Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ২: বাংলাদেশের বই

দেশভাগ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণী গবেষণা

পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগ নিয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। তুলনায় বাংলাদেশে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা, গবেষণা ও চর্চা খুবই কম। সে কি কেবল এ জন্য যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পূর্ববঙ্গে আগত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল কম এবং পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হিন্দুদের সংখ্যা ছিল বহু, বহুগুণ।

দেশবিভাগ: ফিরে দেখা, আহমদ রফিক। অনিন্দ্য প্রকাশ, ৭৫০.০০

দেশবিভাগ: ফিরে দেখা, আহমদ রফিক। অনিন্দ্য প্রকাশ, ৭৫০.০০

আবুল হাসনাত
শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশভাগ নিয়ে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই প্রকাশিত হয়েছে। তুলনায় বাংলাদেশে এই নিয়ে জিজ্ঞাসা, গবেষণা ও চর্চা খুবই কম। সে কি কেবল এ জন্য যে, ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পূর্ববঙ্গে আগত শরণার্থীর সংখ্যা ছিল কম এবং পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হিন্দুদের সংখ্যা ছিল বহু, বহুগুণ। ভারত থেকে আগতরা দ্রুত সরকারি-বেসরকারি আনুকূল্য অর্জন করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হন। বাংলাদেশে আগত কয়েকজনের স্মৃতিকথায় এবং কয়েকটি গল্প-উপন্যাসে কেবল এই নিয়ে জীবনমথিত কান্না ও বিষাদমগ্ন পরিবেশের বর্ণনা পাই। কিন্তু যে বিপর্যয় ভারতীয় সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে লন্ডভন্ড করে দিল, তার যথার্থ ও বহুমাত্রিক রূপ নিয়ে আজও বাংলাদেশে কোনও আকরগ্রন্থ প্রকাশ হল না।

‘ভাষাসৈনিক’ আহমদ রফিক একটি বই লিখেছেন— দেশবিভাগ: ফিরে দেখা। তিনি দেখিয়েছেন, দেশভাগ সম্প্রদায়গত বা ধর্মের ভিত্তিতে যে-বিভাজন টেনেছিল, তা স্বাধীনতা ও মানবিক বিভাজনের ইতিহাসেও ক্ষত রেখে গেছে। তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে তিনি বলতে চেয়েছেন, তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কত ভাবেই না ব্রিটিশদের ক্রীড়নক হয়েছেন। লেখক দেশবিভাগ কী ভাবে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল এবং হিন্দু-মুসলিম ও কংগ্রেস-লিগ নেতৃত্ব কোন পরিপ্রেক্ষিত, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে অবলম্বন করে ব্রিটিশ ফর্মুলা মেনে নিয়েছিলেন, তা আলোচনা করেছেন। মুসলিম লিগ মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পাকিস্তান দাবির যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য সাম্প্রদায়িক বিভাজনে কত ভাবে অনমনীয় হয়ে উঠেছিল। এই বিশ্লেষণ খুবই মনোগ্রাহী ও বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে কেমন করে বিভাজনের দিকে দেশকে নিয়ে গেলেন, আছে সে কথাও। চক্রান্ত যেমন ছিল লিগ ও কংগ্রেসের অভ্যন্তরে, তেমনই ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বেও উঠতে পারেননি অনেকে। এই গ্রন্থে গাঁধী, নেহরু, পটেল, জিন্না, সুভাষ, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দি-সহ অনেকের কথা আছে। জাতীয় নেতৃবৃন্দের মনোভঙ্গি, আদর্শগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথাও আছে। দেশভাগে কোটি কোটি মানুষ যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন, লেখক তার পটভূমি বিশ্লেষণে প্রাধান্য দিয়েছেন। বাংলাদেশে দেশভাগ নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী এত বড় আয়তনের গ্রন্থ আগে প্রকাশিত হয়নি।

১৯৫০-এর ২৪ এপ্রিল রাজশাহি কারাগারে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল ৭ জন রাজবন্দিকে। আহত হন ৩২ জন। সকলেই বেআইনি ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। দেশ বিভাজনের পরেই কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক আন্দোলনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন ও অধিকারবঞ্চিত কৃষকদের মধ্যে খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পাকিস্তান সরকার এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য পার্টির শত শত কর্মীকে গ্রেফতার ও বিনা বিচারে আটক করে। খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবর্ষণে নিহত সাত জন হলেন— কম্পরাম সিংহ, হানিফ শেখ, আনোয়ার হোসেন, সুধীন ধর, দিলওয়ার হোসেন, সুখেন্দু ভট্টাচার্য ও বিজন সেন। আহত সৈয়দ মনসুর হবিবুল্লাহর (পরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার) শরীরে আমৃত্যু দশটি ছররা গুলি ছিল। সম্প্রতি প্রকাশিত হল মতিউর রহমানের খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০। মতিউর রহমান বাংলাদেশের

খ্যাতনামা সাংবাদিক, দৈনিক প্রথম আলো-র সম্পাদক। বইটির ছ’টি অধ্যায়— খাপড়া ওয়ার্ডের সাত শহিদ, জেলের অবস্থা ও রাজবন্দীদের সংগ্রাম, তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির নীতি, রাজশাহী জেল এবং ২৪ এপ্রিল পূর্ব ঘটনাবলি, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড এবং খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের প্রভাব। পরিশিষ্টে আছে খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড-নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ ও কবিতা, আহত রাজবন্দিদের লেখা চিঠি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন, সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়, শহিদ এবং আহত রাজবন্দিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।

মতিউর রহমান শুধু এক নিরাসক্ত গবেষকের দৃষ্টিতেই এই বই লিখতে প্রবৃত্ত হননি। তাঁর বিবেচনায়— এই সময়ের ইতিহাস, রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিস্তারিত পর্যালোচনা ও শিক্ষা আমাদের জন্য জরুরি। তা শুধু অতীত জানার জন্য নয়, ভবিষ্যতের পথ সন্ধানের প্রয়োজনেও। ১৯৫০ সালে রণদিভের নেতৃত্বে পার্টিতে যে উগ্র বামপন্থার প্রকাশ ঘটে, পাকিস্তানি পুলিশ সেই সুযোগ নিয়ে কমিউনিস্ট নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে অনেক মূল্য দিতে হয়। জেল-জুলুম ও পুলিশি নির্যাতনেও শত শত পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়। অনেক নেতা ও কর্মী পশ্চিমবঙ্গে চলে যেতেও বাধ্য হন।

বইটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনার প্রায় পঁয়ষট্টি বছর পর এমন একটি বই হাতে এল— যাতে ঘটনার পূর্বাপর বিষয়, তাঁদের আত্মাহুতি এবং পঞ্চাশের দশকের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিষয় তথ্য সহ বিশ্লেষিত হয়েছে।

ঢাকার ‘কালি ও কলম’ এবং ‘শিল্প ও শিল্পী’ পত্রিকার সম্পাদক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy