টুডেজ পাস্টস/ আ মেমোয়ার। ভীষ্ম সাহনি, অনু: স্নেহল সিঙ্ঘভি। পেঙ্গুইন, ৪৯৯.০০
হিন্দিতে ২০০৪ সালে প্রকাশিত ভীষ্ম সাহনির আত্মজীবনী আজকে অতীত বইটির স্নেহল সিঙ্ঘভি কৃত ইংরেজি অনুবাদ টুডেজ পাস্টস নামে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি পড়ার সবচেয়ে বড় বাধা অনুবাদকের এক দীর্ঘ ভূমিকা। তিনি তাঁর এই ভূমিকায় দায়িত্ব নিয়েছেন অনেকগুলি। ভীষ্ম সাহনি কে ও তাঁর আত্মজীবনী কেন ‘বিশ শতকের সাংস্কৃতিক ও চিন্তনের ইতিহাসের সবচেয়ে জরুরি সব আখ্যান’, তিনি তাঁর মূল লেখাটিতে তাঁর নিজের জীবনের কী কী অতি প্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়েছেন, তাঁর স্বভাবের কারণেই তিনি নিজের কাজকর্ম সম্পর্কে কেন এত কম কথা বলেছেন— এই সব কথা অনুবাদক আমাদের জানিয়েছেন।
এটা বোধহয় অনুবাদকের সীমালঙ্ঘন। ক্ষতি যেটা হয়েছে— সেটা এই ইংরেজি অনুবাদের পাঠটি বদলে গিয়েছে। ভীষ্ম নিজের জীবনের কথা যে ভাবে বলতে চেয়েছেন বা তাঁর প্রায় নব্বই বছর বয়সে তিনি নিজের জীবনকে নিজে যে-আকারে দেখতে চেয়েছেন, আত্মজীবনী পড়ার সেই বিশেষ রকমের পাঠবিলাসের মজাটা মাঠে মারা গেল। সন্দেহ হয়— ইংরেজি বইয়ের অনুমিত বৃহৎ এক পাঠকসমাজের কাছে ভীষ্মের আত্মজীবনীটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে প্রকাশকেরই দরকার ছিল এমন এক ভূমিকার, যা মূল বইটির পরিপূরকতা করবে।
ভীষ্ম কিন্তু তাঁর জীবনের গল্প তাঁর মতো করেই লিখেছেন। আত্মজীবনী পড়ার একটা টান তো এইখানেই— একটি লোক তাঁর নিজের জীবনকে কী ভাবে দেখছেন, বা, কথাটা আচমকা ঠেকলেও, দেখবেন। আত্মজীবনী মানেই স্মৃতিকথা নয়, আত্মজীবনী কর্মকথাও হতে পারে। পৃথিবীর বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী লেখা হয়েছে জীবনের মাঝখানে, নিজেকে যাচাই করতে। লিও তলস্তয় ও ম্যাকসিম গোর্কি তাঁদের সাহিত্যজীবন শুরুই করেছিলেন— তাঁদের দীর্ঘ আত্মজীবনী লিখে। আবার পুরোপুরি সাহিত্যিক নন এমনও কেউ কেউ জনজীবনের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কের ছক বুঝতে অসামান্য আত্মকথা লিখেছেন— মহাত্মা গাঁধী ও জওহরলাল নেহরু। যে সময়ের মধ্যে কথক বেঁচে আছেন, সেই সময়টি তাঁর পক্ষে কেন বিশেষ হয়ে ওঠে— এটা অনুমান করাটা পাঠকের এক একান্ত সৃষ্টিসুখ। নীরদ সি চৌধুরীর আত্মজীবনীটি তো আমার বার বার পড়তে এমনই ভাল লাগে, তার একটি কারণ, এই মানুষটির দ্বিধাবিভক্ত মনের আঁচ খোঁজা— এক দিকে কিশোরগঞ্জ, অন্য দিকে ব্রিটিশ সংস্কৃতি। যাঁরা পদাধিকারবলে রাজনৈতিক নেতা, তাঁদের আত্মজীবনীর একটা লক্ষ্য থাকে— তাঁর সময়ের বিশেষ বিশেষ ঘটনায় তাঁর ভূমিকা। সে সব বই পড়ায় কোনও সুখ নেই— সে কিসিংগারেরই হোক বা নটবর সিংহের। যিনি লিখছেন, তিনি নিজেকে কী ভাবে দেখতে চাইছেন— সেটাই তো পাঠক ‘দেখতে’ চান। চিত্রশিল্পীদের ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট’-এর মতো। শিল্পীর আঁকা ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট’ কি দর্শক তাঁর ‘ফটোগ্রাফিক পোর্ট্রেট’ হিসেবে দেখেন? রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতি-তে একবারের জন্যও তাঁর সামাজিক কাজকর্মের উল্লেখ পর্যন্ত করেননি, আর তাঁর আঁকা ছবি ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট’-এ ভরে দিলেন।
ভীষ্ম তো আসলে আত্মসচেতন আধুনিক এক ভারতীয় কথাকার। নিজের একটা আকার তৈরি করতে করতে তাঁর আখ্যান গড়ে ওঠে ও সেই আকারের মধ্যে ইচ্ছাকৃত সব ঘোরপ্যাঁচও থাকে।
বারোটি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত এই কাহিনি অনেক দূর পর্যন্তই কালানুক্রমিক। রাওয়ালপিন্ডির শৈশব ও কৈশোর নিয়ে প্রথম অধ্যায়, সেই কালানুক্রমেই লাহৌরের কলেজে পড়াশুনো ও খেলাধুলোর কথা নিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায় এসে পড়ে। তৃতীয় অধ্যায়ে পিন্ডিতে ফিরে গিয়ে পারিবারিক ব্যবসায় লেগে পড়াও কালানুক্রমেই ঘটে বটে, তবে প্রথম আর তৃতীয় অধ্যায়ের পিন্ডি একেবারে আলাদা। প্রথম ও দ্বিতীয় অধ্যায়ের ধারাবাহিকতা এই অধ্যায়ে পাল্টে যায়। স্বাধীনতা দিবস দেখবে বলে দিল্লিতে একা এসে পাকিস্তানের দাঙ্গার ফলে উদ্বাস্তু হয়ে যায় একা-একা। পরিবারের কারও খবর কেউ পাচ্ছে না। লোকমুখে ভীষ্ম জানতে পারে— তার স্ত্রী-কন্যা শ্রীনগর থেকে প্লেনে দিল্লি এসেছে, কিন্তু তাদের দেখা হয়নি। উপজাতি-আক্রান্ত কাশ্মীরে সৈন্যবাহিনীর মালবাহী বিমানে তার স্ত্রী-কন্যা কোনও রকমে দিল্লি আসতে পেরেছিল। তার বাবা তখনও রাওয়ালপিন্ডিতে। শুধু এটুকু নিয়েই তো একটা উপন্যাস হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু ভীষ্ম তো আকারের বিভ্রাট ঘটাতে পারেন না। চতুর্থ অধ্যায়ে তাই তাঁর ভারতীয় গণনাট্যের সঙ্গে সম্পর্কের কথা— মুম্বইয়ে তাঁর দাদা বলরাজ সাহনির মাধ্যমে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ অধ্যায়ে চাকরির খোঁজে আম্বালা–দিল্লি ও কলেজ শিক্ষকদের ইউনিয়ন করার দোষে চাকরি খোয়ানো ও গণনাট্য করার কথা। ১৯৫৭-তে ভীষ্ম সপরিবার মস্কো চলে গেলেন অনুবাদের কাজে। এই সপ্তম অধ্যায়ে সোভিয়েতে যুগান্তর ঘটছিল— নিঃস্তালিনপ্রক্রিয়া, ক্রুশ্চেভ যুগ, স্পুতনিক, গাগারিন, তেরেশকোভা, দুনিয়ায় সোভিয়েতের প্রাধান্য অবিসংবাদী, ভারতের সঙ্গে সখ্য প্রতিদিনই বাড়ছে। এই সময়ই মাও জে দঙ সোভিয়েতে আসেন ও সোভিয়েতের আণবিক গবেষণার সাহায্য চান। সোভিয়েত সেই সাহায্য দিতে অসম্মত হয়। সোভিয়েতের সঙ্গে চিনের বিরোধ শুরু হয়। ভীষ্ম সেই ঘটনার সময় মস্কোতে।
এর পর বাকি পাঁচ অধ্যায় আর কালানুক্রমিক নয়। ১৯৬৩-তে দেশে ফেরার পর ভীষ্ম ‘নই কহানিয়া’র সম্পাদনা, গণনাট্য সংঘ, প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন, আফ্রো-এশিয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন, তাদের মুখপত্র ‘লোটাস’-এর সম্পাদনা— এমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। যে ভীষ্ম সাহনিকে ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্দোলনের একজন সৃষ্টিশীল নেতা বলে সকলে চেনে-জানে, তাঁর কথা এই পাঁচ অধ্যায় জুড়ে। এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে তাঁকে যেতে হয়েছে, লেখক ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে অনেক রকম দেখাসাক্ষাৎও ঘটেছে। তাঁর ভিয়েতনাম ও কাম্পুচিয়ার অভিজ্ঞতা, উত্তর কোরিয়ার মহানায়কের সঙ্গে সাক্ষাৎ— ভীষ্ম খুব বিস্তারিত করেননি, কিন্তু তাঁর বিবরণ, তাঁর আত্মজীবনীর আকারের সঙ্গতি রেখেই তিনি লিখেছেন।
একাদশ অধ্যায়ে প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজকর্মের কথা লিখেছেন, নিজেকে যত আড়ালে রাখা যায়, ততটাই রেখে।
এই অংশে, যাকে হয়তো বইটির দ্বিতীয় অংশই বলা যায়, নবম অধ্যায়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘তমস’ তিনি কী করে লিখলেন, সেই কথা বলেছেন। বিশেষ করে এই অধ্যায়টিই এটিকে এক বিরল গ্রন্থ করে তুলেছে— একটি মহৎ উপন্যাসের জন্মবৃত্তান্ত। যুক্তিহীন, জটিল, কুটিল, ঘূর্ণিপাক খাওয়া, দ্বন্দ্বমুখর এক প্রক্রিয়া। ভীষ্ম তো প্রায়ই মুম্বই যেতেন— বলরাজের কাছে। ভিয়ান্দিতে একটা দাঙ্গা হয়েছিল— কোন দাঙ্গা, ভীষ্মের মনে নেই। বলরাজ সাহনি, খাজা আহম্মদ আব্বাস ও আই এস জওহর যাচ্ছিলেন ভিয়ান্দিতে। গাড়িতে আরও এক জনের জায়গা ছিল। ভীষ্ম চড়ে বসলেন। ভিয়ান্দিতে গিয়ে সেই পরিত্যক্ত জায়গাটির জনশূন্যতা ও নৈঃশব্দ্যে ভীষ্ম আক্রান্ত হলেন। তিনি যেন অনেক মানুষের চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিলেন, অনেক পায়ের আওয়াজ তাঁর কানে আসছিল আর তাঁতবোনার ওই স্থানটিতে পোড়া তাঁতগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাঁতের আওয়াজ উঠছিল যেন। এর দু-চার দিন পর ভীষ্ম দিল্লিতে তাঁর রোজকার কাজে ফিরে এলেন। লিখেছেন— ‘ভিয়ান্দির কথা মনে ছিল না।’ ভীষ্ম সাধারণত সন্ধেবেলা লিখতেন। একদিন কোনও কারণ ছাড়াই সকালে লিখতে বসলেন। তিনি জানতেনই না কী লিখবেন। কিন্তু কাগজে কলম ছোঁয়াতেই তাঁর মনে ড্যাম-ভাঙা বন্যার বেগে রাওয়ালপিন্ডির দাঙ্গার দিনগুলো আর মানুষগুলো ফিরে এল। তিনি লিখতে শুরু করলেন। এই অধ্যায়টিতে ভীষ্ম এও বলেছেন— কোন ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিল, কোন ঘটনা তিনি তৈরি করেছেন। ভীষ্ম সাধারণত তত্ত্ব করেন না। দু’টি জায়গায় তিনি বলেছেন, ‘লেখকের কলম দিয়ে উপন্যাস লেখা হয় না, তার মাথা দিয়েও না, তার হৃদয়ের অনুভব দিয়ে লেখা হয়।’ কত বছর পর রাওয়ালপিন্ডির দাঙ্গা অনুভবে ফিরে এল ভিয়ান্দির দাঙ্গা থেকে। আর এক জায়গায় ভীষ্ম বলেছেন, ‘ধীরে ধীরে বাস্তব-মানুষজন একটা গল্পের মানুষজন হয়ে উঠতে থাকে।’
ভীষ্মের এই আত্মজীবনীর প্রধান আকার এক পারিবারিক সম্পর্কে। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে নিয়ে এক বিরাট পরিবার, আর সেই পরিবারের শিরদাঁড়া বলরাজ ও ভীষ্ম এই দুই ভাই।
ভীষ্ম আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা একসঙ্গে গিয়েছি, সভা-সমিতি করেছি। বিদেশেও গিয়েছি একই সঙ্গে, একই কাজে। কতই কথা হত ভীষ্মের সঙ্গে। একদিন তাঁকে বলেছিলাম— ‘‘তোমার নাম ‘বিসম’ কেন? অর্থহীন নাম।’’ ভীষ্ম তার সেই মুখভরা হাসি হেসে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে ভীষ্ম বলেই ডেকো। ওটাই আমার নাম।’ যোগ করেছিল, ‘একটা এপিক-ম্যান হতে তো ভালই লাগবে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy