রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিচিত্রমুখী স্রষ্টার নাম করতে গেলে প্রথমেই মনে পড়বে বুদ্ধদেব বসুর কথা। তাঁর মূল পরিচিতি কবি হিসেবেই। কিন্তু কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনি, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা— সাহিত্যের এই বিভিন্ন ধারায় সর্বতোমুখী অভিযানে বুদ্ধদেব অবশ্যই অনন্য। এর প্রত্যেকটি ধারায় তাঁর চেয়ে কৃতী স্রষ্টা নিশ্চয়ই আছেন, কিন্তু এতগুলি শাখায় প্রায় সমান দক্ষতা নিয়ে বিচরণ করার মতো ক্ষমতা রবীন্দ্র-পরবর্তী খুব কম লেখকের মধ্যেই লক্ষ করা গেছে। উপরন্তু, শুধু স্রষ্টারূপে নয়, পত্রিকা-সম্পাদক হিসেবে বুদ্ধদেব দীর্ঘদিন যে দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন, তারও নজির বেশি নেই। প্রথম ‘প্রগতি’ এবং তার পরে ‘কবিতা’, এই দু’টি পত্রিকা নিয়মিত বের করেছেন তিনি। ‘পরিচয়’, ‘নিরুক্ত’, ‘পূর্বাশা’র পাশাপাশি ‘কবিতা’র মতো অবাণিজ্যিক পত্রিকা চালিয়ে যাওয়া রীতিমতো দুঃসাধ্য ছিল চল্লিশ-পঞ্চাশের প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশে। কিন্তু বুদ্ধদেব তাঁর অদম্য উত্সাহে এবং ভালোবাসায় সে কাজটি সম্পন্ন করে গেছেন। বস্তুত তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টাতেই সেদিন নতুন করে আবিষ্কৃত হয়েছেন ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশ-এর মতো কবি। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বারা চালিত না হয়ে শিল্পগুণকেই লেখার প্রকাশযোগ্যতার একমাত্র শর্ত বলে গণ্য করতেন তিনি। ফলে ‘কবিতা’ পত্রিকায় নরেশ গুহ, অরুণকুমার সরকার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, কামাক্ষীপ্রসাদ, বিশ্ব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি বিষ্ণু দে সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বিভিন্ন মানসিকতার কবিদের কবিতা বা তাঁদের কবিতা বিষয়ে আলোচনা ছাপা হতে পেরেছিল।
সেই ‘কবিতা’ পত্রিকা আজ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসামান্য ঐতিহ্যের ধারক। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রায় পঁচিশ বছর একটানা প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। হয়তো অর্থনৈতিক কারণে, কিংবা এমনও হতে পারে, সম্পাদক স্বয়ং মনে করেছিলেন— কবিতায় নতুন যুগ এসে গিয়েছে, পুরনো পত্রিকা চালানোর আর প্রয়োজন নেই। কারণ, পাঁচের দশকে ‘উত্তরসূরী’, ‘শতভিষা’ বা ‘কৃত্তিবাস’-এর মতো অনেকগুলি নতুন কবিতাপত্রের আবির্ভাব ঘটেছিল। ‘কবিতা’ বন্ধ হয়ে যায় ১৯৬১ সালে, তারপর অর্ধশতকের বেশি সময় অতিবাহিত। ফলে আজকের প্রজন্ম ‘কবিতা’ সম্পর্কে যেটুকু জানে, তা শুধু অন্যের স্মৃতিচারণের মাধ্যমেই। পত্রিকাটির চেহারা-চরিত্র বিষয়ে প্রত্যক্ষ কোনও ধারণা তৈরি হওয়ার উপায় নেই। কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা মীনাক্ষী দত্ত তিন খণ্ডে ‘কবিতা’র নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেছিলেন প্যাপিরাস থেকে— ডিসেম্বর ১৯৮৭ থেকে জানুয়ারি ১৯৮৯-র মধ্যে। ওই ১৯৮৯-তেই প্রভাতকুমার দাস ‘কবিতা’ পত্রিকা: সূচিগত ইতিহাস প্রকাশ করেন প্যাপিরাস থেকে। কিন্তু তারপর আরও সিকি-শতাব্দী পার হয়ে গেছে। বুদ্ধদেব বসুর রচনাসংগ্রহ খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছিল যে প্রতিষ্ঠান থেকে, সেটিও অধুনালুপ্ত। ফলে আজকের উত্সাহী পাঠকের পক্ষেও জাতীয় গ্রন্থাগার বা ওই ধরনের প্রতিষ্ঠান ছাড়া বুদ্ধদেব বসুর প্রতিটি বইয়ের হদিশ পাওয়া দুঃসাধ্য। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে তিন খণ্ডে বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য: ‘কবিতা’ থেকে বইগুলির প্রকাশ গভীর তাত্পর্যবহ। বইগুলি সম্পাদনা করেছেন কবির কনিষ্ঠা কন্যা দময়ন্তী বসু সিংহ।
বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য:
‘কবিতা’ থেকে (১ম, ২য়, ৩য় খণ্ড)।
সম্পা: দময়ন্তী বসু সিংহ।
বিকল্প, প্রতি খণ্ড ৩০০.০০
প্রথম খণ্ডে স্থান পেয়েছে ‘কবিতা’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সম্পাদকীয়’ ও নানা গ্রন্থের সমালোচনা। বুদ্ধদেব প্রথম দিকে ‘সম্পাদকীয়’ শব্দটি ব্যবহার করতেন না। শব্দটির প্রথম ব্যবহার লক্ষ করা যায় ‘কবিতা’র বিশেষ ‘রবীন্দ্র সংখ্যা’ (১৯৪১) থেকে। আর শেষ পাঁচ বছর তিনি ‘সম্পাদকীয়’ প্রায় লেখেনইনি। এই সম্পাদকীয়ের অন্তর্গত শোকবার্তা-ও অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের চেহারা নিয়েছে। যেমন ‘সুকান্ত’। গ্রন্থ-সমালোচনা ‘কবিতা’র আর এক বিশেষ সম্পদ। বুদ্ধদেব নিজেই এ কাজটি করতেন। সমকালীন কবিদের প্রায় প্রত্যেকের কোনও-না-কোনও কাব্যগ্রন্থের (ক্ষেত্র বিশেষে একাধিক) যে সমালোচনা তিনি করে গিয়েছেন, তাতে বোঝা যায়, সমালোচনার কোনও উঁচু মানদণ্ডকে তিনি সচেতন ভাবে প্রয়োগ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। শুধুমাত্র স্তবকীর্তন বা ছিদ্রান্বেষণ-এর কোনওটাই তাঁর সমালোচনায় দেখতে পাওয়া যায় না। কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে ছোট করা— এ স্বভাব ছিল না তাঁর। যাঁর যেটুকু সম্মান প্রাপ্য, অকৃপণ ভাবে তিনি বিলিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নিজস্ব যুক্তিক্রম বা বিশ্বাসের শক্ত ভিত থেকে সরে আসেননি কখনও। প্রয়োজনবোধে অনেক অপ্রিয় সত্যও উচ্চারণ করেছেন নির্দ্বিধায়। যেমন, উত্তরকালীন জীবনানন্দ প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন, যা অনেকেরই অপছন্দের কারণ বলে গণ্য হবে: “মনে-মনে এখনও তিনি নির্জনের নির্ঝর, তাঁর চিত্ততন্ত্রী এখনো স্বপ্নের অনুকম্পায়ী। কিন্তু পাছে কেউ বলে তিনি এস্কেপিস্ট, কুখ্যাত আইভরি টাওয়ারের নির্লজ্জ অধিবাসী, সেই জন্য ইতিহাসের চেতনাকে তাঁর সাম্প্রতিক রচনার বিষয়ীভূত করে তিনি এইটেই প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে তিনি ‘পিছিয়ে’ পড়েননি। করুণ দৃশ্য, এবং শোচনীয়।” আবার মনের মতো বই হলে, বুদ্ধদেব তার লিখনভঙ্গির প্রশংসায় উদার, অকৃপণ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর ধারে প্রসঙ্গে তাই তাঁর এমন উচ্ছ্বাসমুগ্ধতা: “জীবনস্মৃতি যে আমরা বারবার পড়ি তা তো খবর জানবার লোভে নয়, শুধু ভালো লাগে বলেই। তেমনি এ-বইও বারবার পড়বো আমরা— পড়বো ছুটির দিনে, দুঃখের দিনে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর রঙের পাত্র, রসের পাত্র, এতে একেবারে ঢেলে দিয়েছেন, অথচ দিতে-দিতেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন, আবেগের রাশ টেনে ধরেছেন এমন করে যে তাঁর হৃদয়ের ভাবপুঞ্জ সমস্ত বইটিতে অলৌকিক আভার মতো ছড়িয়ে আছে— কোনোখানেই হাত দিয়ে তাকে ধরা যায় না, অথচ সবখানেই সে আছে।”
শঙ্খ ঘোষের ভূমিকা-সংবলিত আলোচ্য বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের উপজীব্য— রবীন্দ্রনাথ। আমরা সকলেই জানি, বুদ্ধদেব বরাবরই রবীন্দ্রনাথের এক গুণমুগ্ধ পাঠক। ঠিক ভক্তিতদ্গত চিত্তে তিনি কখনওই রবীন্দ্র-ভজনা করেননি, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে বরং অনেক ব্যাপারেই তাঁর কুণ্ঠা আছে। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে রবীন্দ্রনাথই তাঁর বিচারে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। শতবার্ষিকীর পরে লেখা একটি প্রবন্ধের শুরুই করেছেন তিনি এই ভাবে: “যেন এক দৈব আবির্ভাব— অপর্যাপ্ত, চেষ্টাহীন, ভাস্বর, পৃথিবীর মহত্তম কবিদের অন্যতম: আমার কাছে এবং আমার মতো আরো অনেকের কাছে, এ-ই হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।” যদিও একই অনুচ্ছেদ শেষ করেছেন তিনি এই বাক্যে: “চিন্তাহীন মাল্যচন্দনে আজ আবৃত তিনি, এক বিগ্রহ, তাঁর মাতৃভূমির নব্যতম ‘অবতার’।’’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিতে এক ক্রমজায়মান শিল্পী— ধীর সানুপুঙ্খ যাঁর বিবর্তন। উত্তরজীবনে বুদ্ধদেবের কয়েকটি সেরা বই রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করেই রচিত। তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্য, সঙ্গ: নিঃসঙ্গতা: রবীন্দ্রনাথ কিংবা কবি রবীন্দ্রনাথ-এর কথা স্বতঃই মনে পড়বে। পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা টেগোর: পোর্ট্রেট অব আ পোয়েট (১৯৬২) বইটিও স্মরণীয়। কিন্তু এই বইগুলি প্রকাশের বেশ কিছু আগে থেকেই ‘কবিতা’র পৃষ্ঠায় তিনি রবীন্দ্রনাথের অজস্র গ্রন্থের সমালোচনা করেছিলেন, লিখেছিলেন রবীন্দ্র-রচনাবলী-র (বিশ্বভারতী) বিভিন্ন খণ্ডের পর্যালোচনা কিংবা নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত রবীন্দ্র বিষয়ক গ্রন্থের সমালোচনা। সেগুলির কোনও কোনওটিতে হয়তো পরবর্তী-সময়ে-করা বিশদ আলোচনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। রবীন্দ্র রচনাবলী প্রথম খণ্ডের আলোচনা করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন— “আঙ্গিকের দিক থেকে এবং ভাবের দিক থেকেও বটে, ‘মানসী’কে রবীন্দ্রকাব্যের মাইক্রোকজম্ বলা যায়।”— ১৯৩৯-এর এই পর্যবেক্ষণই বিস্তৃততর বিশ্লেষণে ফিরে এসেছে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের সময়ে রচিত ‘বাংলা কাব্যের স্বপ্নভঙ্গ: মানসী’ প্রবন্ধে, যেখানে ‘মানসী’কে তিনি রবীন্দ্রকাব্যের ‘অণুবিশ্ব’ বলেছেন। কবিতার ছন্দ মিল স্তবকবিন্যাস সম্পর্কে তাঁর অনেক তীক্ষ্ন সমীক্ষণ ধরা আছে রবীন্দ্রনাথের ছন্দ বইয়ের আলোচনায়।
তৃতীয় খণ্ডে আমরা পাচ্ছি কবিতার দুর্বোধ্যতা, আধুনিকতা, গদ্যছন্দ কিংবা সমালোচনার পরিভাষা-সংক্রান্ত তত্ত্বভিত্তিক প্রবন্ধের পাশাপাশি ইয়েটস, পল ভালেরি, গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল, এজরা পাউন্ড বা পাস্টেরনাক প্রসঙ্গে বুদ্ধদেবের বক্তব্য। হয়তো সেগুলি পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ নয়, ক্ষেত্র বিশেষে কিছু বিচ্ছিন্ন মন্তব্যের সমষ্টি— কিন্তু তবু তাদের এক জায়গায় যে পাওয়া গেল, সেটাও কম কথা নয়। ‘সমালোচনার পরিভাষা’ রচনাটি আজকের সমালোচককেও সহায়তা করবে। ‘গদ্য ও পদ্য’ কিংবা ‘বাংলা ছন্দ ও মিল’-এর মতো প্রবন্ধ আজকের কবিযশঃপ্রার্থীদেরও ভাবনার খোরাক জোগাবে। সব মিলিয়ে বলতে পারি এই বই তিনটি বুদ্ধদেব-চর্চার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে।
বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy