Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১

প্রেমের স্পর্শে যেখানে মানবিক হয় হিংস্রতা

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত সমীর কুণ্ডু’র একক প্রদর্শনীটি দেখে এলেন মৃণাল ঘোষঅ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সমীর কুণ্ডু-র সপ্তম একক প্রদর্শনী। শিরোনাম: ‘বাঘ-আবেগ’। মানুষ, প্রকৃতি ও বাঘ— এই তিনের কল্পনাদীপ্ত সমন্বয় ঘটেছে নানা মাধ্যমে আঁকা তাঁর প্রায় ৩৭-টি ছবিতে।

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল সমীর কুণ্ডু-র সপ্তম একক প্রদর্শনী। শিরোনাম: ‘বাঘ-আবেগ’। মানুষ, প্রকৃতি ও বাঘ— এই তিনের কল্পনাদীপ্ত সমন্বয় ঘটেছে নানা মাধ্যমে আঁকা তাঁর প্রায় ৩৭-টি ছবিতে।

ছবিগুলি দেখতে দেখতে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঘ’ নামের সেই সুপরিচিত কবিতাটি মনে পড়ছিল। ‘মেঘলা দিনে দুপুরবেলা যেই পড়েছে মনে/ চিরকালীন ভালবাসার বাঘ বেরুলো বনে .../ আমি দেখতে পেলাম, কাছে গেলাম, মুখে বললাম: খা/ আঁখির আধার জড়িয়েছে বাঘ, নড়ে বসছে না।’ বাঘের যে একটি বিশেষ রূপ এই কবিতায় ফুটে ওঠে, সমীরের ছবির সঙ্গে তাঁর কিছু মিল আছে। আর তা থেকে কবিতা ও ছবির একটা অন্তঃসম্পর্ক ধরা পড়ে। কবিতাটির ভিতর যে প্রচ্ছন্ন এক ট্র্যাজিক চেতনা আছে, ছবিতেও অনেক সময়ই সে রকম একটা আভাস উঠে এসেছে। যদিও শিল্পী এই কবিতাটির কথা মনে না রেখেই তাঁর ছবিগুলো এঁকেছেন। এটা একটা দৃষ্টান্ত— কেমন করে কবিতা ও ছবির মধ্যে প্রায়ই অনির্দিষ্ট একটা সেতু তৈরি হয়ে যায়।

সমীর কুণ্ডু ১৯৮৮-তে ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজ থেকে চিত্রকলার স্নাতক শিক্ষা শেষ করেছেন। তার পর থেকে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। এত দিন তাঁর আঙ্গিকের প্রধান এক প্রবণতা ছিল, ঐতিহ্যগত ভারতীয় চিত্ররীতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। শিল্পের দেশগত আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নব্য-ভারতীয় ঘরানার অবদান আজও যে যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয় এবং আজও যে অনেক শিল্পী এই ধারাকে প্রসারিত করার চেষ্টা করছেন, সমীরের ছবি তারই ইঙ্গিত বহন করে।

আলোচ্য প্রদর্শনীতে সেই ভিত্তির উপরই শিল্পী রূপের নতুন উন্মেষের দিকে গেছেন। প্রদর্শনীটি সে দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ।

ফর্ম বা রূপকে তিনি যে ভাবে ভেঙেছেন, তাতে অভিব্যক্তিবাদী কল্পরূপ নানা ভাবে কাজ করেছে। ভাবনার দিক থেকে কখনও কখনও ভালবাসা সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছে। কখনও ভালবাসার সঙ্গে হিংস্রতা মিশেছে। আবার তা থেকে করুণ এক ট্র্যাজিকচেতনাও জেগে উঠেছে। জীবনেও অনেক সময়ই এ রকমই ঘটে থাকে। শিল্পী বাঘের প্রতীকে জীবনেরই এই অন্তঃস্রোতকে উদঘাটন করতে চেষ্টা করেছেন।

কোনও ছবিরই আলাদা কোনও শিরোনাম নেই। সবই ‘বাঘ-আবেগ’-এর অন্তর্গত। তেমনই একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক নগ্নিকা নারী দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে একটি বাঘ। সেও দু-পায়ে ভর করে দাঁড়ানো। ডান হাতে একটি ফুল সে বাড়িয়ে ধরেছে ওই মানবীর দিকে। তাদের মাথার উপরে একটি বাঘের চামড়া ছড়ানো রয়েছে। প্রেমের স্পর্শে সমস্ত হিংস্রতা যেন মানবিক হয়ে উঠেছে। আর একটি ছবিতে অল্প জ্যোৎস্নালোকিত রাতে বনের ভিতর একটি গাছ মানবীর রূপ ধারণ করেছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে একটি বাঘ হাসিমুখে তাকে অভিবাদন করছে। আকাশে রয়েছে এক টুকরো বাঁকা চাঁদ। দুটি ছবিতে কল্পরূপের ধরন দু’রকম। ঐতিহ্যগত আঙ্গিককেই শিল্পী দু’রকম কল্পরূপে বিশ্লেষিত করেছেন। কাগজের উপর করা জলরং-ভিত্তিক কিছু মিশ্রমাধ্যমের ছবিতে রূপের এই ভাঙন বা বিশ্লেষণের মধ্যে তিনি নতুন মাত্রা সঞ্চারিত করতে পেরেছেন। সে রকম একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে রাত্রিবেলা বনের ভিতর গাছের তলায় একটি বাঘ শুয়ে আছে। হাঁ-করা মুখে জিভ বের করে গাছের সঙ্গেই সে যেন সংলাপে মগ্ন। ছবিটিতে বর্ণের বিন্দু-মাত্রিক বিচ্ছুরণে বুনোটের যে বিশেষ ধরন তৈরি হয়েছে, ছবিটির সামগ্রিক ভাবনায় তা এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। এ ধরনের ছবিতেই শিল্পী তাঁর আঙ্গিকের স্বতন্ত্র অভিমুখ তৈরি করতে পেরেছেন, নব্য-ভারতীয় ঘরানার প্রসারণ হয়েও যা আধুনিকতাবাদী বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। রেখা-ভিত্তিক অনেক ছবিতেও শিল্পী অবয়বের সঙ্গে সামগ্রিক পরিসরের এবং সেই পরিসরের ভিতর বিভিন্ন জ্যামিতিক ক্ষেত্রের সমন্বয় ও সংঘাতকে কল্পনাদীপ্ত ভাবে উপস্থাপিত করেছেন।

কিছু কিছু ড্রয়িং-এ অবশ্য রূপবিন্যাসের সংহতি আলুলায়িত হয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে সামগ্রিক উপস্থাপনায় আর একটু সম্পাদনার সুযোগ ছিল।

অন্য বিষয়গুলি:

Book review Human love
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy