গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। এই না হলে ‘পাশবিক’ ব্যবহার! পদে পদে বিপন্ন কন্যাসন্তান যে নষ্ট সময়ে, তখনই তো এমন কল্পনার জাদু আনন্দময় এত।

আশরফী খাতুনের কিশোর গল্প সংকলন (করুণা প্রকাশনী, ২০০.০০) ঝকঝকে মলাটে স্পষ্ট উজ্জ্বল মুদ্রণে পঁয়ত্রিশটি গল্পের সঙ্কলন। ‘বন্ধু ভূত’ মিষ্টির স্বপ্নে এসে তাকে মন দিয়ে লেখাপড়া করার জন্য উৎসাহী করে যায়। ছোট্ট একরত্তি বোন আর দাদার গল্প ‘পুচকে সোনা হীরের কণা’। ধুম জ্বরে দাদার মাথায় জল ঢেলে তাকে প্রাণে বাঁচায় বুনি। দাদা ভাবতে থাকে, বড় হয়ে তার বুনি আর্ত মানুষের সেবায় নিশ্চয়ই আনন্দ পাবে। এমন করে প্রতিটি গল্পে ফুল ফল পাখি পরি পুতুল কুকুরছানা গঙ্গাফড়িং গুবরে পোকা— কেউ না কেউ পাতা জুড়ে মন জুড়ে গল্প হয়ে উঠেছে। কচিকাঁচারা এমন সহজ খোলামেলা জগৎসংসারে পড়া পড়া খেলায় মজবে বইকি।

বরদাচরণ ও রামরাহা (দে’জ পাবলিশিং, ২৫০.০০) শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের দশটি গল্পের অনবদ্য সঙ্কলন। লেখকের নিজের কথায়, ‘‘বরদাচরণ ও রামরাহা আমার প্রিয় চরিত্র।... যদিও দুটি চরিত্রে কোনও মিল নেই। একজন গোয়েন্দা অন্যজন গ্রহান্তরের মানুষ।’’ আটটি গল্প বরদাচরণকে নিয়ে। বুদ্ধিমান কিন্তু অস্বাভাবিক আচার-আচরণের বরদাচরণ শুধু ছোটদের কেন, বড়দেরও প্রিয় হয়ে ওঠার মতো। ‘‘কারো বাড়িতে ঢোকার সময় তিনি সদর দরজা দিয়ে ঢোকেন খুবই কম। তিনি ঢোকেন পিছনের পাঁচিল ডিঙিয়ে, পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে বা ওইরকম বিচিত্র পদ্ধতিতে।’’ রামরাহার আখ্যান দু’টি দীর্ঘ। ‘ভূতুড়ে ঘড়ি’তে পৃথিবী, আকাশ, মহাকাশ থেকে অণু পরমাণু— ধ্বংস, সৃষ্টির বিশাল খেলার প্রত্যক্ষ অংশীদার হয়ে যায় ছোট লাটু— রামরাহা আর কল্পনাতীত থাকে না। চেনা-অচেনার দক্ষ মিশেলে ‘গোলমাল’ দ্বিতীয় গল্প। ‘‘পৃথিবী যে কত সুন্দর তা প্রাণ ভরে আজ উপলব্ধি করল আংটি... এমন সুন্দর গ্রহকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায়?’’ আরও কিছু দিন রামরাহার এই পৃথিবীতে থাকা তাই তো বড় জরুরি।

শিশুসাহিত্যিক অজেয় রায়ের নানা সময় নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলিকে একত্র করে প্রকাশিত হয়েছে অলৌকিক ও রোমাঞ্চসমগ্র (সংগ্রহ ও সম্পা: অরিন্দম দীঘাল, সমুদ্র বসু। দে’জ পাবলিশিং, ৩৫০.০০)। সঙ্কলনের নামেই সংগৃহীত ৪৩টি গল্পের পরিচয় ধরা রয়েছে— ১৯৭৫-২০০৬ তিন দশক জুড়ে লেখা গল্পগুলিতে কোথাও ভূতের ভয়, কোথাও ভূতের মজা, কোথাও রহস্যরোমাঞ্চের মনোগ্রাহী নকশা পাঠককে সম্মোহিত করে রাখে। দুই মলাটের মধ্যে এমন সঙ্কলন লেখককে কিশোর পাঠকের সামনে সামগ্রিকতায় তুলে ধরে। কয়েকটি মুদ্রণ প্রমাদ সামান্য রসভঙ্গ করলেও গল্পগুলির টানটান আকর্ষণই জিতে যায় শেষ পর্যন্ত।

ক্ষমতাস্পর্ধী, প্রতিহিংসাপরায়ণ দলতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় প্রতি দিন যখন গণতন্ত্রের মৃত্যু দেখে অসহায় মানুষ, ছোটদের দুনিয়াটাও যখন রুটিনে বাঁধা জীবনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ন্যুব্জ, দীপান্বিতা রায়ের ইচ্ছেপরির রূপকথা (শিশু সাহিত্য সংসদ, ১১০.০০) সহজ গদ্যের জাদুতে তখন অন্য এক প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। ‘বাজি রইল মালপো’, ‘পেটুক রাজার সাজা’, ‘এক যে ছিল রানি’, ‘ইচ্ছেপরির রূপকথা’র মতো গল্পের রাজারা মুক্ত মন ও নিরপেক্ষ গুণগ্রাহিতার প্রতীক। লেখার জাদুতে রাজার গল্প হয়ে ওঠে সময়োপযোগী। চার সুসন্তানের জনক হয়েও রাজা তাই বলতে পারেন, ‘‘রাজপুত্রকেই যে রাজা হতে হবে তার কী মানে আছে?’’ জাত পাত শ্রেণি লিঙ্গ-অবস্থান অতিক্রম করে এই তো প্রকৃত রূপকথা, যা ঘোর অসময়েও রূপান্তরের স্বপ্ন দেখায়।

দশটি নানা স্বাদের গল্পের সঙ্কলন দীপান্বিতা রায়ের সিংহের মুখ (আনন্দ, ১৫০.০০)। পড়ে ফেলার পর মনে হয় বইয়ের নাম ‘দশে দশ’ হলেই মানাতো ভাল। ‘ডাইনিং টেবিল’-এর মতো স্নিগ্ধ ভূতের গল্প ভয় দেখায় না, শেষ বেলায় চোখের কোণে মনকেমনের ফোঁটা। পথের প্রান্তে নিরাশ্রয় লক্ষ্মীকে উদ্ধার করে ট্যাক্সি ড্রাইভার আনোয়ার, সেই মেয়ে যেন ‘চেনা ঠিকানা’ গল্পে তিন বছর আগে মৃত বোন সাবিনার শূন্যতা ভুলিয়ে দেয় আনোয়ারদের বস্তির ঘুপচি ঘরে। ‘বিল্টুর পাঠশালা’ বা ‘কল্পনার ডানা’ বুঝিয়ে দেয় বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, স্নেহের আর্তি কিছুই হারায়নি— স্কুলে আসার রাস্তাটাই যে বিল্টুর আরেক মাস্টারমশাই আর আকাশ ছোঁওয়া টিয়ারাকে যে স্কুলের দিদিমণিই এক দিন বলেছিলেন, ‘‘তোমার কিন্তু দু’খানা ডানা আছে। অমন ডানা সবার থাকে না।’’ এমন সব জীবনরসে টইটম্বুর গল্প এক সঙ্গে বসে পড়লে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ কাছ ঘেঁষতে পারবে না। একটা গল্পের শেষে দ্রুত অন্য গল্পে চলে যেতেও ইচ্ছে করবে না। একটা গল্পের রেশ মথিত করবে প্রবীণ-নবীন পাঠককে। ছোটরা পড়ে না পড়ে না বলে অভিযোগ না করে ছোটদের নিয়ে গল্প পাঠের আসরে এমন সব সত্যিকারের বাঁচার গল্প পাঠ করি চলুন— দুনিয়া সমৃদ্ধ হোক।

ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

অন্য বিষয়গুলি:

Review Book Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy