অর্থনীতিতে একটা বিভাজন রেখা ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে
রাত পোহালেই বাজেট। তবে এ বার অন্যবারের তুলনায় বাজেট নিয়ে ততটা মাতামাতি চোখে পড়ছে না। কোথাও হয়ত বর্তমান সরকারের দীর্ঘ কয়েক বছরের বাজেট থেকে বৃহত্তর নীতির ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ সম্পর্কে একটা আন্দাজ মানুষের হয়েই গিয়েছে। এটা একটা ভাল লক্ষণ। অন্তত ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। বাজেট আলোচনায় কর প্রস্তাবের পিছনে যে নীতি তা ভাল না মন্দ তার আলোচনার প্রেক্ষিত আলাদা। কিন্তু বাজেটের অভিমুখ কোনদিকে থাকবে তা নিয়ে যদি ফাটকা খেলার জায়গা না থাকে তা হলে তা অবশ্যই ভাল। কারণ এতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে আগাম পরিকল্পনা করতে সুবিধা হয়।
আর তা ছাড়া, করের একটা বড় অংশই জিএসটি এবং তা বাজেট প্রস্তাবের বাইরে। মধ্যবিত্তের চাহিদার ছকে তাই পড়ে থাকে মূলত সেই আয়করের অংশটুকুই। প্রতিবারের মতোই এ বারও তা নিয়ে একটা চোরা প্রত্যাশার স্রোত বয়ে চলেছে। অন্যবারের মতোই।
তবে অর্থনীতিতে একটা বিভাজন রেখা ক্রমাগত প্রকট হয়ে উঠছে। গরীব ও বড়লোকের মধ্যে ফারাক বেড়েই চলেছে। মাথায় রাখতে হবে সরকারি হিসাবে বছরে ন’লক্ষ টাকা পর্যন্ত যাঁদের আয় তাঁরা আর্থিক ভাবে দুর্বল হিসাবে গ্রাহ্য। আয়ের ক্ষেত্রে দুর্বল হলেও তাঁদের কিন্তু আয়করের খাঁড়া থেকে রেহাই নেই। এই তথ্যটাই কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে অর্থনীতির অবস্থান। আয়কর ছাড় পাওয়ার আকুলতার স্বাভাবিক প্রবণতার বাইরে গিয়েও শুধু আয় বাড়াতে কর ছাড়ের দিকেও চেয়ে থাকার এই প্রবণতা কিন্তু অর্থনীতির সার্বিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে খুব একটা উৎসাহ জোগায় না।
আর জোগাবেই বা কী করে? কোভিড দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো সামাজিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকার গুরুত্ব। যাঁরা বাজার-বিলাসী তাঁরা যুক্তি দিয়ে থাকেন যে বেসরকারিকরণের ফলে পরিষেবার দক্ষতা বাড়ে। কিন্তু দক্ষতা কী দিয়ে মাপব তাও কিন্তু আলোচনার অপেক্ষা রাখে। কোভিডের সময় আমরা দেখেছি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়ায়, মানুষ শুধু বাঁচতে চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে কী ভাবে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। যাঁর গোটা বছরের আয় ন’লক্ষ তার কাছে ১০ লক্ষ টাকার চিকিৎসা কতটা চাপের তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
তাই দক্ষতা শুধু পরিষেবার মান দিয়ে বিচার করলে চলে না, তাতে কিন্তু সেই পরিষেবা পাওয়ার সুযোগও যোগ করতে হয়। যার আয় ন’লক্ষ তার কাছে ১০ লক্ষ টাকা মূল্যের চিকিৎসাকে কি সুযোগ বলে মানব? দেশ জুড়েই কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার অধিকারের খামতি বাড়ছেই। এই কারণেই।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমস্যাটা একই জায়গায়। সেই কোভিডই আবার আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে শিক্ষার অধিকার বিদ্যালয়ের সংখ্যায় মাপা যায় না, অধিকার মাপতে গেলে মাপতে হয় সুযোগের অঙ্কও।
অনেকেই বলছেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য রাজ্যের হাতে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রেরই বা কতটা কী করার আছে? আছে বইকি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা রাজ্যের হাতে। আর তা সাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে লাগে টাকা। কর বাবদ কেন্দ্র যে টাকা তোলে তার একটা অংশ রাজ্যের প্রাপ্য। কোন কোন করের ক্ষেত্রে তা বন্টন করা হবে এবং তার আনুপাতিক হার কী হবে তাও ঠিক করে দেয় অর্থ কমিশন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে কেন্দ্র কিন্তু বন্টনযোগ্য কর এড়িয়ে রাজকোষ ভরতে এমন খাতে কর বসাচ্ছে যাতে তা রাজ্যের সঙ্গে ভাগ করে না নিতে হয়। যেমন সাম্প্রতিক অতীতে আমরা পেট্রোপণ্যের উপরে বসানো নানান করের ক্ষেত্রে দেখলাম।
তাই একদিকে যেমন আয় বৈষম্য বাড়ছে, ঠিক তেমনই বাড়ছে কর বন্টনের বৈষম্য। একদিকে কর ব্যবস্থার কেন্দ্রায়নের প্রবণতা বাড়ছে, অন্যদিকে বাড়তে থাকা আয় বৈষম্যের কারণে সাধারণের কাছে সামাজিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিসরও বাড়ছে।
মাথায় রাখতে হবে আরও একটা কথা। জাতীয় আয় বাড়লে তা যদি সমবন্টিত হয় তা হলে কিন্তু তা বাজার বাড়াতে সাহায্য করে। তাই জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার নিয়ে এত আলোচনা। তবে তা বাড়লেই যে বৈষম্য কমবে তা নয়। তা নির্ভর করবে আয় বন্টন ব্যবস্থার উপর। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর দুভুরি সুব্বারাও এক প্রবন্ধে বলেছেন, বৃদ্ধির হার নিয়ে সাম্প্রতিক যে আলোচনা চলছে তার ভিত্তিটাই ভুল। কোভিডের ঠিক আগে কী ছিল তার সঙ্গে এখনকার হালের তুলনা করলে সংকোচনের প্রবণতার সঠিক মাপ পাওয়া যাবে না।
তাঁর মতে আজ যদি ধরে নেওয়া যায় যে কোভিড হয়নি, তাহলে দেশের বৃদ্ধির যে প্রবণতা থাকত তার তুলনায় যে ৯.২ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলছি তা আমাদের জাতীয় উৎপাদন যে জায়গা ছুঁতে পারত তার থেকে ৬ শতাংশ কম।
একটু বুঝে নেওয়া যাক। ধরা যাক আমি মাসে আজ থেকে তিন বছর আগে যে আয় করতাম তা প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট হারে বেড়ে আজ এসে ১০ হাজার হত। কিন্তু কোভিডের কারণে এক বছর সেটা সংকুচিত হয়। তার পরে তা ১৫ শতাংশ বেড়ে ৯ হাজার হল। তা হলে এখানে কোন অঙ্কটা গুরুত্বপূর্ণ কোভিডের অভিঘাত বোঝার জন্য? ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি না যা হতে পারত তার থেকেও হাজার টাকা কম মাইনে হাতে আসা?
আর সংকোচন হওয়া সত্ত্বেও বড়লোক আরও বড়লোক হয়েছে, সাধারণ হয়েছে গরিব। আর এটা সামলাতে কিন্তু কর ব্যবস্থার একটা বড় ভূমিকা থাকবে। আয়ের এই বিভাজনকে কমাতে গেলে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার অধিকারকে বাড়াতে হবে। আর তা বাড়াতে গেল কেন্দ্রীয় কর ব্যবস্থাতেও বৈষম্য কমাতে হবে এমন ভাবে যাতে রাজ্য সামাজিক পরিকাঠামোর প্রসার করে নাগরিকের অধিকারকে সম্মান করতে পারে।
তাই এ বারের বাজেটে বাড়া-কমার অঙ্কের থেকেও আসলে যেটা নজর করতে হবে তা হল কেন্দ্র সরকারের কোষাগার ভরতে কী ভাবে পদক্ষেপ করছে। বা অন্য ভাবে বললে, সামাজিক পরিকাঠামোর সুযোগ বাড়াতে কেন্দ্র-রাজ্য আয়ের ভাগে বৈষম্য বাড়ল না কমল নজর রাখতে হবে তার উপরও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy