ফোক-আর্কাইভ শিরোনামে ব্রিটিশ পপুলার আর্টের একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছেন দুই ব্রিটিশ শিল্পী অ্যালান কানে ও জেরেমি ডেলার।
ফোক-আর্ট বলতে আমরা সাধারণত বুঝি গ্রামীণ শিল্পীদের আঁকা ছবি বা অন্য কোনও শিল্প। বাংলায় একে বলা হয় লোককলা বা লৌকিক শিল্প। গ্রামীণ শিল্পীদের সে অর্থে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা থাকে না। পারিবারিক উত্তরাধিকার সূত্রে বংশ-পরম্পরায় এই শিল্পীরা শেখেন এবং একটি বিশেষ আঙ্গিকে কাজ করে যান। যার মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি যথেষ্টই থাকে। আমাদের দেশে অধিকাংশ লোককলাই কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ মানুষের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয়ে ঋদ্ধ। আদিবাসী বা উপজাতীয় মানুষের শিল্পসৃজন গ্রামীণ লোককলা থেকে অনেকটাই আলাদা। আদিমতা থেকে প্রবাহিত হয়ে এসে এখন তা অনেক পরিশীলিত হয়েছে। এর দৃঢ়তা অনেক বেশি।
আলোচ্য প্রদর্শনীতে ফোক-এর যে চরিত্র তার ধরন একেবারেই আলাদা। এগুলো আদৌ গ্রামীণ শিল্প নয়। সম্পূর্ণভাবেই নগর-ভিত্তিক মানুষের কাজ। কিন্তু উচ্চকোটির শিল্পে-প্রশিক্ষিত মানুষের শিল্পসৃষ্টি বলতে যা বোঝায়, এগুলি তা নয়। নামকরণে অবশ্য কোনও ভুল নেই। ইংরেজি ‘ফোক’ কথাটির অর্থ সাধারণ মানুষ। সেই হিসেবে এই কাজগুলিকে বলা হয়েছে ‘পাবলিক এক্সপ্রেশন অব মডার্ন ব্রিটেন।
আধুনিক নাগরিক শিল্পকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ধারায় আসে উচ্চকোটির প্রশিক্ষিত মানুষের পরিশীলিত শিল্প, রেনেসাঁস থেকে আধুনিকতা বিবর্তিত হয়ে পোস্ট-মডার্ন পেরিয়ে এখানে পৌঁছেছে, বহুল প্রচারিত সেই শিল্পকলা। দ্বিতীয় ধারাটিকে বলা যেতে পারে নাগরিক-লৌকিক বা আরবান-ফোক। নাগরিক সমাজের নিম্নস্তরে অ-প্রশিক্ষিত সাধারণ মানুষও নানা রকম সৃজনকাজ করে থাকেন। চিরস্থায়িত্বের কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগুলো করা হয় না। কিন্তু সামাজিকভাবে এগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে যেমন প্রচ্ছন্ন থাকে নির্দোষ কৌতুক, তেমনই ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ ও তীব্র সামাজিক প্রতিবাদ। পোস্ট-মডার্ন উদ্ভূত নানা অভিধার মধ্যে ‘প্যাসটিচ’ বলে একটি শব্দ আছে যার অর্থ ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কিছু নকল করে কোনও শিল্প গড়ে তোলা, যে নকলের মধ্যে কিছুটা বিদ্রুপ বিধৃত থাকে। প্রদর্শনীর কিছু কাজের মধ্যে সেই প্যাসটিচ-এর চরিত্র আছে। সমাজের নিম্নস্তরে ও গভীরে প্রচ্ছন্ন থাকে ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ সব কিছু মেনে না নেওয়ার যে প্রতিবাদী প্রবণতা,তারই প্রকাশ ঘটে এই তথাকথিত ‘আরবান-ফোক’-এর মধ্যে। যা চেনায় সমাজের অভ্যন্তরকে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রচনাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ।
বেশ বড় মাপের একটি প্যাঁচার মূর্তি তৈরি করা হয়েছে খড় দিয়ে। এর নাম ‘স্ট্র আওল রোডসাইড স্কাল্পচার’(২০০৫)। বেশ বিস্তীর্ণ একটি ফসলের প্রান্তরের এক প্রান্তে রয়েছে এই মূর্তিটি, উইল্টশায়ারে আমেসবারি-র কাছে। আমাদের দেশে কৃষকেরা শস্য মজুত রাখার জন্য যে গোলা তৈরি করেন, এই কাজটির স্থাপত্য অনেকটা সে-রকম। নির্মাণটিকে একটি প্যাঁচার আকৃতি দেওয়া হয়েছে। মুখের সম্মুখভাগে তার গোলাকার সাদা চোখদুটির মধ্যে কালো মণিটি জ্বলজ্বল করছে, যা থেকে পুরো মূর্তিটির এক রহস্যময় অভিব্যক্তি তৈরি হয়। এই একটি দৃষ্টান্তে বোঝা যায় ‘আরবান-ফোক’ ও ‘হাই-আর্ট’-এর মধ্যে অনেক সময়ই ব্যবধান কী করে কমে আসে।
‘স্কাল ক্র্যাশ হেলমেট’-ও একটি ভাস্কর্যধর্মী রচনা। কিন্তু বিদ্রুপাত্মক। অনিয়ন্ত্রিত মোটর-সাইকেল চালনার বিপদ সম্পর্কে সতর্কীকরণ রয়েছে। এটি ২০০০ সালে তৈরি করেছিলেন চার্লটনের স্টুয়ার্ট হাগস্। রেখায় আঁকা হয়েছে এক নগ্ন যুবতীর আবক্ষ প্রতিকৃতি। পাশে লেখা রয়েছে ‘ম্যানস রুইন বিউটি অ্যান্ড বিয়ার’। সূক্ষ্ম এক প্রতিবাদীচেতনা কাজ করেছে এই রচনার পিছনে। বুটজুতো পরা একটি পায়ে ট্রাউজারটি হাঁটু পর্যন্ত তোলা। পায়ের পাতা থেকে হাঁটুর মধ্যবর্তী অংশে নিপুণ স্বাভাবিকতায় আঁকা রয়েছে তিনটি পুরুষের মুখের ছবি। আমান্দা ওয়েট-এর আঁকা এই ট্রাউজারটির মধ্যে কৌতুকদীপ্ত এক ধরনের বিদ্রুপ রয়েছে। এ রকম বৈচিত্র্যময় অজস্র রচনার মধ্য দিয়ে লৌকিক-নাগরিক মননের রূপরেখা উদ্ভাসিত হয়েছে এই প্রদর্শনীতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy