ঈশ্বরকণা: লার্জ হেড্রন কোলাইডার-এর প্রতিরূপের ছবি তুলতে ব্যস্ত দর্শক। লন্ডনে এক প্রদর্শনীতে, ২০১৩। ছবি: গেটি ইমেজেস
ঈশ্বরকণা মানুষ ইত্যাদি
লেখক: পথিক গুহ
মূল্য: ৩৫০.০০
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স
আমাদের সাংস্কৃতিক অ্যাজেন্ডায় বিজ্ঞান নেই। যদিও ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির পাঠক্রমে ভর্তি করানোর জন্য বাপ-মায়ের তাগিদ দেখলে উল্টোটাই মনে আসতে বাধ্য। ব্ল্যাকবোর্ডের বাইরে বিজ্ঞান প্রায় অস্তিত্বহীন। গল্পের বইয়ের মতো করে কোনও বিজ্ঞানগ্রন্থ কবে শেষ পড়েছেন, এই প্রশ্নের মুখে গরিষ্ঠ সাধারণ শূন্য দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকবেন। সমস্যা হল, এটা যে একটা সমস্যা, সেই বোধ তৈরি হয়নি আমাদের ভেতর। মৃদুভাষী পথিক গুহকে যতবার টেনে এনেছি এ নিয়ে আলোচনায়, দেখেছি তাঁর অনুচ্চ কণ্ঠেও উত্তেজনা চাপা থাকেনি। আরও মনে পড়ে, বিজ্ঞানের কোনও ভাল বই পড়ার রোমাঞ্চ যে কখনও কখনও উচ্চ মানের থ্রিলারকেও পিছনে ফেলে দিতে পারে, অনুভবে ভেজা প্রেমকাহিনিকে করে তুলতে পারে জোলো অথবা তাতে থাকতে পারে কোনও ট্র্যাজিক কাহিনির তুল্য সক্ষম সূক্ষ্ম শূল, ওইসব আলোচনায় তা নিয়ে আমরা ছিলাম একমত। তাঁরই লেখা বিজ্ঞানরচনার সংকলন হাতে পেয়ে ওই ভাবনা যে কত সত্য সেটা নতুন করে টের পাচ্ছি। এই বইটি পাঠের অর্থ হল আন্দাজ কয়েকশো বিজ্ঞানগ্রন্থের নির্যাসে ঋদ্ধ হওয়া, যে সব বইতে ধরা আছে বিশ্বের রহস্যভেদে মানুষের একক অভিযানের কথা, প্রকৃতির স্বরূপ নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনার সাম্প্রতিক ছবি, আছে বিজ্ঞানের ইতিহাস, বিজ্ঞানীজীবনের অজানা কাহিনির খোঁজ।
শ্রীগুহ বুভুক্ষু পাঠক। এমন সব প্রশ্নে তিনি রোমাঞ্চিত হন এবং তাঁর কলমের মাধ্যমে সে রোমাঞ্চকে করে তুলতে পারেন সংক্রামক, যেগুলোর সামনে দাঁড়ালে প্রকৃতিতে মানুষের নিজস্ব প্রেক্ষিতটি নতুন আলোয় চিহ্নিত হয়। একই সঙ্গে দু’রকম উপলব্ধি আমাদের চেতনা অধিকার করে। এক, আমরা বুঝি, এই মহাবিশ্বের বিশালতার পাশে মানবজীবন এক নগণ্য অস্তিত্ব। ধুলোকণার অহংকারও তার সাজে না। অপর দিকে পাই এই বিশ্বাস যে, মানুষ তার মস্তিষ্কে ধারণ করেছে এই বিশালকেও। বিরাটকে যে ভাবনায় বন্দি করেছে তার তো কোনও ক্ষুদ্রতা সাজে না!
হয়তো অতি রোমান্টিক ভাবনা। কিন্তু পথিক গুহের বইটি জুড়ে তারই আবাহন ও সেলিব্রেশন। এই বইয়ের মোট সাতাশটি রচনা গত তিরিশ বছরেরও বেশি সময় জুড়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটি সরাসরি বই নিয়েই আলোচনা। নানা লেখায় যেসব বিষয় ছুঁয়ে গিয়েছেন শ্রীগুহ, তার বৈচিত্রের পাল্লা প্রায় গ্যালাক্সিব্যাপী: দাবাখেলা থেকে সময়-লাফ, বিশ্বের সূচনালগ্নের ছবি থেকে ফ্রাংক টিপলার কথিত ‘শেষের সে দিন’-এর ওমেগা পয়েন্ট, মানুষের সম্ভাব্য সীমা ও যন্ত্রমানবের অসীমে পাড়ি দেওয়ার সম্ভাবনা, ভিনগ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর খতিয়ান থেকে বিশ শতকের বিস্ময় আইনস্টাইনের মগজ খুঁড়ে তাঁর অতুল কল্পনাশক্তির উৎস খোঁজার চেষ্টা, এরকম আরও অনেক। বিভিন্ন রচনায় পুনরাবৃত্ত হয়ে কয়েকটা বিষয় অধিক আয়তন পেয়েছে। যেমন আইনস্টাইন, তাঁর জীবন, চেপে রাখা অধ্যায়, গবেষণা ও কিছু ভ্রান্তি। যেমন, পরমাণু বোমা (হাইড্রোজেন বোমাও) সংক্রান্ত ইতিহাস। বোমা-বিজ্ঞান, বোমার স্থপতি, বোমা বানানোর প্রতিযোগিতা, গোপনীয়তা, তথ্য পাচারকারী গুপ্তচর, ধরপাকড়, বিচার বা বিচারের প্রহসন, প্রাণদণ্ড, এমনকী প্রায় গোয়েন্দাগিরি করে সেই ইতিহাসের নানা সূত্র আবিষ্কার করে গ্রন্থ লিখেছেন যে সাংবাদিক, পথিক গুহ সবাইকেই ধরেন একটা বিরাট ক্যানভাসে। যেখানে কোনও আইডিয়াকে বিশদ করার প্রয়োজন ঘটেছে, শ্রীগুহ তাকে ধরেছেন সর্বনিম্ন ধাপ থেকে, ক্রমশ নিয়ে গেছেন জটিলতর উচ্চতায়।
তাঁর লেখা পড়তে শুরু করার কিছুক্ষণের ভেতর কয়েকটা বৈশিষ্ট্য নজর না টেনে পারে না। এক, এর অনবদ্য সাহিত্যগুণ। কিছুটা এগোতে বোঝা যায় ছোটগল্প নয়, এতে রয়েছে উপন্যাসের চলন। তাঁর বাক্য এগোয় সরল দৃঢ়তায়। বাক্য কাটেন এমন ভাবে, যেন তুষারগাত্রে কোনও পর্বতারোহী একটু থেমে পিটন পুঁতছেন। এই ভঙ্গির একটা শ্লথ অথচ অমোঘ প্রভাব আছে। প্রতীক্ষা পাঠককে জারিত করতে থাকে।
মন্ত্রসম উদ্ধৃতি হল সেই প্রতীক্ষার এক পুরস্কার। এমন প্রাসঙ্গিক বচন— কোনও বিখ্যাত ব্যক্তির মন্তব্য, রচনাংশ, হয়তো কোনও চিঠির ছত্রই বা— তিনি লেখার মধ্যে তুলে আনেন, যা মুহূর্তে রচনার ওই অংশটাকে অভাবিতপূর্ব আলোয় ভাসিয়ে দেয়। খুব কঠিন কাজ এই ম্যাজিক চকমকি চয়ন। তাতে কখনও বক্তব্য বিষয় হয়ে ওঠে স্বচ্ছ, কখনও সম্পূর্ণ মোড় ঘুরিয়ে দেয় আলোচনার, প্রধান আকর্ষকের মতো রচনার পথকে টেনে আনে নিজের দিকে। পাঠককেও।
এ থেকে প্রশ্রয় পায় লেখার আর-এক বৈশিষ্ট্য। রচনাগুলো, এগুলোর নাতিক্ষুদ্র অংশ অন্তত, কোনও ধরাবাঁধা ভাবনারেখা অনুসরণ করে না। একটা মূল থিমের সঙ্গে পুষ্ট কিংবা ক্ষীণ সূত্রে যুক্ত থেকে নানা দিকে বিচরণ করতে থাকে। জন্ম নেয় নানা ভাবনার ও ঘটনার কোলাজ, উপাদানগুলো পাশাপাশি বিরাজ করে, কখনও বা পারস্পরিক বিচারের প্রতীক্ষায়। ফলে রচনার গোড়ায় যে বিষয়ের জন্য আসন পাতা হয়েছিল বলে মনে হয়, অনেক সময়ে রচনাটি তাকে সরাসরি গাঁথে না, স্পর্শকের মতো ছুঁয়ে যায়।
এতে আমাদের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ আমরা কোনও নির্দিষ্ট জ্ঞানার্জনের লোভে বইটি খুলিনি, আমরা শেষ অবধি উপভোগ করতে থাকি অজস্র আইডিয়ার স্ন্যাপশট ও ঘটনাচূর্ণ, যা ক্রমাগত আমাদের খিদে বাড়াতে থাকে এবং আমরা অনুভব করি বিজ্ঞানক্ষেত্রের সজীব স্পন্দন— আমার মতে ঠিক যে উদ্দেশ্যে শ্রীগুহ এই রচনাগুলোর জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু যেটা সত্যিই প্রয়োজন ছিল বিচ্ছিন্ন ভাবে রচিত প্রবন্ধগুলিকে এই গ্রন্থে গাঁথার সময় তা হল, আইডিয়াগুলোর সাম্প্রতিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে দেওয়া। বুদবুদের মতো আইডিয়ার জন্ম হচ্ছে, কিছু টিকে যাচ্ছে, কিছু পরীক্ষায় বাতিল হচ্ছে, কিছু পরীক্ষার অপেক্ষায় কাল কাটাতে কাটাতে সরে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে। সক্রিয় বিজ্ঞানকর্মীর কাছে এটা বড় সমস্যা নয়, কিন্তু সাধারণ পাঠক সচরাচর প্রতিটা পরীক্ষিত অপরীক্ষিত আইডিয়াকেই প্রকৃতির স্বরূপ বলে ধরেন। ফলে ধন্দ তৈরি হওয়ার একটা আশঙ্কা থেকে যায়। একটি উদাহরণ, ফ্রাংক টিপলার-এর ‘ওমেগা পয়েন্ট’ তত্ত্ব, যা দাবি করে ব্রহ্মাণ্ডের অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে পুনঃসৃজিত হবে এই চরাচর, ফিরে আসবে আজকের সব কিছু কারণ সেই মুহূর্তটিতেই প্রতিভাত হবেন ঈশ্বর। গ্রহণীয়তার কোন স্তরে এই তত্ত্ব রয়েছে সেটা জানতে আগ্রহ হয়। ঈশ্বর যে এই বইয়ের এক পুনরাবৃত্ত মোটিফ সেটাও আমাদের নজর এড়ায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy