ছবি: সুব্রত চৌধুরী
কবিতাসমগ্র
সুধীর দত্ত
৩৫০.০০
সিগনেট প্রেস
যখন এক অন্তঃসারশূন্য কোলাহলের মধ্যে ‘ভয়ে আমাদের কান বধির হয়ে আছে, অন্ধ হয়ে আছে চোখ’, তখন মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের সাবধানবাণী, ‘চুপ করো, শব্দহীন হও’। এর অর্থ শব্দরৌরব থেকে শব্দের দিকে যাওয়া, শব্দের সত্যের দিকে যাওয়া। কোলাহলকে অতিক্রম করে শ্রেষ্ঠ কবিতা তো সব সময়ই সময়োত্তরকে, মন্ত্রময়তাকে ছুঁতে চেয়েছে। বাংলা কবিতায় এই মন্ত্রময়তাকে এক স্বতন্ত্র ভাস্কর্য দিয়েছেন সুধীর দত্ত।
‘‘গোল হয়ে বসেছি সব। দ্যাখো, ওই ত্রাতা আমাদের/ ফুঁ-মাত্রই লাফিয়ে উঠছেন;/ তাঁর লোল জিব/ আঁধার দ্বিখণ্ড করে, যুগপৎ ভীতি ও বিস্ময়।/ ওই দূরে দাঁতাল শুয়োর— ক্রুদ্ধ মোষ/ ওই দূরে রাত্রিচর মাংসাশী খেচর/ চকিতে বিমূঢ়। দ্যাখে প্রতিভা-নিপুণ মানুষের/ করতলগত জয়/ মহাশীত— অন্ধকার— ভয়/ হাতে তার বর্শাদণ্ড, সে অনঘ, দ্যুতিময়, সাক্ষাৎ কাল’’। (‘আগুন’, প্রাক্পুরাণ)
প্রথা-ভাঙা কাব্যভাষা দেখে চমকে উঠতে হয়, এ কি তবে জয় গোস্বামীর কবিতা? তারপর বুঝতে পারি, না, এর স্বর অনেকটা আলাদা, অভিমুখ অনিঃশেষ ভাবে ভিতর-নৈঃশব্দ্যের দিকে, ঈশ্বরচেতনা এর অন্যতম প্রধান ভিত্তি, এর রহস্যময় সাংকেতিক ভাষা অন্য সব রেখাবিভঙ্গে আঁকা। হ্রেষা ও ক্ষুরধ্বনি-র ভূমিকায় লিখেছেন, ‘দুর্জ্ঞেয়, অধরা ও অনির্মিত’-র প্রতি অমোঘ আকর্ষণের কথা। যেন ‘বিভিন্ন দেবতার তেজ’ সমন্বিত করে এই স্থাপত্যশরীর নির্মাণ। ‘‘হে জাতবেদা অগ্নি! আমরা তোমার স্তুতি গাই।/ ফিরে যাচ্ছেন অশ্বল ও আর্তভাগ। ভুজ্যু ও উদ্দালকরা।/ অতিপ্রশ্ন কোরো না, হে গার্গী, যাজ্ঞবল্ক্যের আকাশ/ তোমাতেই ওতপ্রোত।।’’ (‘জীবনের বাড়ি’, তাঁবু, মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ)
প্রধানত ‘সংবেদ’ ও ‘নির্যাস’ পত্রিকার এই কবি চিরকাল প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৮৭ সালে। কবিতাসমগ্র-তে রসুইঘর ও দক্ষিণ অগ্নি (২০১৬-২০১৭) পর্যন্ত মোট আটটি কাব্যগ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
লেখক-পরিচিতিতে বলা হয়েছে, তাঁর প্রিয় কবি টি এস এলিয়ট, রিলকে, বিষ্ণু দে আর শঙ্খ ঘোষ। আমরা নিঃশব্দে সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত করব জয় গোস্বামী ও গীতা চট্টোপাধ্যায়কে। কেউ বলবেন রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী বা মণীন্দ্র গুপ্তকে নয় কেন? কিন্তু এলিয়ট? ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ (১৯২২)-এর অনিরাপত্তা ও উৎকণ্ঠার পরবর্তী পর্বে এলিয়টের মধ্য ও শেষ পর্যায়ের ক্রমশ-স্থিতধী ‘অ্যাশ ওয়েডনেজডে’ এবং ‘ফোর কোয়ার্টেটস’-এর দার্শনিক মন্ত্রকে স্নায়ুতে ধারণ করে আছেন তিনি। যখন এলিয়টের কবিতা আর তাৎক্ষণিকের ছিন্নবিচ্ছিন্ন বর্ণনায় আবদ্ধ হয়ে থাকছে না, তা হয়ে উঠছে প্রার্থনার মন্ত্র, স্তোত্র, ইনক্যান্টেশন। হয়ে উঠছে দর্শন: ‘‘ইন মাই বিগিনিং ইজ মাই এন্ড, ইন মাই এন্ড ইজ মাই বিগিনিং’’। শব্দোত্তর এই গভীর গোপনকে আমরা রিলকেতে পাই, পাই শঙ্খ ঘোষের ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ বা ‘জলে ভাসা খড়কুটো’-য়। এবং জয় গোস্বামীর দুঃসাহসিক আত্ম-আবিষ্কারমালায়।
এই মহিরুহদের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে সুধীর দত্ত একা নিঃশব্দে নিজেকে খুঁড়ে যে পরিসর নির্মাণ করেছেন তা এই কবিতাসমগ্রে ধরা আছে। এ এক অন্য, পুরাণপ্রতিম স্বরায়ণ। যেন এই সব অভ্রময় শব্দাণুপরমাণু তাঁর নাভিমূল থেকে উত্থিত হচ্ছে, যেন সেই গভীর গোপন জীবনচর্যা তার দুই ডানা মেলে তৈরি করছে ভিন্নতর এক উড়াল। এ এক নির্জন নিভৃতচারী কথন, যা পাঠক-নিরপেক্ষ, যা দর্শনের কাছে পৌঁছয়, দর্শনকে ছোঁয়, যেমন করে ভাস্কর ছোঁয় বিশ্ব-ভাস্কর্যকে।
আমরা যদি একবার তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থের নাম দেখি, বুঝতে পারব এ এক বিকল্প যাত্রা। ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া, প্রাক্পুরাণ, দাহপুঁথি, শব্দরাত্রি ও দেবীসূক্ত, রসুইঘর ও দক্ষিণ অগ্নি...। অথবা তাঁর গদ্যগ্রন্থ: বোধিবৃক্ষতলে দেবতা ও তস্কর। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেদমন্ত্র, পুরাণ ও ইতিহাস, যার চেতনাপ্রবাহ এক স্তোত্রময় মহাকবিতার দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আধ্যাত্মিকতা যাকে দিয়েছে নতুন এক মাত্রা। এ এক অন্য ধ্বনি, এ এক অন্য রকম নৈঃশব্দ্যের মধ্যে নাভিপদ্মের পাপড়ি খুলে যাওয়া।
শব্দরাত্রি ও দেবীসূক্ত (২০১২)-র ‘গ্রন্থপরিচয়’ অংশে (কবিতাসংগ্রহ, পৃ ৩৫৮-৫৯) সুধীর দত্তের কয়েকটি উক্তি আমাদের দিশা দিতে পারে। যেমন, ‘‘সত্য এইজন্যই সত্য যে কাল ও তার ক্রমিকতাকে অতিক্রম করে সে স্থির অথচ স্পন্দমান। কবি সত্যকাম; কালের এই বহমানতার চিহ্ন বুকে ধারণ করে সে কখনো অনুচ্চকিত, কখনো সোচ্চার, আবার কখনো-বা নীরব, যদিচ সে নিত্য বাঙ্ময়।... ‘দেবস্য পশ্য কাব্যং ন মমার ন জীর্যতি।’ চেয়ে দেখ দেবতার কাব্য যা গ্রস্ত হয় না জরায়, কবলিত হয় না মৃত্যুর।’’ ‘‘আমার চৈতন্যে নাড়া দিয়েছে যা যা, আমি তীব্র বা মৃদু সাড়া দিয়েছি যেখানে যেখানে এবং মুহূর্তস্থিতির পর সিসিফাস-উত্তোলিত পাথরখণ্ডের মতো পাতালটানে গড়িয়ে নেমেছি যেখানে এবং যেভাবে, সে-সবই আমার কবিতা।’’ তাঁর ‘সংঘর্ষ ও সাযুজ্যের টানাপোড়েন’ এক অনুরণনময়তার মায়া সৃষ্টি করে। ‘‘নিরেট শব্দের মধ্যে তুমি কি আকাশ দেখ? আলোড়ন.../আলোকিত কম্প টের পাও?’’ (শব্দরাত্রি ও দেবীসূক্ত) এ যেন ক্রমহীন এক অবাধ যাত্রা, যা এক মহাজাগতিক কম্পনকে ছুঁতে চায় ‘সভ্যতা ও আত্মার পুনরুজ্জীবনের জন্য’। শব্দগুলি সুরবাহারের মতো নির্মাণ করছে এক একটি বৃত্ত।
সুধীর দত্ত লিখেছেন, ‘‘প্রতিটি রাগের যেমন একটি রূপাবয়ব আছে, কবিতাও কবির কাছে তেমনি রূপবান এক ভাববস্তু। প্রতি মুহূর্তের বেঁচে থাকার বিস্ময়, তার আলো ও অন্ধকার। কবি ঈশ্বরের জগৎকে ভেঙে পুনর্নির্মাণ করেন।’’ এর পর একটি অবিশ্বাস্য সুন্দর অভিজ্ঞান: ‘‘ঈশ্বরীয় বিশ্বের ভেঙে পড়া টুকরো ও তার তেজস্ক্রিয় ধূলি। তার মাথার উপর নুয়ে পড়ে আকাশের ছাদ, গ্যালাক্সি আর নীহারিকাপুঞ্জ...’’।
তাঁর ভাষাপথের অনুসন্ধানকে বোঝার জন্য সুধীর দত্তের দীর্ঘ বাকসংবরণকে অনুধাবন করা প্রয়োজন (‘কারও কাছে আমি কোনো দাসখৎ লিখিনি’, ‘ভূর্জবন’, তাঁবু, মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ)। সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় তাঁর এই সংযম এবং আত্ম-খনন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ যেন নিজের ভেতরে অবগাহন করে এক অনন্ত অতীতকে ‘পুনর্জাত’ করার তপস্যা। দৈনন্দিনকে মহাজাগতিক নক্ষত্র-অস্থি’র মধ্যে জাগিয়ে তোলার তপস্যা।
ব্যাবেল টাওয়ারের চূড়া (১৯৮৭)— যে নামটির বাইবেলি ব্যঞ্জনা বহুমাত্রিক— থেকে শুরু করে তাঁর আটটি কবিতাগ্রন্থের বাঁকগুলি যেন এক প্রশস্ত নদীর জলধারার রাগমালার মতো আধ্যাত্মিক আত্মানুসন্ধানের কম্পমান রেখাচিত্র। ‘‘চারিদিকে এই আমার ব্রহ্মনির্বাণ। রোমকূপগুলি/ মুখগহ্বর। আহার করি বায়ু— পাতার মর্মরধ্বনি।/কুলুকুলু জল, এসো/ হবিষ্যান্ন হও; বৈশ্বানর অগ্নি/ জেগে আছেন প্রাণ ও অপানের সন্ধিস্থলে।/এক ব্রাহ্ম মুহূর্ত।’’ (‘ব্রহ্মনির্বাণ’, তাঁবু, মই ও শ্রেষ্ঠ কবিতাগুচ্ছ) রামকিংকরের ভাস্কর্য ও ব্রহ্মনির্বাণ মিশে যাচ্ছে কবিতার মন্দিরগাত্রে।
তাঁর রসুইঘর ও দক্ষিণ অগ্নি এবং ব্রহ্মাণ্ড দোয়াতদানি এই বিবর্তনের সাম্প্রতিকতম অক্ষরগুঁড়ো, যা ছড়িয়ে পড়ছে মহাপৃথিবীর রক্তকৃষ্ণ স্তব্ধতাকে ছুঁয়ে।
এই অসহিষ্ণু সময়ে এমন নিভৃত উচ্চারণ সহজ নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy