অভিনয়: তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নাটকের দৃশ্য। ছবি সৌজন্য: চেতনা নাট্যগোষ্ঠী।
মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত: নির্মাণ-বিরোধ-অন্তর্ঘাতের বয়ান
সুমন মুখোপাধ্যায়
৩৯৯.০০
দে’জ়
সুমন মুখোপাধ্যায়ের প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলনের পরিকল্পনাটাই আলাদা। এটি গত কুড়ি বছরের লেখালিখির গ্রন্থিত আকার। যোগ্য সম্পাদনা— সুমনের ভাষায়, ‘ম্যান মার্কিং’— দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
একেবারে নামকরণ থেকেই বোঝা যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়ের অভিপ্রায় ও অভিমুখ নাট্যবিষয়ক আর পাঁচটা বইয়ের থেকে আলাদা। নাম মঞ্চ-চিত্রের বৃত্তান্ত, তার পরেই উপশিরোনাম, নির্মাণ-বিরোধ-অন্তর্ঘাতের বয়ান। সচেতন ভাবেই লেখক সাম্প্রতিক কালে চর্চিত সমাজবিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শনের পরিভাষাগুলি তার যথাযথ পরিপ্রেক্ষিত-সহ আলোচনা করেছেন। তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্র সুমন, পরবর্তী কালে নাট্যপ্রশিক্ষণের অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন স্বদেশ-বিদেশের বিবিধ উদ্যাপিত কেন্দ্রে। ফলে, সমকালীন বিশ্বপরিসরের তর্কচিহ্নগুলির আঁচ বহুলাংশে এই লেখাগুলিতে প্রতিভাত। বইয়ের জোরও সেখানে।
বাংলা মঞ্চে সুমন বেশ কয়েকটি ভিন্নধর্মী চিহ্ন স্থাপন করেছেন। ‘চেতনা’ থেকে ‘তৃতীয় সূত্র’— এই পরিক্রমায় বারংবার তিনি চেনা চৌহদ্দি ভাঙতে চেয়েছেন। একটু ঝুঁকি নিয়েই বলি, সিনেমা নির্মাণে বরং তিনি, তুলনায়, প্রথানুগ। ‘মঞ্চ-চিত্র’ শব্দটিও তাঁর চমৎকার সংযোজন। ভরতের নাট্যশাস্ত্র-এও চলমান দৃশ্যমালা গ্রন্থনার ইশারা ছিল। সুমন ঐতিহ্যের বিস্তারে তার সঙ্গে যোগ করলেন আত্মসংলাপ, আত্মজিজ্ঞাসা আর বড় অর্থে ‘রাজনৈতিক’ প্রশ্নগুলিকে। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, ধারালো রসিকতা, প্রতিস্পর্ধী প্রতর্ক, সংশয়ী স্বীকারোক্তিতে বইটি উপভোগ্য। ঈর্ষণীয় তাঁর গদ্যভাষা।
চারটি মূল পর্বে বইটি নির্মিত। সব থেকে বড় অংশ ‘থিয়েটার’। এ ছাড়া, ‘বিবিধ’, ‘ব্যক্তিত্ব’ এবং শেষে তিনটি সাক্ষাৎকার। আমি তার সঙ্গে উল্লেখ করব গ্রন্থভূমিকার প্রসঙ্গ। তার গুরুত্বও কম নয়। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত থেকে মেফিস্টো, নাট্যনন্দনতত্ত্ব থেকে নাট্যসঙ্গীত, হাবিব তনভীর থেকে দেবেশ রায়, নবারুণ ভট্টাচার্য, আবার পিনা বাউশ, কবীর সুমন থেকে বাদল সরকার, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়— বই জুড়ে তাৎপর্যময় ঈক্ষণের বিচ্ছুরণ! ব্রাত্য বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে নাট্যচিন্তার আনাচকানাচ, দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথায় চলচ্চিত্র-নির্মাণ ভাবনা। আছে ট্রান্সজেন্ডার থেকে সন্ত্রাস বিষয়ে পরিপ্রশ্নও।
সুমন এই বইয়ে হাট করে খুলে দিয়েছেন পরিচালকের অন্দরমহল। আইজ়েনস্টাইনের ফিল্ম ফর্ম বইয়ের ‘পারস্ প্রো টোটো’ কী ভাবে তাঁকে সাহায্য করেছে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-কে মঞ্চরূপে নির্ধারিত করতে। জানিয়েছেন, ম্যাক্স রাইনহার্ট, গর্ডন ক্রেগ, খালেদ চৌধুরী, পিটার ব্রুক, অ্যান বোগার্ট, বাদল সরকার প্রমুখ কী ভাবে তাঁর প্রতি মুহূর্তে নাট্যভাষ নির্মাণে সাহায্য করেছেন। “নাট্যভাষের কথা বললেই একটা ভুল বোঝার অবকাশ তৈরি হয় যে, নাটককে আমি একটা নির্দেশকের মাধ্যম হিসেবে দেখছি। নাট্যভাষ বা থিয়েটারের ভাষা মানে শুধু নির্দেশের এক্তিয়ার নয়, এ এক সমগ্র প্রক্রিয়া। নাট্যকার থেকে শুরু করে ড্রামার্টুগ, সিনোগ্রাফার, আলোকশিল্পী, সঙ্গীতকার, অভিনেতা ও নির্দেশক মিলে এই নাট্যভাষের ফুল ফোটান।” এমন সমবায়ী শিল্পের গরজেই সুমন মুখোপাধ্যায়ের দীর্ঘ বিশ্লেষণে আসে রবীন্দ্রনাথের নাটক নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক নাট্যভাবনা। আসে, একেবারে সমকালে নাট্যপ্রয়াসের রক্তাল্পতা এবং আপসমুখী আকারপ্রকার নিয়ে সন্তাপ। এই সব কর্মতত্ত্বৈক্যের সন্ধান থেকেই তুলে দেন, অতি প্রাসঙ্গিক প্রশ্নাবলি। যার একটা পেশ করার লোভ সামলাতে পারছি না: “কাউকে একটা ‘না’ বলা মানেই যে অন্য একজনকে ‘হ্যাঁ’ বলা হল সেটা ভেবে নেওয়া ঠিক হবে না। আসলে বাঘারুদের কাছে এ সবই অবান্তর। রাষ্ট্র, ভোট, পার্টি। ‘ভারত উদয়’ দূরে থাক, ‘দারিদ্রসীমা’, ‘পশ্চাৎপদ অংশ’, ‘নিম্নবর্গ’ ইত্যাদি তাদের ছোঁয় না। তাদের প্রতি দিনে বাঁচাই স্বাধীন, সার্বভৌম, স্বাবলম্বী বাঁচা। তারা এই উন্নয়নশীল ভারতের বিরুদ্ধে নিজেদের, একান্তই নিজেদের এক একটি রাষ্ট্র কায়েম করেছে। এক প্রত্যাখ্যানের রাষ্ট্র।”
সুমনের প্রধান কৃতিত্ব নাট্যনির্মাণের জটিল বহুস্তরী আয়তনটিকে নানা দিক থেকে উপলব্ধির চেষ্টা। পাঠককেও তিনি সঙ্গী করে নেন। ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েও তিনি বলেন, “শেষ পর্যন্ত প্রসিনিয়াম ভেঙে আমরা নিজেদের বার করতে পারলাম না।... সেই অলটারনেটিভ ক্ষেত্রটা তো কেউ তৈরি করে দেয় না। ওটা নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়। এই অলটারনেটিভ সাইটগুলো খুঁজে বার করা এখন ভীষণ ভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।” তাঁর বয়ানের লক্ষ্য এবং উপলক্ষ স্পষ্ট হয়ে যায়। স্পষ্ট হয়, ‘নির্মাণ-বিরোধ’ কী ভাবে তাঁর কাছে ‘অন্তর্ঘাত’ হয়ে ওঠে। ইউরো-আমেরিকান থিয়েটারের শরিকিয়ানা তাঁকে ভাষ্যের অন্তর্মুখটি চিনিয়েছে। “যদি সব টেকনিক কাজে লাগিয়ে আমি তৃপ্ত হয়ে থাকতাম তা হলে হয়তো সেটা ক্র্যাফট হতে পারে, আর্ট হবে না।” অথবা বলেন, “মঞ্চের অনুশীলনের মধ্যে দিয়েই নাট্যকারকে খুঁজে পাওয়া যায়, নাট্যের প্রাণকেন্দ্রের হদিস মেলে। শেক্সপিয়ার বা রবীন্দ্রনাথ যে মাপেরই প্রতিভা হোন না কেন, আমার কাজের সময় তিনি আমার সহকর্মী।” বারংবার সুমন নাটকের নিহিত মেটাফরকে স্পর্শ করার কথা বলেন। মনে করিয়ে দেন, মঞ্চে নাট্যনির্মাণ যেন অর্কেস্ট্রা সঞ্চালকের মতো এক বহু মোহনা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের সঙ্গে তাকে অনবরত সংলাপ আর বিনিময় চালাতে হবে।
সুমনের দু’-একটি অবলোকন নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। কিন্তু সমকালীন আন্তর্জাতিকতায় উত্থিত প্রতর্কগুলিকে পরিবেশনের যে ভাষা ও পরিপ্রেক্ষিত তিনি দু’মলাটের মধ্যে এনেছেন, সেই প্রচেষ্টাকে ‘শাবাশ’ বলতেই হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy