অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ
শিল্পে মন্দা চলছিলই। তার উপর সৌদি আরবে তেলের পরিকাঠামোয় জঙ্গি হানার জেরে ভারতীয় অর্থনীতিতে ঘনিয়ে আসতে পারে ভয়ানক বিপদ। জ্বালানীর মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা, টাকার দাম পড়ার সম্ভাবনা, তার জেরে মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যম্ভাবী এবং সর্বোপরি ভারতীয় অর্থনীতিতে যে মন্দা আসন্ন, তা আরও ত্বরান্বিত হবে— এমনটাই মত অর্থনীতিবিদদের। অনেকেই মনে করছেন, সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি এমন এক জালে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, যা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ বার করা কার্যত কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে সরকারের কাছে।
শনিবার সৌদি আরবের সরকারি তেল সংস্থা ‘অ্যারামকো’তে জঙ্গি হানা হয়েছে। অন্তত ১০টি ড্রোন হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দেশের তেল উত্তোলন থেকে পরিশোধন—গোটা পরিকাঠামোতেই। ফলে তিন দিনের মধ্যেই কাঁচা তেলের উৎপাদন কমে গিয়েছে পাঁচ শতাংশ। সারা বিশ্বেই তার প্রভাব পড়েছে। বাড়তে শুরু করেছে জ্বালানির দাম। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটা প্রাথমিক ধাক্কা। জঙ্গিরা আরও হামলার হুমকি দিয়েছে। ফলে কাঁচা তেলের উৎপাদন কমে যেতে পারে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। অর্থাৎ উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। সেটা হলে অর্থনীতির সহজ চাহিদা ও জোগানের সূত্র মেনেই দাম বাড়বে কাঁচা তেলের। কাঁচা তেল কেনার খরচ বাড়লে স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে জ্বালানি এবং পেট্রোপণ্যের দাম।
অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রভাব প্রত্যক্ষ। ভারতের ক্ষেত্রে এই আসন্ন বিপদ বহুমুখী। প্রথমত, ভারতের নিজস্ব তেলের ভাণ্ডার খুবই কম। এ দেশে চাহিদার ৮০ শতাংশই অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে হয়। আবার ডলারের তুলনায় টাকার মূল্য ক্রমেই কমছে। তার প্রভাবওসরাসরি কাঁচা তেল আমদানিতে পড়ে। কারণ,ভারতকে কাঁচা তেল আমদানির টাকা মেটাতে হয় ডলারে। ফলে তেলের দাম বৃদ্ধি এবং টাকার মূল্য হ্রাসের জোড়া ধাক্কা সামলাতে হয় ভারতকে। তার জেরে কমতে থাকে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার।
দ্বিমুখী এই চাপে আমদানি খরচ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারও এই জায়গাতে সবচেয়ে বেশি শঙ্কার কারণ দেখছেন। তিনি বলেন, ‘‘কাঁচা তেলের দাম বাড়লে অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়ে সামগ্রিক ভাবে। ফলে সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারবে না ভারতের অর্থনীতি। সবথেকে সমস্যা হতে পারে আমদানি খাতে খরচ বৃদ্ধি। তার জেরে চলতি খাতে ঘাটতি বাড়বে। সেটা হলে টাকার দাম আরও পড়বে।’’
আরও পড়ুন: সিবিআই বলল, জামিনে তদন্ত ব্যাহত হবে, রাজীবের আইনজীবীর প্রশ্ন চার দিনে কী এমন ঘটল?
তার উপর সময়টাও ভাবাচ্ছে অর্থনীতিবিদদের। কারণ, এমন এক সময়ে সৌদি আরবে তেল পরিকাঠামোয় জঙ্গি হানা হয়েছে, যখন ভারতের অর্থনীতি দুর্বল ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার গত ছ’বছরে সর্বনিম্ন, পাঁচ শতাংশে নেমে গিয়েছে। গাড়ি শিল্পে বিক্রি তলানিতে। নতুন বিনিয়োগ নেই। উৎপাদন শিল্পে ভাটা। সব মিলিয়ে মন্দার মতো পরিস্থিতি।
সরকার অবশ্য সেই তত্ত্ব মানতে নারাজ। তাদের যুক্তি মন্দা নয়, বরং বৃদ্ধির গতি মন্থর। অর্থনীতিবিদদের যদিও পূর্বাভাস, বৃদ্ধির এই শ্লথগতি ধীরে ধীরে মন্দার দিকে এগিয়ে যাওয়ারই সঙ্কেত। এই সময়ে সৌদিতে জঙ্গি হানা কার্যত ডুবন্ত জাহাজে জলনিকাশির পাম্প বিকল হওয়ার মতোই পরিস্থিতি, মনে করছেন অর্থনীতিবিদদের একাংশ।
অর্থনীতিবিদদের একাংশের দাবি, এটা অজানা নয় যে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব সব সময়ই সামগ্রিক। অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে এমনকি পরিষেবা ক্ষেত্রে পর্যন্ত তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। তার প্রভাব আবার পড়ে সাধারণ মানুষের উপর। অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। টাকার মূল্য পড়তে থাকে, কমতে থাকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। ফলে কার্যত অর্থনীতির মেরুদণ্ডই ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ব্যারেল পিছু কাঁচা তেলের দাম বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধি, চলতি খাতে ঘাটতি, বৃদ্ধির হারে পড়তি— এগুলি কার্যত শৃঙ্খলের মতো একটির সঙ্গে অন্যটি যুক্ত। এর যে কোনও একটি অংশ দুর্বল হলে তার প্রভাব পড়ে সর্বত্র। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এর মধ্যেও আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা তেলের দাম। কাঁচা তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব পড়ে সবচেয়ে বেশি।
সৌদি আরবে তেল খনিতে জঙ্গি হানা। —ফাইল চিত্র
আরও পডু়ন: পিএফে সুদের হার বেড়ে হল ৮.৬৫ শতাংশ, ঘোষণা শ্রমমন্ত্রীর
টাকার দাম ক্রমাগত পড়তে থাকলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাঝেমধ্যেই নানা পদক্ষেপ করে থাকে। কিন্তু বর্তমানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ক্ষমতাও কমিয়ে ফেলেছে কেন্দ্র। এমনটাই মনে করেন অভিরূপবাবু। কীভাবে কমেছে সর্বোচ্চ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা? অভিরূপবাবু বলছেন, ‘‘ক্রমাগত টাকার দাম পড়তে থাকলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রেপো রেট কমিয়ে বা অন্য অনেক উপায়ে সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু শীর্ষ ব্যাঙ্কের থেকে কেন্দ্র ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিয়েছে। ফলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কেরও মোকাবিলা করার ক্ষমতা যে কমেছে, এটা বলাই যায়।’’ অর্থাৎ সংস্কারমুখী কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ করার সাধ থাকলেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সেইসাধ্য অনেকটাই কমিয়ে ফেলেছে সরকার।
তবে কি ২০০৮-০৯ সালে মার্কিন মুলুক থেকে শুরু হওয়া মন্দা যে গোটা বিশ্বকে গ্রাস করেছিল, ফের সেই রকম পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছে ভারতীয় অর্থনীতি?ততটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি না হলেও একটা মন্দা যে আসন্ন, সেই আশঙ্কাই করছেন অভিরূপবাবু। তাঁর মতে, ‘‘মন্দার পরিস্থিতি তৈরিই ছিল। ধীরে ধীরে মন্দার দিকেই এগোচ্ছিল অর্থনীতি। সৌদি আরবের ঘটনায় সেই মন্দা আরও তরান্বিত হবে।’’
অর্থাৎ অশনিসঙ্কেত রয়েছে। এখন জঙ্গি হানার মোকাবিলা করে তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াক সৌদি আরব, ফের কাঁচা তেলের উৎপাদন স্বাভাবিক হোক, এটাই প্রাণপণে চাইছে ভারত। চাইছেন ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এবং শিল্পমহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy