একসূত্রে: বিশ্বভারতীতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জওহরলাল নেহরু প্রমুখ।
রবীন্দ্র-চর্চা অথবা রবীন্দ্র-বীক্ষণের একটা প্রচলিত ধারা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সে ধারা একমাত্রিক। ভক্তিময় নিবেদনের আধার। অথবা অর্বাচীন প্রেক্ষিত। এর অপর দিকে রয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করে এক বৃহৎ অ্যাকাডেমিক চর্চার প্রতর্ক। তাঁর কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের আয়োজন। বিদ্বান পণ্ডিতদের অহরহ বিতণ্ডা, প্রাইমারি থেকে গবেষণা সন্দর্ভ অবধি পাঠ্যক্রমের অন্তর্গত চলাচল, আলোচনাসভা, বক্তৃতা। আর রয়েছে শান্তিনিকেতন। পৌষ মেলা, বসন্তোৎসব, ফি-বচ্ছরের বারোয়ারি রবীন্দ্রনাথ।
এই সব, আর এর বাইরেও আরও বিবিধ, বিচিত্র নির্মাণ অথবা বিনির্মাণের গতানুগতিক ক্লান্তি কিংবা আবিষ্ট বিস্ময়ের শেষেও খানিকটা রবীন্দ্রনাথ-চর্চা বাকি থেকে যায়। তেমনই এক রবীন্দ্রনাথের কথা বলেছেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সদ্য প্রকাশিত টেগোর’স ইউনিভার্সিটি: আ হিস্ট্রি অব বিশ্বভারতী ১৯২১-১৯৬১ সন্দর্ভে। যে রবীন্দ্রনাথের কথা খুব একটা বলা হয় না, আলোচনায় আরও অন্য বিষয়ের সঙ্গে সচরাচর মিলিয়ে দেওয়া হয় অজানতে অথবা অজ্ঞানে, সেই রবীন্দ্রনাথকে যত্ন করে পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন লেখক এই বইয়ে। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রনাথ, একটা প্রতিষ্ঠানের নির্মিতির দর্শন আর তার প্রতিষ্ঠাতার সত্তার সম্পর্ক এই বইয়ের উপজীব্য। যেমন বলছেন স্বাতী তাঁর লেখার শুরুতেই: “দিস হিস্ট্রি অব বিশ্বভারতী ইভোকস ইটস ফাউন্ডার, বাট দ্য রবীন্দ্রনাথ হিয়ার ইজ় ডিফারেন্ট ফ্রম দি ওয়ান হু, অ্যাজ় পোয়েট, মিস্টিকাল ফিলজ়ফার, অ্যান্ড আর্টিস্ট লিভস ইন দ্য পপুলার ইম্যাজিনেশন।” এই বিকল্প রবীন্দ্রনাথ, অন্য রবীন্দ্রনাথ এক জন কৌশলী চিন্তাবিদ, যিনি প্রাচীন ভাষা, নৃতত্ত্ব, বৌদ্ধ দর্শন, কৃষি অর্থনীতির জটিল আঙ্গিক ছেনে জিজ্ঞাসা অথবা বীক্ষণের একটা বৌদ্ধিক কাঠামো নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন বিশ্বভারতী নামের প্রতিষ্ঠানে।
এই মর্মে ‘রাবীন্দ্রিক’ অভিধাকে ফিরে দেখেছেন স্বাতী আর এক বার। এই অভিধার অর্থ কোনও এক রকম বাঙালিয়ানার অচলায়তন নয়, প্রকৃতির মাঝে, বৃক্ষচ্ছায়ায় ছড়িয়ে থাকা মুক্ত ক্লাসঘরের বহু-ব্যবহৃত সেই ছবি নয়, গ্রামীণ পরিবেশে প্রায় ইউটোপিয়ার নির্ণীতিবিদ্ধ প্রাচ্যের এক শিক্ষাশ্রম মাত্র নয়— বরং রবীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতি বিষয়ে চিন্তার সামগ্রিক প্রকাশ, বাকি বিশ্বের নিরিখে শিক্ষার দর্শন বিষয়ে দীর্ঘ, আয়াসলব্ধ বিশ্লেষণের জ্ঞানতাত্ত্বিক আয়োজন। দুটো জরুরি কথা এই বইয়ে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক। প্রথম, বিশ্বভারতী রবীন্দ্রনাথের স্বতন্ত্র প্রকল্প, যে প্রকল্পের মূল ভাবনায় প্রোথিত রয়েছে এক দিকে ‘বিশ্ব’ আর অপর দিকে ‘ভারত’-এর ধারণা। সমগ্র বিশ্বের ধারণার নীড় বা আধার হয়ে উঠবে বিশ্বভারতী, আর প্রতিহত করবে উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ, অথবা জাতীয়তাবাদের বিবিধ ক্ষমতাকেন্দ্রিক ধারণাকে। আচার্য, অধ্যাপক, ছাত্র আর বান্ধবের নিবিড় চলাচলে এক স্বতন্ত্র শিক্ষাসমাজের পরিচায়ক হয়ে উঠবে এই বিশ্ববিদ্যালয়। লেখক আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন যে, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা প্রকল্পের এই ধারণা শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয়ের হিন্দুবাদী অথবা জাতিভেদবাদী ব্রহ্মচর্যাশ্রমের ধারণার থেকে স্পষ্টত পৃথক, সর্বাঙ্গীণ ভাবে আন্তর্জাতিক একটা শিক্ষা প্রকল্প। অতএব, শান্তিনিকেতন আর তার আশ্রম জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে থাকলেও বিশ্বভারতী স্বতন্ত্র, স্বরাট, স্বকীয়। দ্বিতীয়, বিশ্বভারতীর শিক্ষা সমাজের ধারণার আলোচনায়, অথবা রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক শিক্ষা দর্শনের আলোচনায় অনেক ক্ষেত্রে শ্রীনিকেতনের প্রসঙ্গ গৌণ হয়ে যায়। স্বাতী তাঁর পাঠককে ধরিয়ে দিচ্ছেন যে, বিশ্বভারতীর বিষয় আলোকপাত করতে গেলে শ্রীনিকেতন প্রসঙ্গ সমারূঢ়। সুরুলের গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্প যে আদতে রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সম্পৃক্ত এবং আদ্যন্ত বিশ্বভারতীর ধারণার সঙ্গে তার নিবিড় সাযুজ্য, এ কথা ভুললে চলে না। পাঠের প্রক্রিয়া বা জ্ঞান অন্বেষণের আয়াস প্রকৃত অর্থেই হাতে-কলমে কাজের অন্তরঙ্গ দোসর, এই সামঞ্জস্যের দর্শনের প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর প্রকল্প। মননের চর্চায় আর কৃষিকাজেঅন্তর নেই।
অভিলেখ্যাগার, সংগ্রহশালা, গ্রন্থাগার, পরিশ্রম করে খুঁজে নেওয়া অগ্রন্থিত রচনা, ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার— বিভিন্ন গবেষণার সম্মিলিত ফসল লেখকের এই সন্দর্ভ। প্রাপ্য আর দুষ্প্রাপ্য বহু ছবি রয়েছে বইয়ে। আটটি সুনির্দিষ্ট অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বই। ১৯২১ থেকে ১৯৬১, বিশ্বভারতীর হয়ে ওঠার সাংস্কৃতিক দলিল হিসাবে গুরুত্বের দাবিদার এই কাজ। খুঁটিনাটি তথ্য, চিঠিপত্রের আদানপ্রদানে অন্তর্লীন তর্ক আর ধারণার চলমানতা, সরকারি নথির সঙ্গে মিলিয়ে পড়া কোনও প্রকল্পের পরিণতি— সব মিলিয়ে সিরিয়াস পাঠক চিন্তার রসদ পাবেন সুনিশ্চিত। স্বাতীর গদ্য সাবলীল আর সহজ, আম পাঠক পাবেন পড়ে চলার আনন্দ। একটা সূক্ষ্ম রাজনৈতিক মতামতের আভাসও লিখে চলার ফাঁকে ফাঁকে দিয়ে রেখেছেন লেখক, সমগ্র দেশের তথা বিশ্বভারতীর ক্রমাগত বদলে যাওয়া চরিত্রের ভিতরেই ধরাথাকে দক্ষিণপন্থার আগ্রাসন, রবীন্দ্রনাথের প্রকল্পের ধীর অথচ নিশ্চিত বিপর্যয়ের খেদ।
লেখকের এই কাজ পাঠককে এই বিষয়ে আগের কিছু কাজের কথাও মনে করিয়ে দেবে নিশ্চিত: বিশ্বভারতী নিয়ে চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজ়-এর বই, অথবা শান্তিনিকেতন বিষয়ে উইলিয়াম পিয়ারসনের কাজ, কিংবা শ্রীনিকেতন প্রসঙ্গে উমা দাশগুপ্তের বইয়ের কথা। তবু এই কাজ স্বতন্ত্র, বিশ্বভারতীর এই প্রকল্পকে স্বাতী একটা এপিস্টেমোলজির প্রতিষ্ঠা হিসাবে ধরতে চেয়েছেন মনে হয়। বইয়ের শিরোনামে বলা আছে যে, লেখক এখানে ‘ইতিহাস’ লিখছেন। অবশ্য এ বিষয়ে শেষে খানিক গোল থেকে যায়। বিষয় হিসাবে, ডিসিপ্লিন হিসাবে ইতিহাসের কিছু নিজস্ব দাবি থাকে। তথ্য, মতামত, তত্ত্ব— যত্ন আর পরিশ্রম দিয়ে সাজিয়ে তুললেও আরও কিছু কাজ বাকি থেকে যায়। হালের ইতিহাসচর্চার কাঠামোয় এই কাজকে বসালে এর গুরুত্ব আরও খানিক বৃদ্ধি পেত বলে বোধ হয়। প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস কী ভাবে লেখা হবে, তার তাত্ত্বিক বা দার্শনিক ভিত্তি কী হতে পারে, এই বিতর্কের নিরিখে নিজের মতামতকে প্রতিষ্ঠা করলে হয়তো ভাল হত। তাঁর লেখায় স্বাতী বহু বার ‘ইউনিভার্সাল’ ‘গ্লোবাল’, ‘ওয়ার্ল্ড’, ‘বিশ্ব’, ‘সিঙ্গুলার’ শব্দগুলি ব্যবহার করেছেন। অথচ এদের মধ্যে তাত্ত্বিক পার্থক্য যে বিস্তর, অনেক ক্ষেত্রেই একে অপরের শত্রুপক্ষ হিসেবে গণ্য হতে পারে, সে আলোচনা এড়িয়ে গিয়েছেন সম্পূর্ণ। বৌদ্ধিক ইতিহাস চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা নিয়ে আজ তামাম দুনিয়ার ইতিহাসবিদরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন, সেই দিকটা তাই রয়ে গিয়েছে আলোচনার বাইরে। এপিস্টেমোলজির ধারণার ব্যাপ্ত চর্চা আর তর্কের খুঁটিনাটি দার্শনিক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর এই কাজকে যদি স্বাতী নিয়ে ফেলতেন, তা হলে আরও জটিল এবং বহুমুখী আলোচনার সম্ভাবনা ছিল বলে মনে হয়। আলোচনার এই ছকটা একেবারেই অধরা থেকে গেল, এ কথা পড়তে গিয়ে অনেক বার মনে হয়েছে। শেষ বিচারে তবুও সন্দেহ নেই যে একটা গুরুত্বপূর্ণ আর সংগ্রহ করার মতো বই লেখা হল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy