ত্রিশ বছর আগে ইতিহাসবিদ রজত কান্ত রায় তাঁর সম্পাদিত এক সঙ্কলনের ভূমিকাপ্রবন্ধে জোরালো একটি দাবি করেছিলেন। বলেছিলেন, ঔপনিবেশিক আধুনিকতার রূপটি বাংলায় যে ভাবে আত্মপ্রকাশ করল, কেবল ভারতে নয়— বিশ্ব-ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে একটা নির্ণায়ক স্থান দেওয়া জরুরি। জাপানের মেইজি বিপ্লব এবং তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের বিপ্লবের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলার এই ঘটনাকে বলা উচিত “ইউনিভার্সাল ইভেন্টস মার্কিং দ্য সুইপিং প্রগ্রেস অব দ্য স্পিরিট অব রিকনস্ট্রাকশন”। কেননা, “ইন দ্য নন-ইউরোপিয়ান ওয়ার্ল্ড, ইট ওয়াজ় ইন বেঙ্গল দ্যাট দ্য ফার্স্ট সিগনিফিক্যান্ট ইন্টেলেকচুয়াল এনকাউন্টার... টুক প্লেস বিটুইন দি ইস্ট অ্যান্ড দি ওয়েস্ট।” বাংলার এই ‘স্পিরিট অব রিকনস্ট্রাকশন’-এর পূর্ণতর আলোচনা পড়লাম আমরা তাঁদেরই ছাত্রীর গবেষণায়। বইটি হাতে নিয়ে এই সারস্বত পরম্পরাটিকে লক্ষ করতে ইচ্ছে করে, কেননা এর মধ্যেও যেন একটা ‘ইন্টেলেকচুয়াল এনকাউন্টার’ লুকিয়ে আছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া ইতিহাসের পদ্ধতিগত ঘরানার আদানপ্রদান আছে।
বিশ শতকের গোড়ায় বাংলার সমাজে পত্রপত্রিকার ভূমিকা নিয়ে সমর্পিতার এই গবেষণা। ‘লিটারারি কালচার’ কথাটির উপযুক্ত বাংলা প্রতিশব্দ সুলভ নয়, ‘সাহিত্যের সংস্কৃতি’ শব্দবন্ধ মোটেই স্বস্তিকর নয়। আধুনিক ধ্যানধারণার চাপে যখন দেশীয় সমাজে নতুন করে ব্যক্তি ও সমাজের ‘বোধ’ তৈরি হচ্ছে, এবং ব্যক্তি ও সমাজের ‘সম্পর্ক’ নতুন করে জন্ম নিচ্ছে— সেই সময়ে বঙ্গদেশে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা হয়ে উঠছে এক নতুন মানস-সংস্কৃতির বাহন। লক্ষ করি, গোড়াতেই সমর্পিতা ‘ব্যক্তিমানব’-এর ধারণাটিকে নিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিমানবের পরিবর্তনশীল ধারণাই তো সে দিন তৈরি করছিল ‘জাতীয় জীবন’, যার অস্তিত্ব আগে জানা-ই ছিল না এ দেশে।
পিরিয়ডিক্যালস, রিডারস অ্যান্ড দ্য মেকিং অব আ মডার্ন লিটারারি কালচার: বেঙ্গল অ্যাট দ্য টার্ন অব দ্য টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি
সমর্পিতা মিত্র
১৮৯৫.০০
মনোহর
জাতীয়তাবাদের হাজারো আলোচনা-গবেষণার মধ্যে উপনিবেশিত সমাজে নতুন করে ‘ব্যক্তি’ নির্মাণের পদ্ধতিটি যে কতখানি গুরুত্বময় এবং ব্যঞ্জনাময়, দীর্ঘ সময় ধরে তা উপেক্ষিত থেকেছে বাংলার ইতিহাসে। এই উপেক্ষার ফলে ইতিহাস-আলোচনায় ‘জাতীয়তাবাদ’ অনেক দিন একশৈলিক বা হোমোজেনাইজ়ড ধারণা হয়ে থেকেছে, তাকে মনে করা হয়েছে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া একরৈখিক মতাদর্শ কেবল, যাকে একটিমাত্র মডেল-এর আকারে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সমর্পিতার গবেষণা নতুন ধারার ইতিহাসের নিদর্শন, যে ধারা বুঝিয়ে দেয় কত বিবিধ স্তরে নির্মিত হচ্ছিল বিশ শতকের বাংলার ব্যক্তিসত্তা ও সমাজসত্তা, কত রকম মতবিনিময়ের পথ দিয়ে এগোচ্ছিল বাংলা তথা ভারতের জাতীয়তাবাদী চিন্তা।
আর ঠিক এই কারণেই, ‘পত্রপত্রিকার ইতিহাস’ বলতে সাধারণত যে ‘আর্কাইভাল’ সংগ্রহভিত্তিক আখ্যান এত দিন বুঝে আসা হয়েছে— তার থেকে এই বই অনেকখানি আলাদা। ‘পত্রিকার ইতিহাস’ এখানে আসলে একটা গোটা চেতনা-জগতের ইতিহাস হয়ে উঠেছে— পশ্চিমি ধ্যানধারণা এবং লিটারারি কালচার-এর পশ্চিমি ‘প্র্যাকটিস’ বা ধারাগুলি কী ভাবে বাঙালি ভাবুক-লেখকদের হাতে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পন্থা হয়ে উঠছে, তার কাহিনি বুনেছে। এ এক ‘পাবলিক স্ফিয়ার’ বা গণপরিসর তৈরির গল্প, যা একান্ত ভাবে ‘আধুনিক’, কিন্তু ঔপনিবেশিক বাস্তবের কারণে ‘প্রতিস্পর্ধী আধুনিক’— এবং অবধারিত ভাবে ‘রাজনৈতিক’, যদি বা তা সচেতন ভাবে রাজনীতির কথা না-ও বলতে চায়।
বইটির ছ’টি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বঙ্গদর্শন-পরবর্তী মাসিক পত্রিকার নতুন ধারা, প্রবাসী ও অন্যান্য পত্রিকার মাধ্যমে একটি সামাজিক পরিসর তৈরি, বাঙালি সমাজে বস্তুতত্ত্ব, সৌন্দর্যতত্ত্ব ও শ্লীলতাবোধের সীমানা তৈরি, বাঙালি মুসলমানের পত্রপত্রিকা, নারীসমাজে পত্রিকাবিশ্বের প্রভাব, এবং অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনকালে পত্রপত্রিকায় রাজনীতি চর্চা। পড়তে গিয়ে আরও এক বার চেনা সমাজের ছবি নতুন করে স্তরে স্তরে খুলতে থাকে। কত তর্কই যে সে কালের পত্রিকাপরিসরে চলছিল, এমনকি রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর তর্কও, তা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্র-উপন্যাসও রাজনীতির একটা আলাদা দর্শন তৈরি করছিল তখন মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে হতে— সে কথা স্মরণ করে তৎকালীন সমাজমানসের চলমানতা বুঝতে পারি আমরা। বাঙালি কেরানিজগৎ একটা মানসিক মুক্তির দিশা পেয়েছিল এই পরিসরেই। ‘শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত’ বলে যে একটা সামাজিকসত্তা তৈরি হল, এই পরিসরটি ছাড়া হয়তো তা সম্ভব হত না। আর হ্যাঁ, অভ্রান্ত ভাবে, এই পরিসরেই বাঙালি মধ্যবিত্ত ও ভদ্রলোক সমাজের সীমারেখাটিও নির্ধারিত হয়েছিল— ‘কনস্ট্রাকশন’-এর পাশেই যেহেতু ছিল ‘এক্সক্লুশন’। জাতি-শ্রেণি-গোষ্ঠী-ধর্ম সবের ক্ষেত্রেই এই সীমারেখা তৈরির কাজটি ছিল বিশেষ সক্রিয়।
সমৃদ্ধ আলোচনাটি পড়তে পড়তে দু’টি প্রশ্ন মনে আসে। প্রথমত, গবেষকের বক্তব্য, পত্রপত্রিকার পরিসরে এই নতুন ‘জাতীয় জীবন’-এর নির্মাণে একটা আইডিয়ালিজ়ম বা আদর্শবাদিতার ভূমিকা ছিল জোরদার, যার অনেকটাই রাবীন্দ্রিক সূত্র দিয়ে গাঁথা। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই আদর্শবাদিতাকে কি একটামাত্র প্যারাডাইম-এ ফেলেই বুঝতে পারি আমরা, না কি তার মধ্যেও দেখা দরকার বিবিধ প্যারাডাইম-এর সংঘর্ষ— নিহিত হলেও অবধারিত? অর্থাৎ, যেমন এই পরিসরের একাংশ— নেতৃস্থানীয় অংশটিই— ছিল বিশেষ রকমের ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীমানস-অধ্যুষিত, ওই পরিসরের অন্য প্রান্ত থেকেই কি বেরিয়ে আসছিল না আরও নানা প্রতিরোধ, প্রতিস্পর্ধা, বিরোধ, দ্বন্দ্ব? বাঙালি (ভারতীয়?) সমাজের বিভেদ ও বিভিন্নতা দুই-ই আসলে পত্রপত্রিকার মধ্যে প্রবল ভাবে ফুটে উঠছিল উনিশশো বিশ ও ত্রিশের দশকে, এবং পরবর্তী কালে। সেই দ্বন্দ্বময় বাস্তবটি নিয়ে আরও জানতে ইচ্ছে করে। দ্বিতীয় প্রশ্নটি এরই সঙ্গে যুক্ত। আলোচনাপরিধির সময়কালটি স্পষ্টত উল্লিখিত নয়, যদিও বিভিন্ন অধ্যায়ে তার নিশানা রয়েছে। কিন্তু পরিধির সীমাটি ঠিক কোন সময়ে টানা হল, এবং কেন, এ নিয়ে একটু সরাসরি আলোকপাত থাকলে ভাল হত। কেননা, ঠিক এর পরবর্তী দশকগুলিই কি দেখিয়ে দেয় না, কী ভাবে বাংলার এই ‘লিটারারি কালচার’ নিজেই হয়ে উঠল একটা রণক্ষেত্র— সত্তাপরিচয় আর তার সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র? এই বই যেন সেই মধ্য-বিশ শতকীয় ঐতিহাসিক সমাজমন্থনকে আবার নতুন দৃষ্টিতে দেখার জন্য আমাদের প্রস্তুত করে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy