দৃপ্তঃ সিএএ-এনআরসি’র প্রতিবাদে মুসলিম মেয়েরা। কলকাতা, ২০২০।
স্বদেশ স্বজন সমকাল
আবদুস সামাদ গায়েন
৩৫০.০০
রেডিয়্যান্স
কিছু কিছু প্রবন্ধের বই পড়তে গিয়ে একটা অত্যন্ত মন্দ ধরনের আক্ষেপ হয়, যে আক্ষেপ বোধ করাটাও দুর্ভাগ্যের পরিচায়ক। আক্ষেপটা হল, এ বই কেন ইংরেজিতে লেখা হল না। ইংরেজি বই আর বাংলা বইয়ের সেই ‘ঔপনিবেশিক’ ব্যবধানটা আমরা এই উত্তর-উপনিবেশ কালেও বহন করে চলি কি না— তাই দুর্ভাগ্য যে, কেবল বাংলা বা দেশীয় ভাষায় লেখা বলে অনেক বই সারস্বত সমাজে তার প্রাপ্য গুরুত্ব পায় না। আলোচ্য বইটি তেমন এক আক্ষেপ তৈরি করতে পারে।
তবে, বাংলায় লেখা বইয়ের আসল, এবং বৃহত্তর, গুরুত্বই তো এখানে যে, দ্বিভাষিক পাঠকের সঙ্গে বাংলা ভাষাভাষী অনেক মানুষ যাঁরা ইংরেজি বই কম পড়েন কিংবা পড়েন না, তাঁরা তা পড়বেন। সারস্বত সমাজ ইংরেজিনবিশ হয় হোক, কিন্তু বাংলা সমাজে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকেরই তো সবচেয়ে বড় গুরুত্ব, তাঁদেরই জন্য, তাঁদেরই লক্ষ্য এবং উপলক্ষ করে যে সব ভাবনাচিন্তা, তাঁদের কাছেই পৌঁছনো উচিত। প্রশ্ন হল, শেষ অবধি তা পৌঁছচ্ছে তো?
এত কথার অবতারণা কেন, তা একটি উদ্ধৃতির সাহায্যে বলি। ভারতের মুসলমান সমাজ নিয়ে এই বইয়ের একাধিক প্রবন্ধের একটিতে পড়ি: “দেশের অধিকাংশ মানুষ জানে যে মুসলমানের বহুবিবাহ বা যথেচ্ছ তালাক বা জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত অধিকাংশ প্রচারের বাস্তব ভিত্তি নেই। তাহলে ভারতীয় মুসলমান সমাজ সত্যের মুখোমুখি হতে পিছপা কেন? নিজগৃহে মা-বোনেদের দুর্দশায় অমানবিক ভোগান্তিতে ইসলামের মর্যাদা কি বাড়ে? শত শত শাহবানুরা যদি বিপন্ন হয়, ... সে কার লজ্জা? সকলের জন্য এক ও অভিন্ন আইন মেনে নিলে অথবা তেরশত বছর আগের শরিয়ত আইনকে যুগোপযোগী করে তুললে যদি ইসলাম বিপন্ন হয়, তা হলে এ দেশে ফৌজদারি ক্ষেত্রে চুরি জাকাতি খুন রাহাজানি জনিত অপরাধের ক্ষেত্রে এত দিন অনৈস্লামিক সাধারণ আধুনিক আইন মেনে নেওয়া হচ্ছে কি করে? তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, লেবাননের মুসলমানরা কি খাঁটি সাচ্চা মুসলমান নয়? এমনকি ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানেও তো শরিয়ত আইনের বহু সংস্কার হয়েছে। বস্তুত মুসলিম তোষণের হুজুগ তুলে যে সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী মহল ভারতের সমাজ ও রাজনীতিতে মুসলমানদের এতখানি কোণঠাসা করে ফেলেছে তাদের হাতের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার জন্যই তো সাধারণ মুসলমানের উচিত এ ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া।”
দীর্ঘ উদ্ধৃতি। কিন্তু মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা ব্যতিক্রমী ও জরুরি এই উচ্চারণ বাংলায় কেন, ইংরেজিতে লেখা ভারতীয় মুসলমানদের লেখাপত্রের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। লেখকের সত্তাপরিচয়কে তুলে আনা এখন উত্তর-আধুনিক কালে আর অপরিচিত প্রথা নয়। ‘কে’ বলছেন, ‘কোন অবস্থান’ থেকে বলছেন, তা ‘কী’ বলছেন-এর মতোই গুরুতর। ভারতীয় সেকুলারিজ়ম নিয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধেই উপযুক্ত সমালোচনা সন্নিবিষ্ট। কিন্তু আসল জরুরি কথা হল, কেবল ভারতের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যর্থতা নয়, ভারতের মুসলমানরা নিজেরা কতটা এই ব্যর্থতার শরিক, সে কথা যে ভাবে সামাদ বলেছেন, তার তুলনা মেলা সহজ নয়। স্বাধীনতার পর সংখ্যালঘু তোষণের ভুল রাস্তার কথার পাশেই আছে এই উচ্চারণ যে— দেশভাগের মতো ঘটনার পর ভারতীয় মুসলমানদেরই উচিত ছিল ‘ঘুরে দাঁড়ানো’, ‘বাস্তববাদিতা’ দেখানো, ‘পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের পরিবর্তন করে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছা’ প্রকাশের। মোটেই হয়নি সে সব: এবং সেখানেই এক বিপুল ব্যর্থতা। প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে লেখা এই প্রবন্ধ: গুজরাত মুসলিমনিধনের আলোচনা তখনও দেশের আনাচেকানাচে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিষয়ে ‘সমালোচনা’ তখন অতিস্বল্প, সংখ্যালঘুদের মধ্যে প্রায় অনুপস্থিত বলা চলে।
এক নির্মোহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিই সামাদের লেখাকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। উন্নয়ন, রাষ্ট্র ও গণতন্ত্রের মধ্যে যে ‘খেলা’য় সমানেই শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষের বাস্তব, এক-একটি প্রবন্ধ তার এক-এক দিকে আলো ফেলে। সিভিল সোসাইটি বিষয়ে রয়েছে একাধিক লেখা: পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফলে অতিরিক্ত প্রতিযোগিতা ও সুযোগসন্ধান, সত্তাপরিচিতির রাজনীতিতে দুর্নীতি ও স্বার্থপোষণ— এ সব কথা পণ্ডিতরা অনেক বলেছেন। সামাদ সহজবোধ্য ভাবে সেগুলি পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের পরিসরে ব্যাখ্যা করেছেন।
গৌরী আইয়ুব ও ‘খেলাঘর’ সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান নিয়ে লেখাটি এক বিশেষ প্রাপ্তি। দশক থেকে দশকান্তরে বাঙালি সমাজের উদারভাবনার পরিবর্তনের গতিরেখাটি যাঁরা চিনতে চান, তাঁদের কাছে এ লেখা অবশ্যপাঠ্য। শেষে একটি কথা। কোনও লেখাই বইয়ের সমাজভাবনার মূল সুর থেকে বিচ্যুত নয়, তবুও বইগ্রন্থনায় আরও একটু ফোকাস থাকলে ভাল হত। জরুরি বই বলেই ফোকাসের প্রসঙ্গটিও জরুরি হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy