শিশিরকুমার দাশের তিন অন্ধ নামের সংলাপিকায় ওইদিপৌস আর ধৃতরাষ্ট্র কথোপকথন রত। ওইদিপৌস জানালেন ধৃতরাষ্ট্রকে, “তুলনা করবেন না, তুলনা বড়ো দুর্গম পথ, পদে পদে ভ্রান্তির সম্ভাবনা, পদে পদে সম্ভাবনা বিপদের।” শিশিরকুমার বিদ্যাচর্চার দুর্গম পথকেই নির্বাচন করেছিলেন। সে অধিকার ছিল তাঁর— কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় ১৯৫৭ সালে রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলেন, তার আগে স্নাতক স্তরেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। কলকাতা ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু’বার ডক্টরেট করেছিলেন তিনি— বাংলা বিদ্যাচর্চার প্রাদেশিক সীমা অতিক্রম করতে সমর্থ হয়েছিলেন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাঁর কর্মস্থল। তাঁর লেখা বঙ্কিমজীবনী (দি আর্টিস্ট ইন চেনস), সাহিত্য অকাদেমি থেকে খণ্ডে-খণ্ডে প্রকাশিত ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস ও রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখাপত্রের সুসম্পাদিত সঙ্কলন দি ইংলিশ রাইটিংস অব রবীন্দ্রনাথ টেগোর-এর প্রথম তিনটি খণ্ড তাঁকে সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। জ্ঞানচর্চায় অনলস, গ্রিক ভাষায় সুপণ্ডিত শিশিরকুমার কেবল জ্ঞানতত্ত্ব ও কাব্যতত্ত্বেই সারস্বত প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন তা নয়, কাব্য ও নাট্য সৃজনেও সরস্বতীর অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন। এ কাজ জ্ঞানচর্চার থেকেও কঠিন, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকতে হয়েছিল বলে বাংলা ভাষার নিত্যস্পন্দিত বাক্জগৎ থেকে দূরেই থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে এতে দমে যাননি। প্রবাসে বাঙালিদের নাট্যচর্চায় যোগ দিয়েছিলেন— তাঁর সৃজনশীলতা মৌলিক কবিতা রচনায়, অন্য ভাষার কবিতার অনুবাদে ও নাট্য রচনায় বেগবতী।
অপ্রকাশিত নাটক সংগ্রহ শিশিরকুমার দাশ,
সংগ্রহ ও সম্পা: সার্থক দাস
৪৯৯.০০
জয়শ্রী প্রকাশনী
তরুণ গবেষক সার্থক দাস শিশিরকুমার দাশের অপ্রকাশিত নাটক সংগ্রহ সম্পাদনা করেছেন। এই গ্রন্থে মোট ছ’টি নাটক সঙ্কলিত। ‘চশমা’ (১৯৫৫), ‘দুঃখ-দয়া-সান্ত্বনা’ (১৯৬২), ‘জীমূতবাহনের গারো যাত্রা’ (১৯৬৯), ‘কুমির’ (১৯৭০), ‘ভোমরা’ (১৯৭০) ও ‘উত্তরা’ (১৯৭১)— ছ’টি নাটক পড়লে বোঝা যায়, শিশিরকুমার শিক্ষক বলেই হয়তো সামাজিকতার ক্ষেত্রে সহজ অথচ প্রয়োজনীয় কতকগুলি মূল্যবোধে সুদৃঢ় ও সুস্থিত থাকতে চাইছেন। সেই মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুতি তাকে বেদনা দিচ্ছে— সেই বেদনা কখনও প্রকাশিত হচ্ছে কৌতুকে, কখনও বেদনার মাত্রা এতটাই গভীর যে কৌতুকের স্তর অতিক্রম করে তা গভীর তীব্র অভিঘাতপূর্ণ ঘটনাপরম্পরা অনিবার্য করে তুলছে। ‘জীমূতবাহনের গারো যাত্রা’ নাটকে লোকসংস্কৃতি-গবেষকদের পদ্ধতিগত ত্রুটি নিয়ে কৌতুক রয়েছে। সেখানে বাট্টু বলে এক কবি চলতে-ফিরতে ‘লোককবিতা’ রচনা করেন। “ছেল্যা ডাকে মাগো মাগো আনছি কলার পাত,/ কাঁঠাল বিচি দিয়া আমি খাব দুইটা ভাত।” অধ্যাপক জীমূতবাহন এ কবিতা শুনে ‘আহা! আহা!’ করে ওঠেন। বলেন, “এই তো বাংলাদেশ! কলার পাতা! কী গভীর শান্তি।” ‘ভোমরা’ নাটকে এক অধ্যাপক একটি পানীয় কোম্পানিকে পানীয় তৈরির যে ফর্মুলা দিয়েছেন তা আক্ষরিক অর্থে রক্তখেকো। তারা বিক্রি করে এইচবিএস— হিউম্যান ব্লাড শরবত। তা বুঝতে পেরে প্রফেসর মজুমদার প্রায় উন্মাদ হয়ে যান। নাটকের শেষে প্রফেসর রক্ত-শোষক যন্ত্রটি ধ্বংস করতে সমর্থ হন। ১৯৭০-এর নাট্যসংলাপ ২০২৩-এ সম্প্রসারিত অর্থে তাৎপর্যবাহী।
‘লম্বা লোক: চাকরি দিয়েছ, কিন্তু কী চাকরি— রোজ রক্ত নেবে। (গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে) কত লোক যে আছে, রক্ত নেয়।...
জন: পালাবার কোনও পথ নেই।...
লম্বা লোক: কোনও পথ নেই?...
জন: না। ফিরে যা। ওখানে খেতে পাস, পরতে পাস। জানেন এঁদের জন্য সপ্তাহে একবার সিনেমা দেখাবার বন্দোবস্ত পর্যন্ত আছে। অথচ ব্যাটারা এত অকৃতজ্ঞ।’
প্রবন্ধসংগ্রহ
শিশিরকুমার দাশ
৭৫০.০০
দে’জ
নাট্য রচনার সময় শিশিরকুমার মনে রাখতেন তিনি বঙ্গভূমির থেকে অবস্থানগত দূরত্বে রয়েছেন, বাংলাভাষী অঞ্চল থেকে দূরে আছেন বলেই নাটকগুলিতে অনেক সময় ভৌগোলিক অস্পষ্টতা তৈরি করতেন।
শিশিরকুমার দাশের প্রবন্ধসংগ্রহ বইটিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধাবলি রয়েছে। তবে সেগুলির বিন্যাসে তেমন কোনও পরিকল্পনা বা সম্পাদনাকৃত্য চোখে পড়ে না। যেন দু’মলাটে প্রবন্ধগুলিকে ধরানোই লক্ষ্য। অবশ্য, দু’মলাটের মধ্যে শিশিরকুমারের লেখা অনেক প্রবন্ধ পাওয়া যাচ্ছে, এটাই বাঙালি পাঠকের গভীর প্রাপ্তি। অনেকগুলি প্রবন্ধই পাঠ ও প্রকাশকালে শ্রোতা-পাঠকদের আন্দোলিত করেছিল। সাহিত্য অকাদেমির বিভূতিভূষণ বিষয়ক আলোচনাচক্রে উপস্থাপিত প্রবন্ধ ‘আরণ্যক: ভারতবর্ষ কোন্দিকে?’ এক সময় সাহিত্যের পড়ুয়াদের মুখে-মুখে ফিরত। ভারতবর্ষের ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব শিশিরকুমারের আলোচনার বিষয়। ভারতবর্ষ নামের এই ভূখণ্ডে নানা জনজাতির বাস। ভিন্ন-ভিন্ন জনজাতির কল্পনায় যে দেশ উঠে আসে তার রূপ ‘এক রকম’ নয়। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের আগে ও পরে দেশসম্বন্ধীয় কল্পনার চরিত্র ভিন্ন। বিভূতিভূষণের আরণ্যক-এর ভানুমতী ইংরেজ উপনিবেশ-শাসিত ভারতবর্ষ ঠিক কোন দিকে তা জানে না। সেই ‘ভারতবর্ষ’ তার কল্পনার অন্তর্বর্তী নয়। আবার উপনিবেশের অবসান হল যখন, যখন দ্বিধাবিভক্ত স্বাধীনতা জুটল, তখন আত্মপরিচয়ের সঙ্কট ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত। শিশিরকুমার ‘ছিন্নভিন্ন অর্ধশতাব্দী’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “দেশবিভাগের ফলে অনেক কিছুর মতোই ক্ষতবিক্ষত হয়েছে আমাদের ভাষা এবং সাহিত্য, আহত হয়েছে আমাদের ভাষা ও ভূগোলে জড়ানো ঐতিহাসিক অস্মিতা।” অস্মিতা ও আত্মপরিচয়ের এই সঙ্কট ভারতীয়দের কাছে যে ভাবে ধরা দেয়, ভারতবন্ধু বিদেশি-বিদেশিনিদের কাছে সে ভাবে ধরা দেয় না। বরং তাঁরা অন্তর্গত আধ্যাত্মিক এক ভারতের কল্পনা করেন— কখনও কখনও প্রাত্যহিক উপাদানের সমবায়ে। ‘নিবেদিতার ভারতবর্ষ’ প্রবন্ধে শিশিরকুমার জানাচ্ছেন, “নিবেদিতা অতীত ভারতবর্ষকেই একমাত্র ভারতবর্ষ মনে করেননি।... অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কালপ্রবাহে ভাসমান অনন্ত ভারতী মূর্তিটির সন্ধান করেছেন নিবেদিতা।” এই যে ত্রিকালিক পারম্পর্য, এক দিকে তার কল্পনা অন্য দিকে বাস্তব অভিজ্ঞতা এই ত্রিকালিক পারম্পর্যকে ভেঙে দিচ্ছে— ভানুমতীরা খুঁজেই পাচ্ছে না কোন দিকে তাদের ভারতবর্ষ! আর যে দেশভাগের অভিজ্ঞতা নিবেদিতার প্রয়াণের অনেক পরবর্তী, সেই দেশভাগ তো ভৌমিক ও মানসিক দেশের মধ্যে তৈরি করেছে বিবিক্তির তীব্র যন্ত্রণা।
আলাদা ভাবে মনোযোগ দাবি করে ‘ভারতীয় রাজনৈতিক উপন্যাস’ ও ‘ব্রহ্মপুত্র’ রচনা দু’টি। প্রথম প্রবন্ধটি পড়লে বোঝা যায়, সাহিত্য-সংরূপের ধারণাটি কী অর্থে সার্বজনিক না হয়ে কখনও কখনও বিশেষ ও দৈশিক। ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামের লেখাটি বুঝিয়ে দেয়, প্রাবন্ধিক শিশিরকুমার এক দিকে যেমন বিদ্যায়তনিক পরিবেশনের শর্ত মেনে যুক্তি সাজাতেন, তেমনই কখনও বিদ্যায়তনিক ছাঁচের বাইরে গিয়ে উক্তি ও উপলব্ধির সংযোগে তৈরি করতেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতর্কের নিজস্ব বুনট। প্রবন্ধসংগ্রহটি শুধু পড়ার বই নয়, সাহিত্যের পড়ুয়াদের লিখতে শেখার হ্যান্ডবুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy