Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

কবিতার বিশাল অন্তঃপুরে

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য পাঠককে টেনে নিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা রচনার এক নিভৃত নেপথ্যলোকে। বইয়ের নামটা চমকে দিয়েছিল।

নেপথ্যলোক: সৃজনে মগ্ন রবীন্দ্রনাথ। হেমেন্দ্রমোহন বসুর তোলা ছবিটি দেবজ্যোতি দত্তের সৌজন্যে

নেপথ্যলোক: সৃজনে মগ্ন রবীন্দ্রনাথ। হেমেন্দ্রমোহন বসুর তোলা ছবিটি দেবজ্যোতি দত্তের সৌজন্যে

অভীককুমার দে
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০১:১৪
Share: Save:

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো কোন পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী।

কবির জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত সে ‘তরী’ কোথাও তো ভিড়ল না, সহৃদয় চিত্তে তার চির আশ্রয়। মনে পড়ে ছিন্নপত্র-এর বহু চর্চিত কথাটা— ‘‘কবিতা আমার বহু কালের প্রেয়সী’’— সেই নিতান্ত শিশুকাল থেকেই তিনি তাঁর লীলাসঙ্গিনী, সুদীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে কখনও তাঁর প্রেয়সীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটল না। এই প্রেয়সীর কথায় বলেছিলেন, ‘‘যাকে বরণ করেন তাকে নিবিড় আনন্দ দেন, কিন্তু এক-এক সময় কঠিন আলিঙ্গনে হৃৎপিণ্ডটি নিংড়ে রক্ত বের করে নেন’’।

অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য পাঠককে টেনে নিয়ে গিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা রচনার এক নিভৃত নেপথ্যলোকে। বইয়ের নামটা চমকে দিয়েছিল। বইটির অলিখিত দুটি ভাগ আছে, যদি বলি লেখক তাঁর পাঠকক্ষে থিয়োরিটিক্যাল ক্লাস বসিয়েছেন, তা হলে মন্দ হয় না। সেখানে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হাজির, কবিতা সম্পর্কে তাঁর নানা বয়সের নানা সময়ের উপলব্ধি পেশ করেন। কেমন করে টেনেছিল সেই নীল খাতা, লেটস ডায়রি থেকে মালতী পুঁথি। গ্রন্থকার ধীর পদক্ষেপে পাঠকদের নিয়ে আলো ফেলে ফেলে চলেছেন, কবির সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের দিন থেকেই।

আর যে কবির, ‘‘বেলা যায়, গানের সুরে জাল বুনিয়ে’’, ওই সাজঘরেই গান রচনারও কিছু কিছু নেপথ্য কথা লেখকের সামনে এসে পড়ে।

প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের চেহারাটা ভিন্ন। তাঁর সুরটাই আলাদা, এই অংশটাকেই আমরা বলেছি গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগ। জমাটি বৈঠকে গ্রন্থকার আছেন, আছেন পাঠককুল, সেখানে রকমারি রবীন্দ্র-রচনাবলি আছে, আছে রবীন্দ্র-পাণ্ডুলিপি। পুনশ্চ-র ‘ছেলেটা’, শ্যামলী-র ‘তেঁতুলের ফুল’ আর ‘কনি’, নির্বাচিত তিনটি কবিতার মুদ্রিত খোলা পাতার সঙ্গে কবিতাত্রয়ের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পাশাপাশি রেখে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণে কবিতার বিশাল অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছেন লেখক। গ্রন্থের পঁয়ষট্টি পৃষ্ঠাব্যাপী এই তিনটি কবিতার মুদ্রণ পূর্ববর্তী পাণ্ডুলিপিতে ধরে রাখা তাদের পূর্ব–রূপ, এই গুরুগম্ভীর আলোচনা অন্তত সাধারণ পাঠকের কাছে অনেকটা নীরস লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু আলোচকের কলমের জাদু আমাদের এক মহৎ কবির রহস্যঘেরা মানসলোকে টেনে নিয়ে যায়।

কবিতাগুলির মধ্যে ‘কনি’ আয়তনে অনেকটাই ছোট, তারও পাঁচটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। শুধু পাণ্ডুলিপি তো নয়, কবি অনেক সময় প্রুফ দেখতে গিয়েও শব্দ বা ছত্র পরিবর্তন করতেন। কত কাটা ছেঁড়া কত সংযোজন, পুনর্বিচারে বর্জনই বা কত। গ্রন্থকার পরম ধৈর্যে এবং নিষ্ঠায় ক্ষুদ্রতম বদলের দিকেও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কখনও বা অন্য-কৃত প্রেস কপির ভুলটুকুই যে রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডুলিপির সঠিক শব্দের পরিবর্তে স্থায়ী আসন নিয়েছে রবীন্দ্রগ্রন্থাবলিতে, সেই শব্দটির প্রতিও পাঠককে মনোযোগী করেন। লেখক কী ধৈর্যে পাঁচটি পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে ‘কনি’ কবিতার গড়ে ওঠার কাহিনির সন্ধানে ফিরেছেন তা বিস্মিত করে, ‘‘একটি কবিতা কত অজস্রবার যে সংশোধন–সংযোজন পরিবর্জন ও পরিমার্জনের পর কবির মনঃপূত হত— তার এক উজ্জ্বল বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত এই কনি কবিতাটি।’’

রবীন্দ্রনাথ/ কবিতার সাজঘরে অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ২৫০.০০, আশাদীপ

অত্যন্ত পরিচিত কবিতা ‘ছেলেটা’ যেমন অসাধারণ তেমনই অসাধারণ পাণ্ডুলিপির বিচারে তার সৃজনের নেপথ্যলোক। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘পরিচয়’ (কার্তিক ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ) পত্রিকায় ‘ছেলেটা’ ছাপা হয়েছিল, ‘‘তিন মাস আগের পাঠ আর তিন মাস পরের পাঠের মধ্যে অনেক তফাৎ।... এমন হতে পারে— কবি প্রুফেই আগাপাস্তালা সংশোধন করলেন। মুদ্রণকালে কবিতায় নূতন ২৮ ছত্র সংযোজিত। কবিতার বিভিন্ন স্থলে দুটি চারটি করে লাইন যুক্ত হয়ে মোট সংযোজিত ছত্রসংখ্যা ২৮। বইয়ে কবিতার মোট ছত্রসংখ্যা ১৪৮।’’ মুদ্রিত গ্রন্থে কবিতাটি শুধু আয়তনে অনেকখানি বাড়েনি, বিভিন্ন শব্দের পরিবর্তনে চিত্রকল্পের বিচিত্র ভিন্নতার তাৎপর্য বিশ্লেষণগুণে যে কী অসামান্যতা লাভ করেছে লেখক তা একটি একটি করে মেলে ধরেছেন মুগ্ধ পাঠকের সামনে। কত বার পড়েছি এ কবিতা, ‘সিধু গয়লানি’-র স্নেহটুকু যে পেয়েছিল সেই অনাদরের ছেলে, ভালই লাগতো সেটুকু। গ্রন্থকারের বিচারে, ‘‘সিধু গোয়ালিনীর নূতন সংযোজন মূল কাহিনির তীক্ষ্ণতা নষ্ট করেছে।’’

শ্যামলী-র ‘তেঁতুলের ফুল’ আলোচনা যেন আরও বহু গুণে চমকপ্রদ। সেই কবে কিশোরবেলায় নিজেদের বাড়ির পাঁচিলের ধারের গাছটি তাঁর চোখে পড়েও পড়ত না যেন। রবীন্দ্রকাব্যে নামী-অনামী অজস্র ফুলের বন্দনা, ‘তেঁতুল ফুল’ও পেল তার স্বীকৃতি বহু বছর পরে। প্রথমে ছিল, ‘ছোটো একটি মঞ্জরী’; ‘ছোটো’ কেটে হল ‘সুকুমার’। কবির কলম ‘লাজুক একটি মঞ্জরী’-তে স্থির হল। অমিত্রসূদন অনুসরণে তবু বলব, ফুলের নয় ওই উপেক্ষিত গাছটি স্তবকে স্তবকে হয়ে উঠল কবিতার মূল অবলম্বন। কৃপণ মাটিতে বাড়তে না পারা সে গাছ জুড়ে বসেছে কবির সমস্ত মন। স্মরণ করি অবনীন্দ্রনাথের লেখাতেও গাছটি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে, ‘‘বাড়ির ঈশানকোণে বিশাল একটা তেঁতুলগাছ, সে যে কত দিনের কেউ বলতে পারে না। দৈত্যের হাতের মতো তার মোটা মোটা কালো ডাল। এ-বাড়িতে ও-বাড়িতে যত ছেলেমেয়ে জন্মেছি তাদের সবার নাড়ি পোঁতা ছিল ওই গাছের তলায়।’’ আলোচ্য বইয়ে গ্রন্থকার স্তরে স্তরে এই কবিতার পাঁচটি পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে যেন ছবির পর ছবি এঁকেছেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘নিজের লেখা নিজের পছন্দ হয় না রবীন্দ্রনাথের। অ-সন্তোষ আর অ-তৃপ্তি কবির মধ্যে যদি না থাকত তা হলে রবীন্দ্রনাথ জীবনে যত কবিতা লিখেছেন তার তিনগুণ বেশি কবিতা লিখতে পারতেন; তার নাটক-উপন্যাস সম্পর্কেও সেই একই কথা। রবীন্দ্রসৃষ্টির সবচেয়ে কঠিন সমালোচক রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং।’’

কবির অন্তিমবেলায় যে তিনটি কবিতা রচিত হয়েছিল, গ্রন্থের শেষ কয়েকটি পৃষ্ঠায় তারই দু’টিকে উপলক্ষ করে লেখক এ গ্রন্থের শেষ রেখা টেনেছেন, তা আশ্চর্য মর্মস্পর্শী।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy