ছবি: সুব্রত চৌধুরী
রুশিকা
লেখক: বিমল লামা
মূল্য: ৪০০.০০
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
পাঁচ-ছ’ বছর আগে বিমল লামা-র প্রথম উপন্যাস নুন চা নিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকাতেই অন্য একটা প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে মুগ্ধতা বিনিময় ঘটেছিল। প্রথম উপন্যাসটিই নজরকাড়া হলে লেখক ও পাঠকের বিপত্তি ঘটে। রুশিকা তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস বলে মলাটলিখনে উল্লিখিত হয়েছে। কথাটা সবটুকু ঠিক নয়। তাঁর ছোট উপন্যাস ও বড় গল্প ইতিমধ্যে নানা কাগজে পড়েছি। রুশিকা তাঁর দ্বিতীয় বই হয়তো।
নতুন একজন লেখকের এতটা কম লেখা ভাল কি মন্দ জানি না। না-লিখলে লেখকের রেওয়াজ হবে কী করে?
রুশিকা পড়ে আন্দাজ পাওয়া গেল— বিমল লামা তাঁর উপন্যাস-কল্পনা ও উপন্যাস-পরিকল্পনারই কঠিনতর রেওয়াজ করে যাচ্ছিলেন অন্তর্বর্তী এই সময়। উপন্যাস-কল্পনা তো বিদ্যুত্বান আর তার আলোকন দূরাদয়শ্চক্রকে নিকটতর করে। উপন্যাস-কল্পনা ছাড়াও একটা উপন্যাস-পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হয়। আবার, কল্পনা সত্ত্বেও হয় না। এই দুইয়ের মধ্যে পরিপূরকতা অপরিহার্য নয়। কিন্তু যদি কোনও লেখকের লেখায় তা ঘটে যায়, তা হলে সেই সংঘটনটিকে চিনে নিতে হয়। নুন চা ও রুশিকা এই দুটি উপন্যাসে, আমার কাছে অন্তত, বিমল লামার ঔপন্যাসিক কল্পনার ও পরিকল্পনার সঙ্গতি প্রধান লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
দার্জিলিঙ-পাহাড় ও পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলমহল উনিশ শতক থেকেই বাঙালি বিদ্বজ্জন ও লেখকদের প্রিয় প্রস্থানভূমি। এত দীর্ঘ সংসর্গ সত্ত্বেও এই দুই অঞ্চল কিন্তু তার ভৌগোলিক-বাস্তবিক জীবনযাপন নিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিষয় হয়ে ওঠেনি। এ সব জায়গা নিয়ে গল্প-উপন্যাস-সিনেমা-চিত্র তো নেহাত কম রচিত হয়নি। ছবির কথা এখানে বাদ রাখছি— গোপাল ঘোষ, রামকিঙ্কর, জয়নুল আবেদিন, গণেশ হালোই, নীরদ মজুমদারদের কথা মনে রেখে। কিন্তু গল্প-উপন্যাস-সিনেমা কখনওই একটা প্রেমমেলান বা সম্পর্ক-ভাঙার নাগরিক গল্পের পরিবেশিক সমর্থনের অতিরিক্ত কিছু আমাদের জন্য সংগ্রহ করে সঞ্চিত রাখেনি। এমনকী সত্যজিৎ রায়ও নন। তিনি এই দুই জায়গা নিয়েই দুটি সিনেমা তৈরি করেছিলেন— ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। প্রায় গাণিতিক নির্ভুলতায় তাঁর চিত্রনাট্যগুলি তৈরি হয়ে থাকে। এই দুটি ছবিতে দুটি গল্প ঘটল, এই দুই প্রকৃতি-নিসর্গ সেই দুটি গল্পের ঘটনাক্ষেত্র মাত্র। অমন ঘটনা অন্য যে কোনও জায়গাতেই ঘটতে পারত। তাঁর এই দুই ছবি— গল্প দুটিকে উতরোতে পারল না— বা উতরোতে চায়ই না, যেন ওই জঙ্গল, যা অরণ্য বলেই চেনা গেল না, আর ওই দার্জিলিঙ, যা শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্যমানতার নিরিখেই বাঁধা— কতকগুলি সম্পর্ক-প্রস্তাবনা বা প্রত্যাখ্যান, বা এমনকী ধর্ষণেরও অনুকূল ‘লোকেল’। যেন ওখানে মানুষরা যাতায়াতটুকু করে, ওখানে কোনও মানুষ থাকে না।
বিশ্বসাহিত্যের একটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক, লেখা হয়েছিল উপনিবেশ হয়ে যাওয়া এক দেশের মানুষের সেই অরণ্যের অধিকার হারিয়ে ফেলার সংরক্ত রোম্যান্টিক বেদনা থেকে। আরণ্যক-এর নায়ক যেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের পাগলা মেহের আলি। একটি চরিত্রের সঙ্গেও তার কোনও অন্বয় ঘটে না।
বিমল লামা তাঁর উপন্যাস-কল্পনায় এই গোলকার্ধটি উল্টে নিয়েছেন। দুটি উপন্যাসেই। রুশিকা-তে সেই উল্টে নেওয়াটা উপন্যাস-পরিকল্পনার সঙ্গে অনেক বেশি সঙ্গত। হয়তো, অতটা সঙ্গত না হলেও চলত। কিন্তু তেমন যে মনে হল সে-ও, হয়তো, আমারই উপন্যাস পড়ার অভ্যাসবশত। উপন্যাস পড়াও তো উপন্যাস পড়েই শিখতে হয়।
কী করে উল্টে নিলেন বিমল লামা সেই গোলকার্ধ? কী হয় যদি পাহাড়ের ও জঙ্গলমহলের চিরকালের মানুষজন প্রবল রোম্যান্টিক আবেগে বাকি গোলকার্ধের সঙ্গে মিলতে চান— তাঁদের নিজেদের শর্তে? নিজের-নিজেদের জীবনে বেঁচে থাকাটাই তো মহত্তম রোম্যান্স। সেই মানুষজনের প্রতি দিনের, ও অনাদি পুরুষানুক্রমিক গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের, একেবারে ওতপ্রোত প্রকৃতি-নিসর্গকেও সেই উল্টে দেওয়ার অবর্জ্য উপাদান ও বাহন ও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার ও প্রয়োগ করে? আমরা কোনও দৃশ্য নই; আমরা সভ্যতা থেকে ক্ষণিক পরিবর্তনের জন্য বেড়ানর জায়গা নই; আমরা একটা জীবন— সেই জীবনই মিলবে আর একটা জীবনের সঙ্গে— নইলে গোলকটা চিরকালই অর্ধেক থাকবে।
বিমল লামা এই কল্পনা থেকেই উপন্যাসটির পরিকল্পনা ছকেছেন। তাই ঝুমুর ও ছৌ এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। সেই ছৌ-এর এক তথাকথিত রাষ্ট্রীয় সম্মানিতও আছেন। সেই ছৌ ও ঝুমুরের সূত্রেই এই জনপদ বিড়ি বাঁধা ও জলধান রোওয়ায় নতুন বৃত্তি আবিষ্কার করে। সেই ছৌ ও ঝুমুরের আশ্রয়েই কানু নামের মধ্যবিত্ত যে যুবকটি ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করতে একেবারে প্রস্তুত হয়ে ছিল, সে-ই হয়ে যায় জীবনশিল্পী, ওখানকার ভাষায় ‘রুশিকা’।
ওই কানুকে কি প্রয়োজন ছিল? এটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন হতে পারে। সেই প্রশ্নের নিরসন দিয়ে উপন্যাস হয় না। বিমল লামা নৃতত্ত্বের ধার ধারেননি। তিনি এমন কোনও তথ্যই সেই আদিবাসী জীবন থেকে খবর হিসেবে আমাদের দেননি যার কোনও জীবনযাপনাধিক নৃতাত্ত্বিক মূল্য আছে। অসমসাহসিকের প্রায় হঠকারিতায় তিনি উপন্যাসের প্রচলিত সম্ভাব্যতাকে উড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ উপন্যাস-কল্পনার যুক্তিতে সেই সব অসম্ভাব্যতাকে বিশ্বাস্য করে তুলেছেন। তাঁর উপন্যাসে ওই আঞ্চলিক ভাষা প্রতি দিনের ব্যবহৃত ভাষার মতো সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে। অথচ সেই ভাষাতেই ‘ডেস্টিনি’, ‘বিনির্মাণ’ এই সব শব্দ উপন্যাসের গতিনির্ধারক শব্দ হয়ে উঠেছে। পুরো জঙ্গলমহলকে— ঝাড়খণ্ড সহ— সংযুত করতে তাঁর একমাত্র বাহন— কানুর মোটরবাইক। সেই দ্রুততা ছাড়া এতটা স্থান ও ঘটনার বিস্তার গাঁথাই যেত না। সেই গ্রন্থন একই সঙ্গে ঘটনাবহুল ও তত্ত্বকথা (ডিসকোর্স) বহুল। তাঁর উপন্যাস-কল্পনা এত নিখুঁত যে ওই অরণ্যের গোলকার্ধের বিরুদ্ধ-শক্তি হিসেবে তিনি মাওবাদীদেরও চিহ্নিত করেছেন।
উপন্যাস-পরিকল্পনায় এমন সব ঘটনা ঘটেছে যা রচনাগুণে ও সেই গুণপ্রয়োগের নিশ্চিত লক্ষ নির্মাণের সামর্থে উপন্যাসের স্মরণীয় অংশ হয়ে গিয়েছে। তালিকা করলে কুলোবে না বলে কলমে যা আসছে, তেমন মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করছি: নিজের বেগুনখেত উৎপাটন করে রাজার ছৌ নাচ, কানুকে অরণ্যের অন্তর চেনাতে কানুকে নিয়ে অরণ্যের সেই গহনে পৌঁছতে গিয়ে মিশিলার কানুকে হারিয়ে ফেলা, পুলিশ-বাহিনীর দখল থেকে ঝুমুর-ঝগরুর শবদেহ ছিনিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে ছুটে যাওয়া, মিশিলার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ডের সীমানার পলাশ-অরণ্য আর শালবন পেরনো, বাইকে, কানুর— আরও এমন কত।
কানু-মিশিলার সম্পর্কের কথা এ আলোচনার বাইরে রাখছি— শুধুই স্থানাভাবে।
দুটি সমস্যা আমি মেটাতে পারিনি। হয়তো আমারই উপন্যাস-ভাবনার ছাঁচের দোষে। কানু আর ফেরে কেন? লেখক না হলে কি সে রুশিকা হতে পারত না? উত্তরটা আমাকেই বুঝে নিতে হবে। উপন্যাস পড়েই তো উপন্যাস পড়া শিখতে হয়। রুশিকা তো তেমনই একটি উপন্যাস।
আকস্মিকই মনে এল— নবকুমারকে বাঁচাতে কপালকুণ্ডলা অরণ্য থেকে বেরিয়ে এসেছিল। কেউই বাঁচতে পারল না। কানুকে বাঁচাতে মিশিলা কানুকে অরণ্যের অন্তর চেনাল।
কিন্তু কপালকুণ্ডলাও তো অরণ্যে বহিরাগতই ছিল, আর এক বহিরাগত। কাপালিকের শিকার হিসেবে? কানু আর মিশিলা কেউই তো বহিরাগত থাকল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy